শুচি হোক ধরা মোঃ আতিকুর রহমান লাবু
এদেশটিকে ইউরোপ অস্ট্রেলিয়ার মতো আবর্জনামুক্ত দেখতে চান ফিদা হক। অরাজনৈতিক স্বেচ্ছাসেবামূলক সংগঠন ‘পরিবর্তন চাই’ এর সভাপতি তিনি। তাঁর দীর্ঘ প্রবাস জীবনের অভিজ্ঞতাকে কাজে লাগিয়ে দেখতে চান পরিচ্ছন্ন সুশোভিত স্বদেশ। তিনি জানালেন ঢাকা, গাজীপুর, খুলনা, বরিশাল, রংপুরের পর এবার তাঁর স্বেচ্ছাসেবক বাহিনী রাজশাহীর রাজপথে নামবে ‘দেশটাকে পরিষ্কার করি’র অঙ্গীকার নিয়ে। এই ব্যতিক্রমধর্মী আয়োজনের দায়িত্ব পেয়ে আমি অভিভূত হয়েছিলাম কারণ বিশ্ব সাহিত্য কেন্দ্র’র প্রতিষ্ঠাতা অধ্যাপক আব্দুল্লাহ আবু সাইদ, ‘আলোকিত মানুষ চাই’ এর উদ্যোক্তা, এই সংগঠনের উপদেষ্টা।
সেই প্রত্যয়কে সামনে রেখে ৭ ও ৮ আগস্ট ২০১৫ দু'দিনব্যাপী এই আয়োজন। ৭ তারিখ বিকেলে ছিল রাজশাহীর ঐতিহ্যবাহী মিয়া পাড়া সাধারণ গ্রন্থাগারে প্রেস কনফারেন্স আর সন্ধ্যায় এফএম ব্যান্ড ‘রেডিও পদ্মা’য় এক ঘণ্টা-ব্যাপী সাক্ষাৎকারমূলক দীর্ঘ আলোচনা।
৮ তারিখ সকাল থেকেই সাজ সাজ রব। রাজশাহী শহরের মূলত বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীদের অংশগ্রহণে শহরের ব্যস্ততম প্রাণকেন্দ্র (অপরিচ্ছন্নতমও) মনিচত্বর থেকে জিরো পয়েন্ট হয়ে পদ্মা গার্ডেন পর্যন্ত রাস্তা পরিষ্কারের উদ্দেশ্যে অভিযাত্রা ছিল ৮ আগস্টের মূল আয়োজন। বিভিন্ন পেশার মানুষ স্বেচ্ছাসেবক হবার জন্য অনলাইনে রেজিস্ট্রেশন করেছিলেন যা এক পর্যায়ে বন্ধ করে দিতে হয় পরিষ্কার করার সরঞ্জামের সীমাবদ্ধতার কারণে। এদের নিয়ে ২০/২২ জনের মোট ২০টি দল গঠন করা হয়। স্বেচ্ছাসেবীরা ৩ টার মধ্যে সমবেত হয়েছিল মনিচত্বর সংলগ্ন কলেজিয়েট স্কুলের মাঠে। সেখানে সবুজের উপর সাদা লতাপাতা আঁকা টিশার্ট পড়ে শুরু হয় আয়োজন। এরপর ঝাড়ু, বেলচা, বিন ব্যাগ, গ্লাভস, মাস্ক জাতীয় রাস্তা পরিষ্কারের সরঞ্জাম বিতরণ। বিকেল ৪টায় চার শতাধিক স্বেচ্ছাসেবীর বিশাল দলটি নেমে পড়ে রাস্তায়। দূর থেকে দলটিকে দেখে মনে হচ্ছিল সবুজ বৃক্ষরাজির এক মহা সমারোহ। সারা পথ জুড়ে কৌতূহলী জনতার প্রশ্ন, রিক্সা, অটো রিক্সা থামিয়ে মানুষের উঁকি ঝুঁকি। সত্যিই সে এক অভাবনীয় দৃশ্য। আকাশটা সেদিন ছিল মেঘাচ্ছন্ন, কিন্তু স্বেচ্ছাসেবকদের মনের আকাশে ছিল সোনালী সূর্যের বিকিরণ। শহরের সব আবর্জনা মুছে দেবার সে এক আনন্দময় প্রতিযোগিতা। যেন রবি ঠাকুরের সেই অতি চেনা বাণী ‘মুছে যাক গ্লানি, ঘুচে যাক জরা / অগ্নি-স্নানে শুচি হোক ধরা’ বুকে ধারণ করে রাজশাহীর মাটিকে কলুষমুক্ত করার প্রচেষ্টা।
শুরুতে শহরের লোকজন এটাকে র্যাধলি জাতীয় কিছু একটা ভেবেছিল। কিন্তু পথের দুপাশের আবর্জনা যখন ভোজবাজির মতো উবে যেতে লাগলো তখন অনেকেই আগ্রহ করে পথে নেমে এলেন। মনে হচ্ছিলো স্বেচ্ছাসেবক চারশো নয় চার হাজার। ‘পরিবর্তন চাই’ এর সভাপতি ফিদা হক নিজেও একটা ঝাড়ু হাতে নেমে পড়লেন। ময়লা তুলতে দেখা গেল বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক থেকে শুরু করে বিশিষ্ট সমাজসেবীদেরও। বিভিন্ন সংগঠনের নেতা নেতৃরাও অংশ নিলেন এই অভিযানে। বিশেষ করে বলতে হয় এক্স ক্যাডেটস ফোরাম, সার্স-৮৫, নিউরন ফাউন্ডেশন, ফুল-কুঁড়ি আসর, স্বপ্ন (রাঃবিঃ) এবং নবজাগরণ ফাউন্ডেশন এর নাম।
অবশেষে ১ কিলোমিটারের কিছু বেশী পথ পরিষ্কার করে প্রায় ৩০ বস্তা আবর্জনা নিকটস্থ ডাম্পিং হাউসে জমা করে দলটি পৌঁছুল পদ্মা গার্ডেনে; প্রমত্ত পদ্মার পাড় ঘেঁষে গড়ে ওঠা উন্মুক্ত মঞ্চে। আকাশের মেঘগুলো তখন বৃষ্টি হয়ে টুপটুপিয়ে ঝড়ে পড়ছে মাথার পরে। গাছে শোভা পাচ্ছে বাদল দিনের প্রথম কদম ফুল। এই বৃষ্টির মধ্যেই অতিথিবৃন্দ এসে উপস্থিত হলেন - রাজশাহী সিটি কর্পোরেশনের মেয়র নিযাম উল আযিম ও প্রধান পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতা কর্মকর্তা শেখ মহম্মদ মামুন, বিশিষ্ট সমাজসেবী মোঃ শামসুদ্দিন কিন্তু প্রধান অতিথি হিসাবে উপস্থিত থাকতে রাজী হয়েও শেষ পর্যন্ত এলেন না সাহিত্যিক হাসান আজিজুল হক।
অনুষ্ঠানের শেষ পর্যায়ে ছিল স্বেচ্ছাসেবীদের মাঝে সনদপত্র, ব্যাজ এবং নাস্তা বিতরণ। এরপর ফিদা হক স্মারকলিপি পাঠ করে মাননীয় মেয়রের হাতে তুলে দিলেন। সেই সাথে তুলে দিলেন ১০টি ঝুলন্ত ডাস্টবিন শহরের উপযুক্ত স্থানে লাগানো ও পরবর্তীতে রক্ষণাবেক্ষণের জন্য। ‘পরিবর্তন চাই’ এর কো ফাউন্ডার দিদার ভুইঞার সঞ্চালনায় উৎসব মুখর আমেজের মধ্যে দিয়ে শেষ হলো সেই পর্ব। সেই সাথে প্রত্যয় ব্যক্ত হলো রাজশাহী শহরকে পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন রাখার পাশাপাশি আগামী ৩১ ডিসেম্বর ১ লাখ স্বেচ্ছাসেবীর অংশগ্রহণে দেশটাকে পরিষ্কার করি দিবস পালনের।
অনুষ্ঠান শেষে ফেরার সময় দেখি আমরা যে পথ শুধু ঝাড়– দিয়েছিলাম, ঈশ্বর ধুয়ে মুছে তাকে পূর্ণতা দিয়েছেন। এই পথের এমন পরিষ্কার রূপ অনেকের নজরেই পড়ছিল। কয়েকজনকে এটা নিয়ে আলাপ করতেও শুনলাম। তবে পরের দিনই পথ তার পরিচিত পুরনো চেহারায় ফিরে যাবে এটা ভাবিনি। তবে এটা সত্যি যে, এই পথে রাজশাহী-বাসী ফারাক্কা লংমার্চ দেখেছে, স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলন সংগ্রাম দেখেছে, মানব বন্ধন দেখেছে, জনসভা তো আছেই, কিন্তু এমন সবুজের অভিযান আগে কখনও দেখেনি। এটা প্রিন্ট ও ব্রডকাস্টিং মিডিয়ার সাংবাদিকদের চাঞ্চল্যে বেশ ফুটে উঠেছিল।
একটি বিষয় উল্লেখ করা প্রয়োজন। হিসাব করে দেখা গেছে অনুষ্ঠানটি আয়োজন করতে খরচ হয়েছে ৭২ হাজার টাকা। যে ব্যয় নির্বাহ করা হয়েছে কিছু ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের সহায়তায়। সাড়ে চারশো মানুষের ২ ঘণ্টার মোট ৯০০ শ্রম ঘণ্টা দিয়ে খরচকে ভাগ করলে প্রতি শ্রম ঘণ্টার জন্য ব্যয় হয়েছে ৮০ টাকা। একজন মজুরের প্রতি শ্রম ঘণ্টার মূল্য ৫০ টাকা ধরলে ব্যয় বেশীই হয়েছে বলতে হবে। তাহলে নিয়মিত মজুরের বদলে স্বেচ্ছাসেবক দিয়ে কাজ করানোর যৌক্তিকতা কি এই প্রশ্ন উঠবেই।
আচরণ বিজ্ঞানীরা বলেন, কোন একটা কাজ বার বার করলে তবেই তা অভ্যাসে পরিণত হয়। এই যে চার শতাধিক স্বেচ্ছাসেবী উচ্ছল তরুণ তরুণী সেদিন ঝলসে উঠেছিল দেশটাকে পরিষ্কার করার উদগ্র বাসনায় তা কি তাদের চিন্তা-চেতনায়, মন-মননে বিন্দুমাত্র রেখাপাত করবে না? তাদের দেখে রাস্তায় যে পথচারী ছিলেন, রেডিওতে যে শ্রোতা বন্ধুরা শুনছিলেন তারা কি একটুও উদ্বেলিত হবেন না নিজেকে, নিজের পরিপার্শ্বকে পরিচ্ছন্ন রাখার জন্য? বিদেশে দেখেছি ময়লা ফেলার বিন না পেলে মানুষ সে ময়লা বাড়ী নিয়ে যায় - এই সুঅভ্যাস একদিনে গড়ে ওঠেনি। এই যে চার শতাধিক তরুণ তরুণী দু’টি ঘণ্টা অলস ভাবে না কাটিয়ে, ইন্টারনেটে চ্যাটিং না করে, নিজ হাতে রাস্তা পরিষ্কার করলো তা তাদের মনোজগতে কিছুটা হলেও প্রভাব ফেলবে। এই রাস্তায় পুনরায় চিপসের প্যাকেট ফেলতে তারা একটু হলেও চিন্তা করবে। কাজেই এরকম কাজ বার বার করা গেলে তা পরিণামে পরিবর্তিত করবে তাদের আচরণ। আর তাদের এই সুঅভ্যাসটি দেখে শিখবে সমাজের আর দশজন। তাই ফিদা হকের স্বপ্নের চারা আজ আমাদের মধ্যেও মহীরুহের আশা নিয়ে রোপিত হয়েছে। আমরাও স্বপ্ন দেখছি সাজানো গোছানো পরিচ্ছন্ন এক বাংলাদেশের যে দেশের মানুষ ‘পরিবর্তন চাই’ এর শ্লোগান প্রাত্যহিকতায় প্রমাণ করবেন - ‘আমার মাটি, আমার মা - ময়লা হতে দেব না’।
শুভ হোক ‘পরিবর্তন চাই’ এর পথ চলা।
মোঃ আতিকুর রহমান লাবু, রাজশাহী থেকে
|