মারাদোনাঃ মহাজাগলারের মহাপ্রয়াণ আতিকুর রহমান লাবু
পেলেকে ফুটবলের যাদুকর বলে ফেলায় মারাদোনাকে আর সেটা বলা হয়নি। ভালোই হয়েছে। যাদুর মধ্যে কিছুটা ফাঁকির বিষয় থাকে। মারাদোনা ছিলেন অসম্ভব পরিশ্রমী ফুটবল জাগলার, যা যাদুকেও হার মানায়।
১৯৮৬ বিশ্বকাপে আর্জেন্টিনাকে প্রায় একাই শিরোপা জেতানো মারাদোনাকে অনেক বিশেষজ্ঞ, ফুটবল সমালোচক, প্রাক্তন ও বর্তমান খেলোয়াড় এবং ফুটবল সমর্থক সর্বকালের সেরা ফুটবলার হিসেবে গণ্য করেন। তিনি ফিফার বিংশ শতাব্দীর সেরা খেলোয়াড় নির্বাচনে পেলের সাথে যৌথভাবে ছিলেন। ইতালিয়ান ক্লাব নাপোলিকে দুবার সিরি ‘আ’ ও উয়েফা কাপ জিতিয়েছেন মারাদোনা।
চিতরো মারাদোনা এবং দোনা দালমা দম্পতির ঘর আলো করে ১৯৬০ সালের ৩০শে অক্টোবর কোলে আসেন তাদের চতুর্থ সন্তান দিয়েগো আরমান্দো মারাদোনা বা দিয়েগো মারাদোনা । তাঁর জন্ম আর্জেন্টিনার লানুস শহরে তবে বেড়ে ওঠা ভিয়া ফিওরিতোতে। ফুটবলের পরিবেশ ছোটবেলা থেকে পরিবারের মধ্যেই ছিলো। তাঁর ছোট দুই ভাই ছিলেন পেশাদার ফুটবল খেলোয়াড়। আর ঠিক এ কারণেই একদম ছোট বয়স থেকে তাঁর ফুটবল খেলা শুরু।
মারাদোনা একজন আর্জেন্টিনীয় ফুটবলার, ফুটবল কোচ এবং ম্যানেজার ছিলেন। আজ ৬০ বছর বয়সে এই ক্যারিশম্যাটিক ফুটবল ম্যাজিশিয়ানের জীবনাবসান হলো। মারাদোনাই একমাত্র খেলোয়াড় যিনি দুবার ট্রান্সফার ফির ক্ষেত্রে বিশ্বরেকর্ড গড়েছেন। প্রথমবার বার্সেলোনায় ট্রান্সফারের সময় ৫ মিলিয়ন ইউরো এবং দ্বিতীয়বার নাপোলিতে ট্রান্সফারের সময় ৬.৯ মিলিয়ন ইউরো। বার্সায় আসার পরই জ্বলে উঠে দুই সিজনে ৫৮ ম্যাচে ৩৮ গোল করেন তিনি। ১৯৮৩ সালে বার্সার হয়ে কোপা দেল রে এবং স্প্যানিশ সুপার কাপ জয় করেন। মারাদোনা আর্জেন্টিনোস জুনিয়র্স, বোকা জুনিয়র্স, বার্সেলোনা, নাপোলি, সেভিয়া এবং নিওয়েলস ওল্ড বয়েজের হয়ে খেলেছেন। ক্লাব পর্যায়ে তিনি নাপোলিতে কাটানো সময়ের জন্য বিখ্যাত, যেখানে তিনি অসংখ্য সম্মাননা জিতেছেন। নাপোলির ১০ নম্বর জার্সি মানেই তখন সমর্থকদের জন্যে এক উন্মাদনা। এখন পর্যন্ত নাপোলির ইতিহাসে সবচেয়ে সফলতম সময় ছিলো এটি। তাঁর দারুণ ফর্মের কারণে নাপোলি ১৯৮৬-৮৭ ও ১৯৮৯-৯০ মৌসুমে সিরি এ চ্যাম্পিয়নশিপ জিতে নেয়। ১৯৮৬-৮৭ মৌসুমে মারাদোনা টুর্নামেন্টের সর্বোচ্চ গোলদাতা হন। একই সময়ে এই ক্লাবটি ১৯৮৭ সালে কোপা ইতালিয়া, ১৯৮৯ তে উয়েফা কাপ, ১৯৯০ সালে ইতালীয় সুপার কাপ জিতে নেয়। ১৯৯২ সালে মারাদোনা নাপোলি থেকে চলে যান কিন্তু নাপোলি তাঁর সম্মানে ১০ নম্বর জার্সিটি দাপ্তরিক ভাবে তুলে রাখে।
আর্জেন্টিনা জাতীয় ফুটবল দলের হয়ে মারাদোনা টানা চারটি বিশ্বকাপে অংশগ্রহণ করেন। এর মধ্যে ১৯৮৬-তে আর্জেন্টিনা চ্যাম্পিয়ন হয় এবং ১৯৯০-এ হয় রানার-আপ। ১৯৮২ বিশ্বকাপে মারাদোনা দুটি গোল করেন কিন্তু দ্বিতীয় পর্বে আর্জেন্টিনা বিশ্বকাপ থেকে বিদায় নেয়ায় তিনি আশানুরূপ নৈপুণ্য দেখাতে পারেননি।
১৯৮৬ বিশ্বকাপে তিনি আর্জেন্টিনার অধিনায়কের দায়িত্ব পালন করেন এবং দলকে বিশ্বকাপ জয়ে নেতৃত্ব দেন। প্রতিযোগিতার সেরা খেলোয়াড় হিসেবে স্বর্ণ গোলকও জিতেন তিনি। ১৯৮৬ বিশ্বকাপের কোয়ার্টার ফাইনালে ইংল্যান্ডের বিপক্ষে আর্জেন্টিনা ২–১ গোলে জয়লাভ করে। দুটো গোলই করেন মারাদোনা যা ফুটবল ইতিহাসে স্মরণীয় হয়ে আছে দুটি ভিন্ন কারণে। প্রথম গোলটি ছিল হ্যান্ডবল যা “হ্যান্ড অফ গড” নামে খ্যাত। দ্বিতীয় গোলটি মারাদোনা প্রায় ৬০ মিটার দূর থেকে ড্রিবলিং করে পাঁচজন ইংরেজ ডিফেন্ডারকে পাশ কাটিয়ে করেন। ২০০২ সালে ফিফা অনলাইনে ভোটের আয়োজন করলে সারা বিশ্বের ফুটবল-প্রেমীরা এই গোলটিকে শতাব্দীর সেরা গোল হিসেবে নির্বাচিত করেন। তাঁর প্রতি সম্মান জানিয়ে স্তাদিও অ্যাজতেকা কর্তৃপক্ষ স্টেডিয়ামটির সামনে মারাদোনার গোল অফ দ্য সেঞ্চুরির একটি প্রতিমূর্তি নির্মাণ করেছে। ১৯৯০ এর বিশ্বকাপে ইনজুরির কারণে অনেকটাই নিষ্প্রভ ছিলেন মারাদোনা। এই বিশ্বকাপে তিনি রেকর্ড পরিমাণ ৫০টা ফাউলের শিকার হন। এছাড়াও এক ম্যাচে ২৩টি ফাউলের শিকার হওয়ার রেকর্ডও তাঁর।
১৯৯৪ বিশ্বকাপের পর মারাদোনার ১৭ বছরের আন্তর্জাতিক ক্যারিয়ারের ইতি ঘটে। পুরো ক্যারিয়ারে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে আর্জেন্টিনার হয়ে মারাদোনা ৯১ খেলায় ৩৪ গোল করেন। মারাদোনার খাটো হওয়া সত্ত্বেও, দৈহিক দিক থেকে ছিলেন শক্তিশালী। তাঁর ছোট-ছোট পা তাকে দ্রুত দৌড়াতে সহায়তা করতো। সীমিত জায়গার মধ্যে তিনি নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারতেন। তাই ডিফেন্ডারদের পাশ কাটিয়ে লম্বা সময় ধরে বল নিজের নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারতেন। তাঁর আরেকটি জাদুকরী নৈপুণ্য ছিল পায়ের পিছনের অংশ ব্যবহার করে এক ধরনের রিভার্স-ক্রস পাস শট। এছাড়া মারাদোনা ছিলেন একজন বিপজ্জনক ফ্রি কিক গ্রহণকারী।
মারাদোনাকে ক্রীড়া জগতের সবচেয়ে বিতর্কিত এবং সংবাদ হিসেবে উল্লেখযোগ্য ব্যক্তিবর্গের অন্যতম মনে করা হয়। ১৯৯১ সালে ইতালিতে ড্রাগ টেস্টে কোকেইনের জন্য ধরা পড়ায় ১৫ মাসের জন্য নিষিদ্ধ হন তিনি। ১৯৯৪ বিশ্বকাপে ইফিড্রিন টেস্টে ইতিবাচক ফলাফলের জন্য তাকে প্রতিযোগিতা থেকে বাদ দেওয়া হয়। ২০০৫ সালে তিনি কোকেইন নেশা ত্যাগ করেন। তাঁর কড়া কথা মাঝেমাঝে সাংবাদিক এবং ক্রীড়া সংশ্লিষ্টদের সাথে তাঁর মতভেদ সৃষ্টি করে। ২০০৮ সালে তাকে আর্জেন্টিনা জাতীয় দলের কোচের দায়িত্ব দেওয়া হয়। তিনি প্রায় দেড় বছর এই দায়িত্বে ছিলেন।
১৯৮৪ সালের ক্লদিয়া ভিয়াফানিয়ের সাথে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন মারাদোনা। তাদের দুইটি কন্যা সন্তান রয়েছে। ২০১৩ সালে মারাদোনার পুত্র দিয়েগো ফেরন্যান্দো জন্মগ্রহণ করে। ২০০০ সালে মারাদোনা তার আত্মজীবন ‘আমি দিয়েগো’ প্রকাশ করেন যা তার নিজ দেশে তাৎক্ষণিক জনপ্রিয়তা পায়।
ফুটবল যাদুকর পেলের পরেই মারাদোনার স্থান। ২০০০ সালে ফিফার করা “প্লেয়ার অফ দ্যা সেঞ্চুরি”তে ছিলো তার নাম। সে হিসেবে তার ফুটবল ক্যারিয়ার আরো উজ্জ্বল হতে পারত। কিন্তু ড্রাগ আর বিশৃঙ্খল জীবন তাঁকে সমস্ত সম্ভাবনা ও প্রতিভা থাকা সত্বেও আরো বেশী প্রজ্বলিত হতে দেয়নি। তবুও মনে হচ্ছে পৃথিবী হারালো তার শ্রেষ্ঠ ফুটবল প্রতিভা।
মোঃ আতিকুর রহমান লাবু, রাজশাহী থেকে
|