কোভিড-১৯ নিয়ন্ত্রণের অনুকরণীয় উদাহরণ - প্রেক্ষাপট ব্রুনাই ডাঃ নূর রহমান খোকন
সুলতান ওমর আলী সাইফুদ্দিন মসজিদ, ব্রুনাই | দক্ষিণ চীন সাগরের উপকূল ঘিরে অবস্থিত বোর্নিও দ্বীপের একটি অংশের দেশ ব্রুনাই দারুসসালাম। আয়তনের দিক থেকে সিঙ্গাপুরের তুলনায় প্রায় ১০ গুণ বড় হলেও লোক সংখ্যায় মাত্র ৪৩৭,৪০০ জন। তবে দেশের ৬৫-৭০ ভাগ এখনও অব্যবহৃত - জঙ্গলে পূর্ণ; পরিবেশ রক্ষার স্বার্থে দেশের শাসক সে ভাবেই রাখতে চায়। এই দেশের পরিবেশ এবং আর্থ সামাজিক বিষয় নিয়ে চমৎকৃত হওয়ার মতো কিছু তথ্যবহুল একটি লেখা পরে কোন এক সময় লেখার ইচ্ছে আমার আছে।
আজকের লেখার বিষয় সাম্প্রতিক কালে পৃথিবী ব্যাপী ছড়িয়ে পরা প্যান্ডেমিক কোভিড-১৯ মোকাবেলায় ব্রুনাই এর অভাবনীয় সাফল্য। রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ পর্যায়ের অঙ্গিকার আর তার সাথে রাষ্ট্রের সকল পর্যায়ের সমন্বিত প্রচেষ্টার মাধ্যমে যে কঠিন কোন বিষয়ে সফল হওয়া সম্ভব তার এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত ব্রুনাই। এ বিষয়টি অনেকের জন্য শিক্ষণীয় হতে পারে। সে কারণেই আজকের এই লেখা। ৯ মার্চ, ২০২০ ব্রুনাই এ কোভিড -১৯ এর প্রথম রোগী শনাক্ত করা হয়। সংক্রমণ বেড়ে ৭ মে পর্যন্ত মোট রোগীর সংখ্যা দাড়ায় ১৪১ জনে। তবে ৮ মে থেকে ৮জুন পর্যন্ত ৪ সপ্তাহের অধিক সময়ে কোন নূতন রোগী শনাক্ত হয় নাই। সরকারীভাবে ঘোষণা করা হয় যে সে সময়ে শুধু ১জন রোগী চিকিৎসাধীন অবস্থায় ছিল। সর্বমোট রোগীর সংখ্যা ১৪১ জন এবং মোট মৃতের সংখ্যা ২ জন। দেশের জনসংখ্যার তুলনায় বিশ্বের অন্যান্য দেশের আনুপাতিক সংক্রমণ এবং মৃতের সংখ্যা হিসেবে খুব বড় রেকর্ড না হলেও দেশের অর্থনৈতিক, সামাজিক এবং বিশেষত জনসাধারণের মানসিক স্বস্তির জন্য কোভিড -১৯ নিয়ন্ত্রণের ক্ষেত্রে এই উত্তরণ বিশেষ গুরুত্ববহন করে। এই অভাবনীয় ফলাফল পাওয়ার জন্য দেশের সুলতানের বিচক্ষণ দিক নির্দেশনা এবং অঙ্গীকার, বিভিন্ন মন্ত্রণালয় সহ সরকারী দপ্তরগুলির সমন্বিত পরিকল্পনা ও তার নিখুঁত বাস্তবায়ন এবং সর্বোপরি রাষ্ট্রীয় পরিকল্পনাগুলির সাথে জনগণের সর্বাত্মক সম্পৃক্ততা বিশেষ ভাবে লক্ষণীয়।
পৃথিবীর প্রায় সব দেশেই “Infectious Disease Control Act” এবং “Infectious Disease Control Regulations” থাকলেও কোভিড-১৯ নিয়ন্ত্রণের ক্ষেত্রে এগুলির সঠিক সময়ে সঠিকভাবে বাস্তবায়ন অনেক দেশেই দেখা যায় নাই। ব্রুনাই সে দিক থেকে সম্পূর্ণ ব্যতিক্রম। ৬ জানুয়ারি ২০২০ ব্রুনাই এর স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় প্রথম এই বিষয়ে একটি তথ্য বিজ্ঞপ্তি প্রচার শুরু করে। তখন সবেমাত্র চীনের উহান শহরের ৪৪ জন রোগীর নিউমোনিয়া বা শ্বাসকষ্ট সহ ইনফ্লুয়েঞ্জার মতো লক্ষণ এর তথ্য এসেছে। রোগের নাম তখনো ল্যাবরেটরি পরীক্ষার অপেক্ষায়। পরবর্তীতে ৯ মার্চে ব্রুনাই এ প্রথম কোভিড -১৯ রোগী শনাক্ত করা হয়। এই রোগীর সম্ভাব্য সংক্রমণের কারণ হিসেবে দেখা যায় যে ৫৩ বছর বয়স্ক পুরুষ ব্যক্তিটি মালয়েশিয়ার কুয়ালালামপুর এ একটি অনুষ্ঠানে যোগ দিয়ে ছিলেন। অনুসন্ধানে দেখা যায় যে আরো কিছু ব্রুনাইবাসী সেই অনুষ্ঠানে যোগ দিয়েছিলেন এবং তা থেকেই ব্রুনাই এ কোভিড -১৯ এর সূচনা। তখন থেকেই স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় নিয়মিতভাবে পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণসহ প্রয়োজনীয় প্রস্তুতি শুরু করে। এর অংশ হিসেবে প্রয়োজনীয় সকল স্বাস্থ্য সংশ্লিষ্ট সরঞ্জাম সংগ্রহ করা এবং প্রয়োজনীয় আলাদা করণ আর কোয়ারেন্টাইন ব্যবস্থা গড়ে তোলার কাজ করে। দেশকে “Infectious Disease Control Act” এবং “Infectious Disease Control Regulations” এর আওতায় আনা হয়। সেই সাথে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়কে সমন্বয়ক হিসেবে রেখে মাননীয় স্বাস্থ্যমন্ত্রীর নেতৃত্বে সংশ্লিষ্ট অন্য মন্ত্রীদের ঐক্যবদ্ধ কার্যক্রম সহ প্রতিদিন নিয়মিত প্রয়োজনীয় স্বাস্থ্য বিধি প্রেস ব্রিফিং করা হয় এবং তা যথাযথ ভাবে বাস্তবায়ন এবং তদারক করা হয়। বিশ্বের অনেক দেশেই এই সমন্বয়ের অভাব দেখা যাচ্ছে এখনো। এই বিষয়টি বিশেষভাবে একটি লক্ষণীয় ব্যতিক্রম ব্রুনাই এ অন্য অনেক দেশের তুলনায়। আরো কতগুলি লক্ষণীয় বিষয় যেমন: সংক্রমণের শুরুতেই প্রত্যেকটি শনাক্তকৃত রোগীকে বিশেষায়িত হাসপাতালে রেখে উন্নত চিকিৎসার ব্যবস্থা করা, প্রত্যেকটি শনাক্তকৃত রোগীর সম্ভাব্য সংক্রমণের দিন থেকে শুরু করে তার বিচরণ ক্ষেত্রগুলি সহ সংশ্লিষ্ট নূন্যতম সামাজিক মেলামেশা করা সম্ভাব্য প্রত্যেক ব্যক্তিকে নিখুঁতভাবে খুঁজে বের করে বিশেষ ভাবে আলাদা করণ এর ব্যবস্থা করা খুবই গুরুত্বপূর্ণ উদ্যোগ ছিল -এই বিষয় টি অনেক দেশ সঠিক ভাবে অনুসন্ধান করতে ব্যর্থ হয়েছে বা আংশিক ভাবে করেছে। নাগরিকদের দেশত্যাগে কঠোর বিধি নিষেধ আরোপ, বিদেশ থেকে শুধু অতি প্রয়োজনীয় ব্যক্তিদের আগমন নিয়ন্ত্রণ সহ তাদেরকে সরকারী তত্ত্বাবধানে বাধ্যতামূলক আলাদা করণ, বিদেশে থাকা ব্রুনাইবাসীদের বিশেষ ফ্লাইট এ দেশে ফিরিয়ে আনা সহ আলাদা করণ, সকল শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, ক্রীড়া প্রতিষ্ঠান বন্ধ ঘোষণা, রেস্তরাগুলি শুধু হোম ডেলিভারি বা take away এর জন্য খুলে রাখা সহ সংশ্লিষ্ট প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা করা। তবে অনেক দেশের মতো শুধু ঘোষণায় সীমাবদ্ধ না থেকে প্রত্যেকটি বিষয় সঠিক বাস্তবায়ন বিশেষভাবে চোখে পড়ার মতো। অর্থনৈতিকভাবে যথেষ্ট উন্নত হওয়ার পরও সরকারের কোভিড -১৯ফান্ডে সকল পর্যায় থেকে অর্থ দান করা। সেই ফান্ড সহ সরকারের প্রণোদনা ফান্ড যোগ করে তার সঠিক বিতরণ প্রশংসার দাবী রাখে।
সব কিছুর মুলে হলো অভিজ্ঞতা সম্পন্ন নেতৃত্ব, সরকারী এবং বেসরকারি সকল প্রতিষ্ঠানের যথাযথ সমন্বয় আর রাষ্ট্রের শাসকের প্রতি জন সাধারণের নির্ভেজাল আস্থা। আমরা অনেক গণতান্ত্রিক দেশেও দেখছি মূলত দেশ শাসন কেন্দ্রীভূত ব্যক্তি বা গোষ্ঠীর কাছে। মন্ত্রী, সচিব, মহা পরিচালক, পরিচালক বা প্রতিষ্ঠান প্রধানের নিয়োগের ক্ষেত্রে পরীক্ষিত অভিজ্ঞতা বিবেচনায় না নিয়ে শুধু জ্যৈষ্ঠতা বা রাজনৈতিক ভূমিকাকে প্রাধান্য দিয়ে নিয়োগ দিলে যা হয় তার অনেক উদাহরণ আমরা দেখলাম বিভিন্ন দেশে। দেশ যখন স্বাভাবিক অবস্থায় চলে তখন মনে হবে সব ঠিকঠাক। গোলমালটা হয় যখন দেশে জরুরী কোনো অবস্থার সৃষ্টি হয়। ব্রুনাই এ মন্ত্রী, সচিব, মহা পরিচালক, পরিচালক বা প্রতিষ্ঠান প্রধানের নিয়োগের ক্ষেত্রে শিক্ষাগত যোগ্যতার পাশাপাশি সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির বিষয় ভিত্তিক অভিজ্ঞতা অত্যন্ত গুরুত্বের সাথে বিবেচনা করা হয়। উদাহরণ হিসেবে বলা যায় ব্রুনাই এর বর্তমান মাননীয় অর্থ মন্ত্রী। পূর্ণ মন্ত্রী হিসেবে নিয়োগ পাওয়ার আগে উপ মন্ত্রী হিসেবে ছিলেন ৫ বছরের অধিক সময়। ফিনান্স এন্ড একাউন্টিং এ পিএইচডি এবং সিপিএ ডিগ্রিধারী এই মন্ত্রী বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের সিইও হিসেবে সাফল্যের দৃষ্টান্ত রেখেছেন অনেক বছর। বর্তমান মাননীয় স্বাস্থ্যমন্ত্রী নিজে একজন ওপেন হার্ট সার্জন, ব্রুনাই এর সরকারী অর্থে গড়া অত্যাধুনিক প্রাইভেট হাসপাতাল এবং ক্যান্সার সেন্টারের সিইও হিসেবে নিযুক্ত ছিলেন দীর্ঘদিন। মন্ত্রী হওয়ার পরেও সপ্তাহে একদিন সার্জারি করেন। দুজন ই প্রাতিষ্ঠানিক ব্যবস্থাপনায় পরীক্ষিত নেতা। ব্রুনাই এ একটি সরকারী প্রতিষ্ঠানের সিইও হিসেবে কাজ করার সুবাদে অন্যান্য মন্ত্রী সহ এই দুই মন্ত্রীর সাথে এবং অন্য প্রতিষ্ঠান প্রধানদের সাথে সরাসরি কাজ করার ৫ বছরের অভিজ্ঞতা থেকে বলতে পারি তাদের কর্মদক্ষতা, বিষয় ভিত্তিক জ্ঞান এবং প্রতিষ্ঠান পরিচালনায় নেতৃত্বের গুণাবলী শিক্ষণীয় এবং অনুকরণীয়। শুধু প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা আর নেতৃত্বের গুণাবলী নয় ব্যক্তি হিসেবে তাঁরা অস্বাভাবিক রকমের ভালো মানুষ। ক্ষমতার শীর্ষে থেকেও যে সাধারণ মানুষের খুব কাছে এসে কাজ করা যায় তার উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। ক্ষমতার দাপট নয়,সাধারণ মানুষকে তুচ্ছ তাচ্ছিল্য করে দেখা নয় বরং মানুষের খুব কাছে এসে সেবা করার দৃষ্টান্ত মূলক উদাহরণ তাঁরা। ব্রুনাই এর অধিকাংশ মানুষই বিশ্বের অনেক দেশের তুলনায় অতিমাত্রায় সজ্জন- এই বিষয়টি এদেশে আসা সবাই অকপটে স্বীকার করে। ব্রুনাই এর মানুষদের আচার আচরণ নিয়ে বেশ চমকপ্রদ অনেক দীর্ঘ কাহিনী লেখা যেতে পারে। সেটিও কোনো এক সময় হয়তো লিখবো। তবে যে কারণে আজকের এই লেখা তার প্রতিপাদ্য হলো ঘটনা ঘটার আগের প্রস্তুতি আর সংশ্লিষ্ট বিষয় ভিত্তিক হাতেকলমে প্রশিক্ষণ সহ অভিজ্ঞতা সম্পন্ন সঠিক লোক নিয়োগ খুবই জরুরী। বিশ্বের অনেক দেশই তা টের পাচ্ছে, তবে একটু বেশী দেরি হয়ে গেছে। যার কুফল ভোগ করছে সে দেশের জনগণ।
Dr Nur Rahman Khokon CEO, Ghanim International Corporation (Brunei Halal Foods), Brunei Email: rahmannur@hotmail.com
|