স্তব্ধ প্রহর কাজী লাবণ্য
আমার কাছে ট্রেন জার্নির চেয়ে আরামদায়ক ও আনন্দদায়ক আর কিছু মনে হয়না। দেশের ট্রেন ব্যবস্থা এখন আগের চেয়ে অনেক উন্নত। সাদা কোচের ট্রেনগুলি আমার ভীষণ পছন্দের। এখন আবার চালু হয়েছে লাল সবুজ কিছু ট্রেন যেমন- সোনার বাংলা। মাঝে মাঝে ইচ্ছে করে কোন গন্তব্যের উদ্দেশে নয় কেবল ট্রেনে ট্রেনে ঘুরে বেড়াই দিবস রজনী। আচ্ছা পুরো একটি ট্রেনে কত মানুষ থাকে! ছোট্ট একটি পাড়ার জনবসতির মত মনে হয় এক একটি ট্রেন। ট্রেনটি একটি পাড়াকে পেটের ভেতরে নিয়ে মাঠ ঘাট গ্রাম নদী পেরিয়ে দুরন্ত ছুটে চলে ঝিকঝিক... ঝিক... ঝিক...।
কিন্তু ঢাকা রংপুর তেমন কোন মানসম্মত ট্রেন না থাকায় এবং সময় বাঁচাতে আমি মাঝে মাঝে আকাশপথে ভ্রমণ করি। আজকাল ঢাকা সৈয়দপুর রুটে অনেক গুলো প্লেন যাতায়াত করে। ভাড়াও মোটামুটি নাগালের মধ্যে। কিন্তু উইকএন্ড বা ঈদ এলেই ভাড়া বেড়ে ৩/৪ গুন হয়ে যায়। যেটা একেবারে ঠিক নয়। বিশেষ অবস্থায়, বিশেষ মৌসুমে ভাড়া বাড়তেই পারে তাই বলে এত বেশি! আর প্রতি উইকেন্ডে ভাড়া বাড়ে এটা কি ধরনের কথা!
রংপুর থেকে ঢাকা আসব। সৈয়দপুর এয়ারপোর্টে এসে শুনি প্লেন লেট। ঢাকায় ঝড়বৃষ্টি হওয়াতে প্লেন উড়তে পারেনি। লাগেজ দিয়ে আমি চারপাশে হাঁটাহাঁটি করতে লাগলাম। পারতপক্ষে আমি একা জার্নি করিনা। কারণ আমার ফোবিয়া আছে। Tachophobia বা গতির ভয়। সাধারণত ভয় দু'শ্রেণীর। কারণজাত এবং কারণহীন। অনেক ভয় প্রকৃত ও বাস্তব কারণ থেকে জন্মায়। আবার অনেক ভয় মিথ্যা বা অবাস্তব কোন ধারণা বা বিশ্বাস থেকে সৃষ্ট হয়ে থাকে। এগুলোকে অবাস্তব ভয় বা ফোবিয়া বলে। ফোবিয়া বা অস্বাভাবিক ভীতি এক ধরনের মনোরোগ। মানুষের অনেক ধরনের ফোবিয়া থাকে যেমন- আঁধারের ভয়, গাড়িতে চড়ার ভয়, উচ্চতার ভয়, একা থাকার ভয়, মাকড়শার ভয়, কোলাহলের ভয় ইত্যাদি।
নিজে আমি আমি গতি পছন্দ করি। গতির মধ্যেই থাকার প্রাণান্ত চেষ্টা করি কিন্তু ভাগ্যের কঠিন পরিহাস এই যে আমিই গতি ফোবিয়ায় আক্রান্ত। পার্সোনাল ট্রান্সপোর্ট ছাড়া যে ভেহিকলেই উঠিনা কেন আমি প্যানিকি হয়ে যাই। নিজে সব বুঝলেও সে সময় আত্মনিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলি। আমার হাজবেন্ড আমাকে নিয়ে ভীষণ দুশ্চিন্তা করে। কোনসময় একা জার্নি করতে দেয়না। কিন্তু সবসময় কি আর কাউকে সাথে পাওয়া যায়! প্রায় সময় আমি আমার ছেলে, ছেলের বাবা, কিংবা আমার ভাই বা বোনের সাথে শিডিউল মিলিয়ে যাতায়াত করি। কিন্তু আজ আমি একা। হাজবেন্ড এর কোন ছুটি নেই, ছেলের আসার কথা ছিল কোচিং থাকাতে আসতে পারেনি তবে তারা উৎকণ্ঠিত আমার জন্য। রংপুরে এসেছিলাম অসুস্থ মাকে দেখতে।
ডাঃ এর পরামর্শে ফোবিয়ার কারণে জার্নির আগে আমাকে একটি ট্যাবলেট খেতে হয়। তাতে সমস্যা কাটে কিন্তু ঘুম পেয়ে যায়। যেহেতু ট্যাবলেট খেয়েছি তাই আমি কোথাও না বসে চকোলেট মুখে দিয়ে হাঁটছি আর বারবার গ্লাসের কাছে গিয়ে দাঁড়িয়ে দেখছি প্লেন এলো কিনা!
অবশেষে ঘন্টাখানিক পরে প্লেন এলো। এই ডোমেস্টিক প্লেনগুলি খুব ছোট ছোট। যেন বড় সাইজের গঙ্গাফড়িং বা খেলনা প্লেনও মনে হয়। তবে ‘কবিতার জন্য সারা পৃথিবী’তে সুনীল যে প্লেনের বর্ণনা দিয়েছেন পাশাপাশি লম্বা দুটি বেঞ্চ, প্লেনটি উপরে উঠলে বা নিম্নমুখী হলে যাত্রীরা ঢলে পড়ত এ ওর গায়ে তেমন অবশ্যই নয়। যেমনই হোক আমাদের এতদাঞ্চলের মানুষের জন্য খুব সুবিধা হয়েছে। সপ্তাহের ৭দিনই দিনে কয়েকটি ফ্লাইট থাকে। উঠে পড়লাম। আশ্চর্য আমার সিট পড়েছে জানালার পাশে। মনটা ঝলমলে হয়ে উঠল। আমার হ্যান্ড লাগেজটি উপরের র্যােকে তুলে দিলাম। হাতে খুব ছোট্ট একটি পার্স আর বইটি আমার কাছে রইল। মাত্র ৪৫/৫০ মিনিটের জার্নি কিন্তু অভ্যাসবশত একটি বই হাতে থাকেই। দু’পাতা হলেও পড়ি। কানে হেডফোন। হাতে বই। মুখে চকোলেট। দৃষ্টিতে দূর দিগন্ত। মনে হতে পারে এত আয়োজন! তা নয় এসব কিছুটা অভ্যাসের কারণে আর বাকিটা ফোবিয়া তাড়িয়ে ইজি হবার জন্য। সিটে বসেই আমি পার্স থেকে চশমা বের করে চোখে দিলাম, মুখে আরেকটি চকোলেট পুরলাম, খুব প্রিয় গান সিলেক্ট করে হেডফোন কানে ভালভাবে গুজে দিলাম। দুর্দান্ত একটি বই বা মিউজিকে ডুবে গেলে সাধারণত আমি আর কিছু টের পাইনা। প্লেন টেক অফ করল। নির্বিঘ্নে কয়েক মিনিট গেল। প্রথম কয়েক মিনিট পার করতে পারলে আর কোন সমস্যা আমার হয়না। এতক্ষণে আমি খেয়াল করলাম যে আমার পাশের সিট ফাঁকা। বাহ বেশ মজা লাগল। হাতের বইটি আমি সেখানে রাখলাম। প্লেনের ভেতরে একবার চোখ বুলিয়ে নিলাম। সাকুল্যে মাত্র কজন যাত্রী। দুতিন সারি সামনে কে একজন চেনা চেনা লাগছে, ভাল করে তাকিয়ে দেখি আরে! বাকের ভাই খ্যাত বিখ্যাত অভিনেতা এবং আবৃতিকার আসাদুজ্জামান নূর বসে আছেন। ইনি বর্তমানে একজন মন্ত্রী। যাকবাবা! ভালো হয়েছে, মন্ত্রী ফন্ত্রী থাকলে সব জায়গায় কর্তৃপক্ষ সচেতন ও যত্নবান থাকে। এবার জানালা দিয়ে বাইরে তাকালাম। এতক্ষণে লম্বা শ্বাস নিয়ে আমি ইজি হলাম। এখন আমার বেশ ভালো লাগছে। বাইরে মেঘের পরে মেঘ জমেছে। পেঁজা পেঁজা তুলো তুলো। দেখে মনে হয় ওখানে নেমে অনায়াসেই ওর উপর দিয়ে আলতো পায়ে হেঁটে বেড়াতে পারব। কানে শ্রীকান্ত- ““মেঘ হলে মন বিকেলবেলা একলা যেতাম মেঘের বাড়ী মেঘ হতো কাশ ফুলের দু'চোখ বৃষ্টি কিন্তু খুব আনাড়ি। কিন্তু মনে মেঘ থাকে না মেঘ ছাড়া আকাশ খালি বোতাম খোলা জানালা বুকে বইছে হাওয়া শুধু শূন্য তার-ই মন খারাপের মেঘের গাঁয়ে আঁকছে আকাশ একলা ছবি মেঘ হলে মন দুপুর বেলা একলা যেতাম মেঘের বাড়ি... বৃষ্টি কিন্তু খুব আনাড়ি আনাড়ি...”“ আমারও ভীষণ মেঘের বাড়ি যেতে ইচ্ছে করল...
মেঘের স্তূপে চোখ রেখেই বাম হাত বাড়িয়ে বইটি হাতে নিলাম একটু চোখ বুলাব বলে-
- ‘জন স্টেইনবেক আপনার প্রিয় রাইটার’? ভেসে আসা প্রশ্নে শুনে ঘাড় ঘুড়িয়ে তাকিয়ে দেখি আমার সিটের একদম সমান্তরাল ওপাশের একক সিটের এক যুবকের এই অনাবশ্যক কৌতূহল।
- হু... সামান্য মাথা নেড়ে আমি উত্তর দিলাম কি দিলামনা।
বই পড়ছি। খুব যে মন লাগিয়ে তা না, বাইরের অপার্থিব দৃশ্যের হাতছানি, মেঘের ফাঁক ফোঁকর গলিয়ে ঝলমলে সূর্য কিরণ কী অপূর্ব খেলাই না খেলছে...
পড়ায় মন লাগছে না বলে আবার বইটি মুড়ে পাশে রেখে দিলাম।
-‘আপনি কি চাকরি করেন? মানে আপনি কি কোন স্কুল কলেজে পড়ান’? পুনরায় সেই কৌতূহল। চোখ তুলে তাকালাম। অচেনা যুবক তাকিয়ে আছে আমার দিকে এক দৃষ্টিতে... বিরক্তি নাকি বিবমিষা কি যেন ছুঁয়ে দিয়ে মিলিয়ে গেল ঐ দূর মেঘের বাড়ি...
- না, আমি কোথাও পড়াই না। নিরুত্তাপ উত্তর দিয়েই আমি আবার বাইরের দিকে তাকালাম। তার আগেই আবার
- ‘আচ্ছা আপনার বাড়ি কি রংপুরে’?
কানে তুলো গুজে, চোয়াল শক্ত করে তাকিয়ে দেখি আকাশ বদলে যাচ্ছে। দ্রুত। এখন আকাশে অনেক কালিমেঘ এবং তা জলভরা। দেখতে খুব ভালো লাগছে। কবি হলে এ নিয়ে একটা জম্পেশ কবিতা লেখা যেত। শ্রীকান্ত তখন সারাটাদিন মেঘলা আকাশ উদারভাবে কাকে যেন দিয়ে যাচ্ছে... আহা! কী সুর! কী কথা! গান, বাইরের অপরূপ পরিবর্তনশীল চলমান দৃশ্য, বাসায় অপেক্ষমাণ আমার ভালোবাসার স্বামী, পুত্র, নিটোল সংসার সবকিছু আমার মনোযোগ আকর্ষণ করে রেখেছে কিন্তু তারপরও মনের মাঝে কি যেন খটকা! কোথায় যেন টিকটিক! কি সেটা! যুবকের দৃষ্টি! সেটি কেমন যেন! এবারে ইচ্ছে করে ঘাড় ঘুড়িয়ে তাকিয়ে দেখি সে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে আমার মুখের দিকে। আরে যন্ত্রণা! আমার তাকানো দেখে সে যে অপ্রস্তুত হয়ে চোখ সরিয়ে নেবে তাওনা। কেমন এক ঘোর লাগা দৃষ্টি! উদভ্রান্ত! এ কেমন ত্যাঁদড় রে বাবা! এমন যুবকদের দৃষ্টি আকর্ষণের বয়স বেশ আগেই ফেলে এসেছি। যদিও মাঝে মাঝে আমার বয়স অবস্থান নিয়ে অনেকেই ভুল করে। সে ভুল স্বামী বা বন্ধুদের সাথে যখন থাকি তখন বেশ এঞ্জয় করি। বন্ধুরাও নানা ধরনের ফাজলামি করে। তাই বলে একা একা এই শূন্যে ভেসে ভেসে এসব কি ভাল্লাগে! ধুর, যত্তসব। খুব স্বাভাবিক ভাবেই আমরা যুগ যুগ ধরে এসব অহেতুক যন্ত্রণার শিকার হতে হতে এখন সবাই খুব সাবধানী। এভাবেই আমাদেরকে শেখানো হয়। মনের অগোচরেই আমরা অচেনা পুরুষ সে যে বয়সেরই হোক তাদের সাথে ফিজিক্যালি, মেন্টালি নিরাপদ দূরত্ব মেইনটেইন করি। এটা আমাদের অভ্যাস। এটা আমাদের কালচার। এটাই আমাদের সামাজিক প্রথা।
গঙ্গা ফড়িং মধ্য পথে মধ্য আকাশে। প্রায় এসেই পড়েছি। হঠাত করে বাম্পিং শুরু হল। বেশ ভালো রকম। একবার বামে তো একবার ডানে কাত হচ্ছে। উপরে উঠছে আবার নিচে নামছে। যাত্রীরা প্রথমে আস্তে পরে জোরে জোরে দোয়া কালাম পড়া শুরু করল। এবারে আমার তো হয়ে গেল! ভয় পেলে আমি স্টিফ হয়ে যাই। তখন আমার কোন প্রস্তুতি আর কাজ করেনা। চশমা, হেডফোন, বই-টই সব কোথায় ছুঁড়ে রাখলাম। খুলে রাখা সিটবেল্ট আবার ত্বরিত কাঁপা হাতে বেঁধে নিলাম। তারপরও একবার সামনের সিট, একবার নিজের সিটের হ্যান্ডেল ধরে নিজেকে ঠিক রাখার চেষ্টা করছি। মনে মনে ভাবছি বিরাট ভুল করেছি। ছেলেকে সাথে না এনে বিরাট বোকামি করে ফেলেছি। মনে মনে দোয়া পড়ছি। সারা শরীর কাঁপছে... ঘামছে... ভয় পেলে আমার বমি লাগে এখন বমিও পাচ্ছে... আর বুঝি আমার প্রিয় সংসারে ফেরা হয়না! আমার প্রাণপ্রিয় স্বামী কলিজার টুকরা পুত্র এদের সাথে আর বুঝি দেখা হয়না! হে আল্লাহ এবারে তড়ায়ে নাও আর প্লেনে উঠব না...কোনদিন না...আমি মরে গেলে আমার ছেলেটার কি হবে! ও কিভাবে বাঁচবে খোদা ... রক্ষা কর প্রভু... রক্ষা কর। আকাশ পথে জার্নির কি যেন একটা দোয়া আছে, উফ! কিছুতেই মনে পড়ছেনা। ওহ গড প্লিজ প্লিজ প্লিজ! ওহ! মাগো...
- ‘ভয় পাবেন না। ভয়ের কিছু নেই। এখুনি সব থেমে যাবে। এক্সপার্ট পাইলট খুব ভালোভাবেই প্লেন ল্যান্ড করাবে। আমাদের নামারও সময় হয়ে এসেছে’।
খুব শান্ত আত্মবিশ্বাসী কণ্ঠ। আমি মাথা ঘুরিয়ে দেখি আমার পাশের সিটে ওই অচেনা যুবক। ওর অভয়বাণী শুনে একটু অন্যমনস্ক হওয়াতে আমার বুকের ধড়ফড়ানি কমল। কিন্তু হাত পা মনে হয় অসাড় হয়ে গেছে, শক্তি পাচ্ছিনা। কোথায় ব্যাগ, চশমা, বই, কোথায় হেডফোন, কোথায় প্লেনের দেয়া খাবার! সামনের পকেট থেকে জলের বোতল খুলে সে আমার হাতে দিয়ে বলল ‘একটু খেয়ে নিন ভাল লাগবে’। পুতুলের মত আমি তাই করলাম। সে আমার সব কিছু গুছিয়ে হাতে তুলে নিল। আমি শুধু তাকিয়ে দেখলাম। যা করছে করুক। আমার আর ভাল্লাগছে না। নামতে পারলে বাঁচি। প্লেনের ভেতরটা ততক্ষণে ক্রন্দনালয় এবং উপাসনালয়ে পরিণত হয়েছে।
অবশেষে প্লেন নিরাপদে ল্যান্ড করলে সে বসেই রইল। মৃদু কণ্ঠে বলল- ‘একটু বসুন, সবাই আগে নেমে যাক’...
নামার সময় সে আমার উপরের ব্যাগটি নামাল, আমার হাতের পার্স বই-টই সব নিয়ে এক পাশে সরে দাঁড়িয়ে হাত সামনে মেলে দিয়ে বলল- চলুন... যেন সে আমার গার্জিয়ান! যেন আমাকে টেক কেয়ারের দায়িত্ব তার।
নেমে এলাম। আহ! শান্তি! বেঁচে থাকা কী আনন্দের! আমি ব্যাগের জন্য হাত বাড়ালাম, সে কেবল আমার পার্সটি দিল আর বলল- ‘সামনে চলুন এগুলো দিচ্ছি’। আর কোন ভয় নেই পায়ের নিচে মাটি পেয়ে আমি আবার সমে ফিরেছি। স্মার্টলি হাঁটছি। চারিদিকে তাকাচ্ছি। কে বলবে একটু আগে ভয়ে আতংকে কুঁকড়ে গিয়েছিলাম।
আমরা লাগেজের কাছে এলাম। বেল্ট ঘুরছে। সে আমার কাছে দাঁড়ানো। অপেক্ষা করছি। ওর লাগেজ আগে এলো সে সেটি তুলে নিয়ে নিজের পাশে রাখল। আমার দিকে নজর রাখছে বোঝার চেষ্টা করছে কোন লাগেজটি আমার! লাগেজ এলে আমি ঝুঁকে নিতে যাবার আগেই সে সেটা তুলে নিল। দুহাতে ট্রলি ঠেলতে ঠেলতে আমাকে বলল চলুন-
আমি এর মধ্যে ড্রাইভারকে ফোন করে ওর অবস্থান জেনে নিলাম। বাইরে এসে একটু সরে গিয়ে আমরা দাঁড়ালাম। লাইন ধরে গাড়ি যাচ্ছে। লাইনের পেছনে আমার গাড়ি দেখা যাচ্ছে। সামনের কয়েকটি গাড়ি গেলেই আমারটা আসবে। ছেলেটি ছোট ব্যাগ, বই, জলের বোতল, হেডফোন সব আমার হাতে দিল। বড় লাগেজটি আমার পাশে দাঁড় করিয়ে রাখল। আমার মুখের দিকে তাকিয়ে মৃদু কিন্তু স্পষ্ট করে বলল-
- ‘আমার দাদাবাড়ি রংপুর শহরে। আমরা ঢাকায় থাকি। এখানে আমি বুয়েটে পড়ি। রংপুর গিয়েছিলাম একটা কাজে। কদিন দিন আগে আমার মা মারা গেছেন, তার সব কাজ শেষ করে এই ফিরছি। আপনি দেখতে অবিকল আমার মায়ের মত, এমনকি আপনার চোখের নিচের তিলটি পর্যন্ত। কি করে এমনটা সম্ভব আমি জানিনা। আমার মা পড়াতেন, তিনি কলেজ টিচার ছিলেন। আপনাকে মনে হয় আমার স্যরি বলা উচিত’... বলতে বলতে ছেলেটির গলা ধরে এলো চোখ জলে ভরে এলো। কিন্তু সে চোখের জল কাউকে দেখাবে না, অভিমানী মুখ ঘুড়িয়ে নিল। অশ্রু শুকানোর জন্য পলক না ফেলে দূরে তাকিয়ে রইল। আমার গাড়িও সামনে চলে এসেছে, ড্রাইভার নেমে এসে হাতের ব্যাগ লাগেজ সব গাড়িতে তুলে ফেলেছে। সে আর কোন কথা না বলে হাঁটতে শুরু করল... আরে! এ্যাই! এ্যাই ছেলে! যেওনা! তুমি আমাকে এমন অবস্থায় ফেলে যেতে পারনা শোন...। যুবক কোথায়! এতো একটি তরুণ! তরুণের আদ্র চোখ বেদনার্ত মুখ! ঠিক এমন একজন তরুণ কিশোরকে আমি বাসায় রেখে এসেছি। আমার মাতৃস্বত্বা হাহাকার করে উঠল! ফুঁসে উঠছে মাতৃত্বের নদী, আঘাত হানছে অচেনা অপরিচিতির সামাজিক প্রথার দেয়ালে। আমি ব্যাকুল হয়ে উঠলাম- চিৎকার করে ওকে ডাকলাম! বার বার ডাকলাম! কিন্তু সবই মনে মনে। এই স্তব্ধ প্রহরে আমার ভাষারা চলৎশক্তি হারিয়ে ফেলল। কথারা শব্দ হলনা। কোন আওয়াজ ফুটল না।
পেছনের গাড়ি হর্ন দিচ্ছে। ড্রাইভার আমাকে তাগিদ দিচ্ছে গাড়িতে উঠার জন্য। ক্রমশ অপস্রিয়মাণ মা হারা তরুণের পিঠে চোখ রেখে পা বাড়িয়েছি- পেছন থেকে এক ভদ্রলোক পাশে এসে দাঁড়ালেন বললেন- ‘আপনি কিছু মনে করবেন না। ও যা বলেছে একদম ঠিক বলেছে, আমি ওর বাবা। আপনি দেখতে হুবহু ওর মায়ের মত। ছেলেটা নিজেকে সামলাতে পারছেনা। আমাদের ওই একটিই ছেলে। দুজনের এতটা মিল কি করে, কিভাবে’... তিনি বিড় বিড় করতে লাগলেন আর তার দুচোখে জলের ধারা নেমে এলো। ছেলের মত তিনি চোখের জল চোখেই না রেখে ঝরতে দিলেন।
গাড়ির হর্ন বিকট লাগছে... ড্রাইভারের তাগিদ অসহনীয়... চারিদিকে এত কোলাহল... সদ্য মৃতা একজন মা... মা হারা একটি কিশোর...
আমার মুঠোতে ধরা ফোন বেজে উঠল একবার, দুবার আমি যেন হতবিহবল, বধির। সম্বিত পেয়ে তাকিয়ে দেখি স্ক্রিনে- আমার ছেলে...ব্যাকুল ফোন করছে মাকে...
কাজী লাবণ্য, ঢাকা থেকে
|