পারমিতা / কাজী লাবণ্য
আগের অংশ
বিস্ময়কর ওর চোখ দুটি। আমি তো গল্প কবিতায় পড়েছি- মেয়েদের চোখ সুন্দর হয়, অপূর্ব হয়, মেয়েদের চোখ নিয়ে কত বন্দনা, কত কিছু। কিন্তু পুরুষের চোখও এমন হয় বুঝি! পুরু লেন্সের ওপারে- কী বড় বড় বুদ্ধিদীপ্ত দুটি চোখ! চোখের জমিনটা এত সাদা! এত স্বপ্নময়! আর এত গভীর! মাঝে মাঝেই আমি ওকে বলি- -এ্যাই তোমার চশমাটা খোলতো সঙ্গে সঙ্গে সে একটা ভুবন ভোলানো হাসি দিয়ে চশমাটা হাতে নিয়ে বলে-
-কি, খুশি!
আমি বলি-
-কাছে এসো, আরো কাছে
ও মাথাটা আমার মুখের কাছে এগিয়ে নিয়ে এলে, আমি ওর অপূর্ব চোখের পাতায় আলতো করে আমার ঠোঁট ছুইয়ে দেই... আমি এখন একটাই স্বপ্ন দেখি, বুকের খুব গভীরে- যদি কোন দিন সেই কবির চোখে স্বপ্ন আঁকতে পারতাম! যদি কোনদিন তার কাব্য স্পর্শ করতে পারতাম, যদি কোনদিন ...
হাঁটতে হাঁটতে একেবারে আমার মেসের কাছাকাছি যখন এলাম - একটি গাড়ির পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় গাড়ির গ্লাস নেমে গেল, একজন যুবক মুখ বের করে বলল- -এ্যাই শোন, তুমি অমুক ডিপার্টমেন্টের না? আমি উপর নিচ ঘাড় নেড়ে হ্যাঁ জানালাম। এরপর সে কচ্ছপের মত গলাটা আরো বাড়িয়ে খুব আগ্রহ নিয়ে বলল- -তুমি কোথায় যাবে? আমার হাতে কিছুটা সময় আছে, চল তোমাকে নামিয়ে দেই... অন্য সময় হলে ভয়ে আমি কি করতাম জানিনা। কিন্তু এখন কেন যেন আমার একটুও ভয় করল না। বরং মনে হল, মাত্র ৮০০ টাকায় সব কিছু কিভাবে যেন এখন আমার নিয়ন্ত্রণে। আমি স্থির হয়ে, গাড়ির পাশে দাঁড়িয়ে, স্মিত হেসে, অচেনা ভঙ্গিমায়, অদ্ভুত স্বরে বললাম- -নো থ্যাংকস, আমি কোথাও যাবনা। সে হয়তো চিন্তাও করেনি অতি সাধারণ, অখ্যাত একটি মেয়ে, তার মত গাড়ি ওয়ালাকে প্রত্যাখ্যান করতে পারে!
কচ্ছপের বিস্মিত মুখ, তাচ্ছিল্য ভরে পেছনে ফেলে আমি রাজহংসীর মত এগিয়ে গেলাম।
সিঁড়ির গোড়ায় এসে রেলিং এ হাত রেখে, উপর দিকে তাকালাম- মনে হল এই সিঁড়ি একটি একটি করে আমাকে উপরে উঠতে হবে! ৮০০ টাকার সলতে জ্বলে জ্বলে ফুঁড়িয়ে এসেছে, এখন নিভু নিভু। একটু আগের আমার আত্মবিশ্বাস, সব কিছুর উপর সাময়িক নিয়ন্ত্রণ, সাময়িক দৃঢ়তা, সব ফুস!
আমার আবার সব কিছু মনে পড়ে গেল। বাড়ির কথা, বাবা-মা, বিশেষ করে আদরের ছোট ভাইটির কথা। ৭ দিন আগে মায়ের একটি চিঠি পেয়েছি, মা লিখেছে- ছোট ভাইটি পুরোপুরি ড্রাগ এডিক্টেড হয়ে পড়েছে। নেশায় বুঁদ হয়ে যেখানে সেখানে পরে থাকে। ওকে সামলাতে গিয়ে, সুস্থ করতে গিয়ে বাবাও নাকি বিপর্যস্ত, অসুস্থ। মা একেবারে ভেঙ্গে পড়েছে।
ছোট ভাইটি মেধাবী ছাত্র ছিল। এস এস সি, এইচ এস সি দুটোতেই খুব ভাল রেজাল্ট করেছিল। ডাক্তারি পড়ার ইচ্ছায়, সে অনেক টাকা খরচ করে নামকরা কোচিং সেন্টারে ভর্তি হয়ে, অমানুষিক পরিশ্রম করেছিল। কিন্তু দু দুবার এ্যাডমিশন টেস্ট দিয়েও সে চান্স পায়নি। দুবারই কোশ্চেন পেপার আউট হয়েছিল। ওর চেয়ে যারা খারাপ স্টুডেন্ট ছিল, তারা চান্স পেয়েছে, প্রচুর টাকায় ফাঁস হওয়া কোশ্চেন পেপার কিনে নিয়ে। দুঃখ, কষ্ট, হতাশায় সে অবশেষে এই পথ ধরেছে। চিঠি পাওয়ার পর গত ৭ দিন ধরে আমি, বলা চলে - খাইনি, নাইনি, ক্লাস করিনি কিচ্ছু করিনি। আজই প্রথম উঠেছি। আমার ছোট্ট পৃথিবীটা লন্ড ভন্ড হয়ে গেছে। আমার জগত এলোমেলো হয়ে গেছে। আমি কোন কিছুই চিন্তা করতে পারছি না।
আমাদের ছোট সংসারে বাবা-মা, দুটি ভাই-বোন মিলে আমরা বেশ ছিলাম। অভাব উকি ঝুঁকি মারত, কিন্তু দুটি ছেলে মেয়েই মেধাবী ও স্বভাবে শান্ত হওয়াতে বাবা-মা অমানুষিক পরিশ্রম, ও কষ্ট করেও শান্তিতে ছিলেন। তাদের বিশ্বাস ছিল, ছেলে মেয়ে একদিন বড় হবে, অনেক বড়-- যত বড় হলে ‘দুধভাত’ খাওয়া যায়।
ঘোরের মধ্যেই এক সময় রুমের দরজায় পৌঁছে গেলাম। দরজায় দাঁড়িয়ে দেখি, ৭ দিন আগের ডাকে পাওয়া, বালিশের নিচে থাকা, আমার মায়ের চিঠিটি হাতে নিয়ে স্থির হয়ে দোলন বসে আছে। হঠাৎ আমার দিকে মুখ তুলে তাকাতেই ওর চোখ বিস্ফারিত, মুখ হা হয়ে গেল। আমি জানি, দোলন এখন কি করবে, সে এখন পরম মমতায় আমাকে জড়িয়ে ধরবে। আমি জানি, এই প্রথম আমি ওর কাঁধে মাথা রেখে- ৮০০ টাকা পূর্বের আমি, বাবা-মায়ের আদরের আমি, ছোট ভাইটির ভরসার আমি, মফস্বলের স্বপ্ন দেখা- ভীতু মেয়ে আমি, পারমিতা - আকুল হয়ে কাঁদতে থাকব...
আগের অংশ
কাজী লাবণ্য, ঢাকা থেকে
|