পারমিতা কাজী লাবণ্য
আমি ওর কথার কোন উত্তর না দিয়ে মুগ্ধ দৃষ্টিতে অপলক তাকিয়ে রইলাম আয়নার দিকে। সেখানে অপরূপ সুন্দরী একটি তরুণী তাকিয়ে আছে আমার দিকে...
পরের অংশ
বিছানা থেকে উঠে চোখে মুখে একটু পানি দিয়ে ঘরে এসে হাতের ব্যাগটি নিয়ে বের হয়ে এলাম। আস্তে আস্তে সিঁড়ি দিয়ে নামতে নামতে ভাবলাম, কি করি, কোথায় যাই ...। কি করা যায় এই ভাবতে ভাবতেই সিঁড়ি শেষে এসে পড়লাম রাস্তায়। হাঁটতেই থাকলাম। চারিদিকে তাকিয়ে মনে হল - আজ কি বার? শহরে আজ কি হয়েছে? রাস্তা ঘাট কেমন যেন ফাঁকা ফাঁকা, ভিড় ভাট্টা বেশ কম। গিজ গিজ করা মানুষ গুলো আজ কোথায় যেন গেছে, চারিদিকে একটা নরম, ফুরফুরে ওয়েদার। এখন কি বসন্ত কাল? এটা কি ফাল্গুন মাস? ইট কংক্রিটের জঙ্গলে প্রকৃতি দেখে ঋতু বোঝা বড্ড কঠিন, নিউজ পেপার দেখে, ক্যালেন্ডার দেখে তবেই বোঝা যায়।
আমাদের এখানে বেশ কয়েকটি মেসবাড়ি আছে। কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ের মেয়েরা, স্বল্প আয়ের চাকুরীজীবি মেয়েরা এখানে থাকে। যেহেতু এখানে প্রচুর মেয়েরা থাকে, মেয়েদের চাহিদা মাফিক এই এলাকা জুড়ে সব ধরনের দোকান পাট, কাঁচা বাজার, ফোন ফ্যাক্স, টেইলার্স, বিউটি পার্লার গড়ে উঠেছে। এগুলি নামকরা কোন টেইলার্স নয়, পার্লার নয়, কারো কারো বাসা বাড়িতে ছোট্ট একটি রুমে- বড় বড় কটি আয়না লাগিয়ে, ঐশ্বরিয়া, কারিনা, প্রিয়াংকার বড় বড় কিছু ছবি লাগিয়ে পার্লার দিয়ে বসেছে। এগুলির নাম মা সেলাই ঘর, বিউটি টেইলার, বউ সাজো পার্লার থাই পার্লার ইত্যাদি। পার্লার গুলোতে বাংলাদেশী নায়িকাদের ছবি কখনই থাকেনা। থাকেনা কেন কে জানে। এখানে একটি পার্লারে আমার একটি পরিচিত মেয়ে কাজ করে। মাঝে মাঝে রাস্তায় দাঁড়িয়ে ওর সাথে আমার কথা হয়। ওর আসল নাম থাকা স্বত্বেও পার্লারে ওর একটি ছদ্মনাম আছে। পার্লারের কোন মেয়েই নাকি প্রকৃত নামে কাজ করেনা। এটাও এক রহস্য। আমি হেঁটে হেঁটে কিছু না ভেবেই, ঐ পার্লারে ঢুকে পরলাম। দেখি কারিনা বসে আছে। আমাকে দেখে সে উঠে এলো, বলল-
-কি আপু, কেমন আছ? কি করাবা? কোন প্রোগ্রাম আছে?
হঠাৎ করেই মনে হল আচ্ছা দেখিই তো, একটু সাজি -ই না!
বললাম,
- কারিনা, সাজতে কত টাকা লাগে? ও বলল,
- সাজের উপর দাম নির্ভর করে, তুমি কিভাবে সাজবা?
আমি কি অতশত জানি, বললাম-
- তোমার মত করে সাজিয়ে দাও। কিন্তু আমার কাছে তেমন টাকা পয়সা...
-আচ্ছা, সে হবে। তুমি এসো, আগে তো তোমায় সাজাই।
জীবনে প্রথমবারের মত সাজতে বসে গেলাম। ও আমায় বেশ যত্ন করে সাজাতে লাগল....। ধীরে ধীরে ও আমার চোখ, ঠোট, নাক, পুরো মুখ সাজালো। পুরো কাজ শেষ হলে তাকিয়ে দেখি- চোখ দুটোকে কী অপরূপই না লাগছে! আশ্চর্য! মনে হচ্ছে এ দুটি যেন অলৌকিক প্রজাপতি- ঐশ্বরিক বাগান থেকে এসেছে, এক্ষুনি ডানা মেলে দিবে। নাকটা আমার বোঁচা ছিল না, তবে খুব খাঁড়াও ছিলনা- সেটিও একেবারে নিখুঁত লাগছে। মনে হচ্ছে ঠিক এরকমটিই হওয়া উচিৎ ছিল। ঠোঁট দুটির দিকে তাকিয়ে আমি তো হা- - এ কখনই আমার ঠোঁট নয়। এতটা অন্যরকম! এতোটা অন্য ধরনের সুন্দর! একি কোন দেবী! রূপের দেবী!
এরপর সে আমার চুল বেঁধে দিল। বাঁধা শেষে বলল-
-আপু ফুল আনোনি কেন? ফুল দিলে আরো সুন্দর লাগতো।
আমি ওর কথার কোন উত্তর না দিয়ে মুগ্ধ দৃষ্টিতে অপলক তাকিয়ে রইলাম আয়নার দিকে। সেখানে অপরূপ সুন্দরী একটি তরুণী তাকিয়ে আছে আমার দিকে। ফুল না দিয়েও যাকে ফুল পরীর চেয়েও সুন্দর লাগছে।
আমার মনে হল- আহারে! আমি যদি একটি ফুলপরি হতাম! অথবা আমার জীবন যদি বাস্তবের ফুলপরিদের মত হত! নিজের অজান্তেই দীর্ঘশ্বাস বেড়িয়ে এল।
কারিনা কোত্থেকে চমৎকার রঙের একটি জারবেরা এনে বলল-
-আপু কাস্টমার ফেলে গেছে, এসো লাগিয়ে দেই-
কানের পাশে বেশ কায়দা করে সে লাগিয়ে দিল। পুরো সাজ কমপ্লিট হলে - ব্যাগ হাতরে, অপ্রস্তুত হাসি হেসে, ওর হাতে শেষ সম্বল ৮০০/ টি টাকা ধরিয়ে দিলাম। আবারও সলজ্জ মৃদু হাসলাম। আমি জানি এই সাজের মূল্য ৮০০/ টাকার চেয়ে বেশী। ও বলল–
-আচ্ছা আপু তুমি যাও, আমি ম্যানেজ করে নিব। ওর দিকে কৃতজ্ঞ দৃষ্টি দিয়ে আমি বেড়িয়ে এলাম।
এরপর কি? কোথায় যাব? কোন পরিকল্পনা তো আসলে নেই। আমার মাথার ভেতরটা শূন্য। আমি যেন এক ঘোরের মধ্যে আছি। আবার মেসের দিকেই হাঁটা শুরু করলাম। বুঝতে পারছি রাস্তার প্রতিটি মানুষ, দোকানে বসা মানুষগুলি সবাই আমার দিকে তাকাচ্ছে। তাদের দৃষ্টিতে মুগ্ধতা। আমি এগিয়ে যেতে থাকি... দৃষ্টি সংখ্যাও বাড়তে থাকে। হঠাৎ করে মানুষের মুগ্ধ দৃষ্টি আমার হাঁটার ভঙ্গিমায় পরিবর্তন এনে দেয়। আমি আমার মরাল গ্রীবা উঁচু করে, একটু অন্য ভাবে হাঁটতে থাকি। আশ্চর্য, ঠোঁটের কোনায় একধরনের হাসিও ঝুলিয়ে নেই। সারা রাস্তায় কত জন যে কত প্রশ্ন করল-
-এ্যাই পারু, কই যাস?
-কি রে তোর আজ কোথায় দাওয়াত?
যেহেতু এখানে বাস করি, অনেকেই চেনা, কাজেই প্রশ্ন পর্ব চলতেই থাকে...
-কিরে মিতা, কোথায় যাবি, কোন প্রোগ্রাম?
-আরে, তোকে তো দারুণ লাগছে!
মেসের কাছাকাছি যখন এলাম, বিভিন্ন মেয়েরা আসা যাওয়া করছে, তারা দাঁড়িয়ে নানা প্রশ্ন, মন্তব্য করতেই থাকল। কেউ কেউ খুব অবাক বিস্ময়ে বলল,
-কিরে তুই এত সেজে গুঁজে কই যাস?
কেউ প্রশ্ন ছুঁড়ে দিল,
-পারুরে! এত দিনে ঘটনা ঘটালি?
একজন কাছে এসে দাঁড়িয়ে একটু ফিস ফিস করে জানতে চাইল....
-তুই কি আজ কারো গাড়িতে করে যাবি?
আমাদের উপর তলায় থাকে যে সুন্দরী মেয়েটি, যে কারো সাথেই মেশে না, কথা বলেনা, কাউকে পাত্তাই দেয় না, সে পর্যন্ত এগিয়ে এসে কপাল কুচকে ঠোঁট গোল করে ঘাড় বেঁকিয়ে প্রশ্ন করল-
-এ্যাই শোন, তুমি কোত্থেকে সেজে এলে, ফারজানা শাকিল? তোমাকে হেব্বি লাগছে।
আমি কেমন যেন এক অন্যরকম রহস্যময় হাসি সবার দিকে ছুঁড়ে দিয়ে এগিয়ে যেতে থাকলাম।
কারিনা নামের মেয়েটি মাত্র কয়েকটি ভিন্ন ভিন্ন রঙ্গিন কাঠি ব্যবহার করে, কিভাবে যেন সকলের কাছে আমায় আকর্ষণীয় ও গ্রহণীয় করে তুলল। এই রাস্তায় প্রতি দিন কতবার যাওয়া আসা করি, কই এভাবে তো কেউই কথা বলেনা, সবার কত ব্যস্ততা, ইগো, ঈর্ষা, কত অহংকার। কারো দিকে তাকাবার কারো ফুরসত থাকে না। আমার মত একটি সাধারণ মেয়েকে কেউ পাত্তাই দেয়না, আর আজ দৃশ্যপট সম্পূর্ণ ভিন্ন। আমার সবকিছু বড় বিস্ময়কর মনে হল। তার চেয়েও অবাক ব্যাপার আমার নিজের ভেতরেও একটা পরিবর্তন এল।
আমি বরাবর শান্ত, ধীর স্থির, ভীতু টাইপের একটি মেয়ে। অথবা কখনো বাধ্য হয়েই শান্ত ও বিনয়ের অবতার হয়ে থাকি, থাকতে হয়। আমি মফস্বলের একটি দরিদ্র পরিবারের মেয়ে। কোন রকমে কত সংগ্রাম করে ঢাকা শহরে পড়তে এসেছি। রেজাল্ট ভাল ছিল বলেই ঢাকা ভার্সিটিতে পড়ার সৌভাগ্য হয়েছে। কিন্তু এখানকার পরিবেশের সাথে খাপ খাওয়াবার মত অনুষঙ্গ আমার নেই। আমার মাথায় সারাক্ষণ বাড়ির কথা, বাবা-মা, ভাইটির চিন্তা জুড়ে থাকে। অনেক কষ্ট করে আমি কোন দিকে না তাকিয়ে পড়ায় মন বসাই। মনে রাখি আমাকে যে কোন ভাবেই হোক একটা ভাল রেজাল্ট বাগাতেই হবে, তাহলেই হয়তো বা সবাইকে নিয়ে টিকে যেতে পারব।
এই মেস গুলোতে যারা থাকে, প্রায় সকলেই মফঃস্বল থেকে আসা। বেশির ভাগ মেয়েরই চাল চলন, আচার ব্যবহার, চলাফেরা খুব নিরীহ টাইপের, আমার মত। কিছু আছে, মাঝারী ধরনের। আবার বেশ কিছু আছে- তারা সকল বোঝা বুঝির ঊর্ধ্বে। তারা বড় রহস্যময় জীবনযাপন করে। তাদেরকে আমি একদম বুঝিনা। তারা বেশ ভাল ভাবে থাকে, ভাল ড্রেস ট্রেস পরে। প্রায় সময় সামনের মোড়ের অপেক্ষমাণ গাড়িতে তাদের চড়তে বা কখনও রাত বিরেতে নামতে দেখা যায়। ওরা একেবারেই অন্যরকম, কারো সাথেই কথা টথা বলেনা। মেশেনা। শোনা যায় তারা আবার মাসে মাসে বাড়িতে টাকা পাঠায়।
আমার রুমমেট দোলনচাঁপা। রুম মানে ছোট্ট একটি স্যাঁতসেঁতে ঘরে পাশাপাশি দুটি চৌকি পাতা, পাশ ফিরলেই যেটা ঘট ঘট করে নড়ে উঠে, কারণ এগুলোর চার পায়া কখনই সমান হয়না। ভাঙ্গা ইটের টুকরো এনে গুঁজে দিলে তবেই ঠিক হয়। আমার পাশের চৌকিতে দোলন থাকে। ওর পুরো নামটি আমার খুব পছন্দের- দোলন চাঁপা – কী মিষ্টি! এখানে সবাই সবার নামের প্রথমাংশ, শেষাংশ বা ক্ষুদ্রাংশ ধরে ডাকে। নামকে টুকরো টুকরো ভাগ করায় মেয়েদের জুড়ি নেই। আমার নাম পারমিতা। কেউ আমায় পুরো নামে ডাকেনা। বঙ্গভঙ্গের মত এক পারমিতা যে কত টুকরো হল- আমি শুধু চুপচাপ শুনে যাই, বেশ লাগে। কেউ বলে পারু, কেউ বলে রুমি, কেউ বলে মিতা আরো কত কি...। তবে একটি মেয়ে বলে ‘পরম’ ওর উদ্ভাবনী শক্তিতে আমি বিমোহিত। পরম, শুনতে ভীষণ ভাল লাগে। দোলন যতটা না আমার বন্ধু, রুমমেট, ক্লাসমেট তারচেয়েও বেশি গার্জেন। ও আমার বড় বোনের মত, ও আমার জন্ম জন্মান্তরের বন্ধু। আমাদের একই জায়গায় বাড়ি। আমার বাবা-মাও দোলনের উপর খুব ভরসা করে। আমার বাবা-মা, দোলনকে মেয়ের মতই ভালবাসে। ও আমাকে কঠিন ভাবে নিষেধ করেছে, অন্যরকম বা রহস্যময় মেয়েদের সাথে একদম মিশবিনা। ওদের কাছ থেকে শত হাত দূরে থাকবি। আমি দোলনের কথা অক্ষরে অক্ষরে মেনে চলি। রহস্যময়ী মেয়েদের কাছ থেকে শত হস্ত দূরে থাকি। বিশাল ট্র্যাকের পেছনে যেমন লেখা থাকে ‘১০০ হাত দূরে থাকিবেন’। আমিও তেমন এদের কাছ থেকে হাজার হাত দূরে থাকি।
দোলন দারুণ বাস্তববাদী, বুদ্ধিমতী এবং যুক্তিবাদী একটি মেয়ে। ও দুটো টিউশনি করে, নিয়মিত ক্লাস করে, গাধার মত খেটে খুটে পড়াশোনা করে। প্রতিটি পরীক্ষায় ভালো রেজাল্ট করে। ওর জীবন হল রুটিন বাঁধা। রোবটের মত। আবার রুমের কাজ গুলোও ওই বেশির ভাগ করে। আমার এসব করতে খুব একটা ভাল লাগে না, আমি মেয়েটা কেমন যেন! আমার শুধু একটা কাজই করতে ভীষণ ভাল লাগে, সেটা হল বই পড়া। তাই বলে ক্লাসের বই না। সব লেখকের সমস্ত বইই আমার পড়তে ইচ্ছে করে। এখানে অবশ্য ইচ্ছে করলেই বই পড়া যায়। মানে হাতের নাগালে পাওয়া যায়। সকলের কাছেই বিভিন্ন ধরনের বই থাকে- গল্প, উপন্যাস, কবিতা, হাদিস, ভ্রমণ কাহিনী, খোয়াবনামা থেকে শুরু করে খুব কঠিন বিষয়ের বইও কারো না কারো কাছে পাওয়া যায়। সে গুলো চেয়ে নিয়ে খুব সহজেই পড়ে ফেলা যায়। আমি তো ছোট বেলা থেকেই বই পড়ি। বাড়িতে থাকতে বাবা স্থানীয় লাইব্রেরী থেকে বই এনে দিত। তাছাড়া আমি বিশ্ব সাহিত্য কেন্দ্রের সদস্য। এখানেও প্রতি শুক্রবারে ‘আলো আমার আলো’.... গান বাজিয়ে বই এর ভ্রাম্যমাণ লাইব্রেরী আসে। আমি নিয়মিত বই নেই। এই একটি কাজে আমার কোন আলিস্যি নেই।
ইদানীং কবিতা পড়ছি, না, সবার লেখা নয়। কেবল মাত্র একজন কবির। কিছুদিন আগে কি করে যেন একটি কবিতার বই হাতে এসেছিল- পাতা উল্টাতে উল্টাতে পুরো বইটাই শেষ করলাম। আশ্চর্য! ভীষণ আশ্চর্য!! কবিতা এমন হয়!! এরকম হতে পারে, আমার জানা ছিলনা। আমি বিভিন্ন জায়গায় খুঁজে খুঁজে তাঁর সব বই-ই পড়ে ফেললাম। ওর প্রতিটি বই এর প্রতিটি কবিতা এখন আমার প্রায় মুখস্থ। বইএর পেছনে কবির যে ছবি থাকে, সেটি দেখতে দেখতে তাঁর সাথে মনে মনে আমার গভীর সখ্য হয়ে গেছে। মনে মনে ওর সাথে আমি নানা রকম রোমান্টিক ভাবনা ভাবি, ভাবতে আমার খুব ভাল লাগে। ওর সাথে মনে মনে আমি কত কথা বলি- কথোপকথন চলতেই থাকে, রাত গড়িয়ে ভোরের দিকে যায়, কখনও ভোর গিয়ে সকালে মিলায়, আমি তাঁর সাথে কথাই বলি। কল্পনায় বলি। কল্পনা আমার কাছে বাস্তবের মতই অদ্ভুত প্রেমময় মনে হয়।
পরের অংশ
|