জীবন গাঁথা/কাজী লাবণ্য
আগের অংশ
-এইত ভাই আছি, হামার আর ভালো থাকা! দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে পরী। সারাদিন রোজা শেষে এই মাত্র সে আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করে এসেছে, তখনও চোখ মন ভেজা, সে মাথা নিচু করে থাকে। ধলা সবই বুঝতে পারে। সমস্যা ত আর আজ নুতন নয়।
-আমি ত সবই জানি ভাবী, কবে থেকে মনুদাকে বলি ডাঃ এর কাছে যেতে তা সে কই শোনে আমার কথা
-দোষ তো মোর ভাই। মোর জন্যই ত সে বাপ হওছে না, মুই বাঁজা, মুই আঁটকুড়ী, মোর মুখ দেখলে বোলে... পরীর কণ্ঠ বুজে আসে, চোখ দিয়ে অনর্গল পানি পড়তে থাকে। ধলা খুব বিচলিত হয়...
-ভাবী শোন, কাঁদবে না, চোখ মোছ, কার দোষ, কেন কিছু হচ্ছে না সেটা ডাঃ না দেখানো পর্যন্ত বলা যাবে না। এমন তো হতে পারে মনুদার কারণেই কিছু হচ্ছে না। তুমি মনুদাকে খুব তাড়াতাড়ি ডাঃ এর কাছে পাঠাও, বা দুজন একসাথে যাও। সন্তান হওয়ার ব্যাপারে স্বামী-স্ত্রী দুজনের সমান ভূমিকা। অনেক সময় পুরুষের কারণে বাচ্চা হয়না, আবার কখনও স্ত্রীর কারণেও বাচ্চা হয়না এই সব নানা কথা ধলা বুঝিয়ে বলে আর পরীও আজ এই অজানা কথাগুলি চোখ বড় বড় করে শোনে। সন্তান হবার ব্যাপারে নারী পুরুষের ভূমিকা, সঠিক সময় ইত্যাদি নিয়ে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে অনেক প্রশ্ন করে পরী। আজ যেন সে বেপরোয়া। সব কিছু তাকে জানতে হবে। বুঝতেই হবে।
-শোন কাউয়া ঘটক আজকাল মনুদার সাথে প্রায়ই গুজুর গুজুর, ফুসুর ফুসুর করে ব্যাপারটা আমার ভালো লাগে না। এই শুনে তুমি আবার মন খারাপ করনা। কাউয়ার ব্যাপারটা আমি দেখব। তুমি ধৈর্য ধরো। আর খুব শিগগরই ডাঃ এর কাছে যাও। আচ্ছা এখন আমি যাই, পরে আবার আসব। ও আচ্ছা, এই নাও তোমার কলার টাকা। কিছু টাকা বাড়িয়ে দিলে পরী তা হাত বাড়িয়ে নেয়। প্রায় সময় গাছের কলা, কলার মোচা, হাঁস, মুরগি ইত্যাদি সে বল্টুকে দিয়ে বিক্রির জন্য হাটে পাঠায়। ভাসুরের ছেলে বল্টু নিয়ে গিয়ে ধলার কাছে দিয়ে আসে। বিক্রি টিক্রি করে ধলা টাকা পয়সা পরীর হাতে দ্যায়। গাছের বিভিন্ন জিনিস শাশুড়ি জাকে দিয়ে নিজেরা খেয়ে যা থাকে পরী বিক্রি করে করে কিছু টাকা পয়সা জমিয়েছে। ধলা নিজের ঘরে গিয়ে সর্বক্ষণের সঙ্গী রেডিওটি ছাড়ে সেখানে গান বাজে- “হলুদিয়া পাখি সোনারই বরণ পাখিটি ছাড়িল কে...
কাউয়া ঘটকের কথায় পরীর বুকে যেন শেল বেঁধে তার সমস্ত শরীর ভেঙ্গে পড়তে চায়। কাউয়া ঘটক এ অঞ্চলের নামকরা ঘটক যার পেছনে লাগে তাকে বিয়ের পিঁড়িতে বসিয়েই ছাড়ে।
পরী সংসারের চারিদিকে তাকায়- এই সংসারের প্রতিটি ইঞ্চি জায়গায় পরীর হাতের স্পর্শ। ঘরের পেছনে একটি আম গাছ লাগিয়েছিল, সেটাতে কবছর ধরে ঝেপে আম ধরে। তার ওপাশে কলার বিশাল ঝোপ হয়েছে সেখানে একটা না একটা গাছে কলার কাঁদি সব সময় লেগেই থাকে। হাঁস মুরগি দিয়ে খুপড়ি এখন ভর্তি। এক ছাগল থেকে এখন ছোট বড় অনেক ছাগল হয়েছে। ঘরের শিকায় বিভিন্ন ছোট বড় হাঁড়িতে সারা বছরের জন্য কত রাজ্যের জিনিস! কবছর আগে বাড়ি ঘিরেছে মাটির দেয়াল দিয়ে তখন মনু মাত্র দুদিন কাজে কামাই দিয়েছিল, বাকি কাজটা পরী একাই একটু একটু করে শেষ করেছে। এই সংসার, এই গেরস্থালী, এই পরিপাটি নিটোলতা পরী একটু একটু করে, তিল তিল করে গড়ে তুলেছে। এ-ই স-ব তার একার। এসব ছাড়া সে এক মুহূর্তও বাঁচবে না।
এসবের ভাগও সে আর কাউকে দিতে পারবে না।
আর মনু? তার ভালো মানুষ স্বামী?
বিয়ের পর থেকে এতগুলো বছর ধরে সে স্বামীর চওড়া বুকে মুখ ডুবিয়ে ঘুমিয়েছে...
স্বামী তার পর হয়ে যাবে! সেখানে ভাগ দখল নেবে আরেকজন! আজানের শব্দে চমকে উঠে পরী। কখন এশার নামাজের সময় হয়ে গেছে। অজু করে সে ঘরে যায় জায়নামাজে বসে দুহাত তুলে আকুল হয়ে কাঁদতে থাকে। এভাবেই দিন কাটতে থাকে...
কদিন ধরে পরীর অসম্ভব মন খারাপ। সে দুশ্চিন্তায় পাগল প্রায়। সে খায় না, নায় না, এত প্রিয় ভরা সংসার, গাছপালা, হাঁস মুরগি সেদিকে সে ফিরেও তাকায় না। তারপর সে মনে মনে শক্ত কসম করে
“মোর সংসার যেমন করি হউক মুই রক্ষা করিম, যা করা লাগে তাই করিম”। পেছনে হাত ঘুরিয়ে এলো-চুলের গোছা শক্ত করে বেঁধে নেয় সে।
** পরীবিবি কোনদিন স্কুল কলেজে পড়েনি, পুঁথিগত কোন রকম বিদ্যা শিক্ষাই তার নেই। বিশ্বে নারীর অবস্থান, নারীর অধিকার, নারী দিবস কিছুই সে জানে না। পৃথিবীর জ্ঞান ভাণ্ডারের কোন খবরই সে রাখে না। তবে প্রকৃতিই তাকে কিছু স্বাভাবিক জ্ঞান বুদ্ধি, বিবেচনা বোধ দিয়েছে। ছোটবেলা থেকেই চারপাশের পরিবেশ, আত্মীয়স্বজন, পাড়া প্রতিবেশীদের দৈনন্দিন জীবন থেকে আহরিত অভিজ্ঞতায় সে এটুকু বোঝে কিছু একটা তাকে করতে হবে, হবেই। কেবল একটা বাচ্চার কারণে তার সাজানো সংসার ভেঙ্গে যাবে! স্বামী পর হয়ে যাবে!
পরী নিজের দিকে তাকায়, নিজেকে নিয়ে ভাবে- আজ পর্যন্ত কোনদিন সে অসুস্থ হয়নি, তার শরীর কখনো খারাপ করে না, সে ভালো রকম হিসেব নিকেশ করে দেখে তার কোন মেয়েলি সমস্যা নেই, তাহলে ঘটনা কি? সেদিনের ধলার কথা গুলো তার খুব মনে পড়ে। সে সব কিছু বোঝার চেষ্টা করে। তার মাথায় ঘুরপাক খায়- “বাচ্চা হওয়া না হওয়ার জন্য কেবল নারীই দায়ী নয়”। তারপর সে কি এক সিদ্ধান্ত নিয়ে শক্ত, দৃঢ় হয়ে উঠে দাঁড়ায়।
প্রতি বছর প্রচণ্ড শীতে স্বামীকে সে বুকের ওম যেমন দেয়, তেমনি হারিকেনের আলোতে কাঁথাও বানিয়ে দেয়, গরমে তাকে সারারাত পাখার বাতাস দেয়, এবারে একটি সন্তানও সে তাকে দেবে । দেখা যাক কি হয়...
ঘোর বর্ষাকাল। কদিন ধরে এক নাগারে বৃষ্টি হবার পর, আজ আকাশ ধরে এলেও গুড়ি গুড়ি, ফিনফিনে বৃষ্টির চাদর ঝরছে। চারিদিকে প্যাচপ্যাচে কাঁদা। হাঁস মুরগি, গরু ছাগল ভিজে একাকার হয়ে ঘরের কোনে কোনে আশ্রয় নিয়েছে। কাক গুলো সত্যিকারের কাক-ভেজা হয়ে সজনে গাছটায় জবুথবু বসে আছে। মানুষের দুর্গতির অন্ত নেই...
কদিন থম ধরে থাকার পর আজ পরী অনেক সময় নিয়ে সুগন্ধি সাবান দিয়ে গোসল করেছে, ভালো একটা শাড়ি পরেছে, চুলে তেল দিয়ে টান টান করে চুল বেঁধেছে, চোখে কাজল দিয়েছে আর এই প্রথম পায়ের মল জোড়া খুলে রেখে ঘর থেকে বেরিয়ে পরেছে...
চারপাশে ঘুটঘুটে অন্ধকার, বাইরে ঝিঁঝিঁদের জোড়ালো কোরাস, কাদায় পিচ্ছিল উঠান, এ উঠান সে উঠান পেরিয়ে পা টিপে টিপে সন্তর্পণে হাঁটতে থাকে সে। হাতের তালুর রেখার মতই পরিচিত গন্তব্যের গলি কাজেই পা ফেলতে কোন সমস্যা হয়না। যেতে যেতে অন্ধকারে নরম থকথকে কিসের উপর যেন পা পরল- গন্ধে বুঝল গোবর। দূর্বা ঘাসে ঘষে ঘষে পা মুছে একের পর এক পা ফেলতে থাকে সে...
এক কান থেকে আরেক কানের দূরত্বের পথ অথচ পথ যেন ফুরোতেই চায়না। তবে স্থিরসংকল্প জানে পথকে একসময় ফুরাতেই হয় - ফুরালো। পরী তার জীবনমুখী হাত রাখল দরোজার কড়ায়...
বৃষ্টি বাদলার রাতে কোন এক হাট ফেরত মানুষের গানের সুর দূর থেকে শোনা যায়। পাকুড় গাছের বাদুর গুলো নিজেদের মধ্যে কেন যেন ডানা ঝাপটায়। দূরে ট্রেনের হুইসেল দূর থেকে আরো দূরে মিলিয়ে যায়।
** বিয়ের প্রায় ৯/১০ বছর পরে মনুর বউয়ের সন্তান হয়েছে। কন্যা সন্তান। সকলেই খুশী। খাঁ বাড়ির আম্মা পর্যন্ত সন্তান দেখতে এসেছেন, সঙ্গে কত কিছু যে এনেছেন! শিশুর মুখ দেখে যেমন তিনি অবাক তেমনি খুশীও।
-কিরে মনু, তোর মেয়ে যে মেমসাহেবদের মত দেখতে হয়েছেরে! কি সুন্দর চাঁদপানা মুখ হয়েছে! আর গায়ের কী রঙ! মাশাল্লাহ!
কন্যাকে দেখে তিনি একটি চেইন দিলেন আর নাম রাখলেন- “এলিজাবেথ” মনু পরীর মেয়ে নাকি দেখতে রানী এলিজাবেথ এর মতই হয়েছে। আম্মা যখন ছোট ছিলেন তখন নাকি রানী এলিজাবেথ এসেছিলেন সে কথা মনে করেই এই নাম যদিও পরে পাড়ার মানুষ সারাজীবন ধরে কেবল এলি বা এলিজার মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল।
** -নানীমা, উঠো হাঁটো ঘরত যাই। আর কান্দেন না। কান্দিতে কান্দিতে তো শ্যাষ হয়া যাওচেন নানীমা। পরম মমতায় বলতে বলতে বড় নাতনী, এলিজার মেয়ে এসে পরীবিবির হাত ধরে। বৃদ্ধা ফ্যাল ফ্যাল করে বোবা দৃষ্টিতে নাতনীর মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে।
পরীবিবির এত কিছুর ফল যে সন্তান, যে সন্তান পরীবিবির জীবন- সমাজ সংসার রক্ষা করেছিল, নিজেও সে দীর্ঘদিন সংসার করে স্বামী সন্তান সন্ততি আর অশীতিপর বৃদ্ধা মাকে রেখে অজানা কোন জগতে চলে গেল।
আগের অংশ
কাজী লাবণ্য, ঢাকা থেকে
|