ঈদি ইয়াবা / কাজী লাবণ্য
গভীর মমতায় জিজ্ঞেস করলাম- তোমার নাম কি বাবা, তুমি কি পড়?
-“বিবিএ” অস্পষ্ট স্বর।
-“কোথায়”? ব্যাঙের ছাতার মতো গজানো একটা প্রাইভেট ভার্সিটির নাম বলল। জীবনে এ নাম কর্ণকুহরে প্রবেশ করেনি।
-“তোমার আরো ভাইবোন আছে”? নিরুত্তর।
-“তোমার মায়ের কি কোন অসুখ বিসুখ আছে? আগে কি কখনও জ্ঞান হারিয়ে পড়ে গিয়েছিল?” -হু, কিজানি, আমি জানিনা কিযে বিড়বিড় করে!
-“তোমাদের বাসা কোথায়”? উত্তর নেই। ছেলে মনে হয় খুব ঘাবড়ে গেছে। আমি চুপ করে গেলাম। কিন্তু আমার গোপন কৌতূহল ফুঁসছে, কিছুক্ষণ পরে আবার জিজ্ঞেস করলাম-
-“সকালে তোমার মা যখন বাসা থেকে বের হন, মায়ের সাথে দেখা হয়েছিল?” “না”
-“তোমার বাবা কী করেন”?
-“কিছু করেনা” আমার বিস্ময় ক্রমশ বাড়ছে। “তোমার বাবা এখন কোথায়”?
-“ঘুমুচ্ছে” “তুমি কী ক্লাসে ছিলে সেখান থেকে এলে”?
-“আমিও ঘুমাচ্ছিলাম”। আমি বিমুঢ়।
“তোমরা সবাই ঘুমাচ্ছিলে আর তোমার মা বিল দিতে এসেছিল”? নিজের অজান্তেই গলা কী খানিকটা চড়ে গেল! কোন উত্তর নেই। রাণিক্ষেত রোগাক্রান্ত মুরগির মতো বুকের সাথে থুঁতনি লাগিয়ে একমাথা রুক্ষ চুল ঝিমুতে লাগল। এতগুলো প্রশ্নের উত্তরে সে কোনরকম আলোচনা ত দুরের কথা একটা দীর্ঘ বাক্যও ব্যয় করলনা। হারামজাদা ছেলের গালে কষে একটা চড় দেবার ইচ্ছে দমন করে উঠে পড়লাম...
ধুর! খামোখা সময় নষ্ট! কেবল মাত্র চামড়ার রঙ কালো বলে প্রায় ৩০/৩৫ জায়গায় প্রত্যাখ্যাত হবার পরে আমার যে প্রথাগত সংসার নেই সেজন্য আবারও ঈশ্বরের দরবারে শোকর করলাম। আমি উঠে ডাঃ এর কাছে গেলাম। ভাবলাম একটু কথা বলে চলে যাব। ক্ষোভে বিরক্তিতে মনে মনে আবার উলটো প্রার্থনা করলাম- “হে ঈশ্বর এই হতভাগী নারীকে আর জ্ঞান ফিরিয়ে দিও না, তাকে অজ্ঞান অবস্থায় নিয়ে যাও, তাকে আশ্রয় দাও, তাকে ঘুমাতে দাও। সে বাঁচুক। মরে বাঁচুক।”
ডাঃ এর সঙ্গে কথা টথা বলে কেবিনের কাছে এসে দেখি একটু চাঞ্চল্য। কি ব্যাপার? উনার জ্ঞান ফিরেছে। আরে! ছেলের সঙ্গে কথা বলছেন। আমি এসে ছেলের পেছনে দাঁড়ালাম, পরিষ্কার কণ্ঠে তিনি বলছেন- “বাবা নাস্তা খেয়েছিস? টেবিলে নাস্তা ঢাকা আছে। আজ পরোটা করতে পারিনি বাবা, রাগ না করে খেয়ে নে”। ছেলের কোন বিকার নেই। তার হাতে মোবাইল ফোন। যাবার সময় দেখেছিলাম ভাত ফোটার মত দুহাতে টপাটপ বাটন টিপছে... উপস্থিত আমরা সবাই উনাকে ঘিরে রইলাম। আমি ভাবছি এখুনি চলে যাব। এসব মানুষের সাথে থাকার আর কোন আগ্রহ বোধ করছিনা। কেবল অসহায় ফর্সা নারীর জন্য বড্ড দুঃখ হচ্ছে।
ঘুরে এক পা বাড়িয়েছি হঠাত মহিলা একটু জোরে আর্তনাদ করে উঠলেন-
-“বাবা আর ওসব খাস না বাবা, আর খাসনা। আল্লাহর দোহাই লাগে, মায়ের কসম আর ওসব খাসনা, নিজের সর্বনাশ করিসনা। বাবা কথা দে, প্রতিজ্ঞা কর আর নেশা করবিনা”...
তিনি ছেলের হাত ধরে নিজের মাথায় রাখলেন, হাফাতে লাগলেন, শব্দ করে বাতাস টানছেন কিন্তু ফুসফুস ভরছে না মনে হয়। গলা দিয়ে কেমন যেন শব্দ বেরুতে লাগল। আরো যেন কিকি বললেন...কথা জড়িয়ে গেল... দুদিকে মাথা ঘুরিয়ে কাকে যেন খুঁজলেন... দৃষ্টিতে শুন্যতা... বলতে বলতে মহিলার হাতটা নেতিয়ে পরে স্থির হয়ে গেল। আমি কিছু বুঝে ওঠার আগেই কেউ একজন ডাঃ এর কাছে ছুটে গেলেন বাকি সবাই বেডের কাছে এগিয়ে এলেন। দাড়িওয়ালা ভদ্রলোক কলেমা পড়তে লাগলেন, আমি আবার উনার মাথার কাছে গিয়ে দাঁড়ালাম। মাথায় হাত রাখলাম। ছেলের হাত মায়ের হাতের মুঠোয়, কি হলো! সবাই সচকিত! ডাঃ এসে ঢুকলেন। আমার বুক ঢিপ ঢিপ করতে লাগল। কেমন যেন একটা অজানা ভয় আমাকে গ্রাস করল। আর ঠিক সেই মুহূর্তে একেবারে আচমকাই এই বিপন্ন নারী আমার পরমাত্মীয়া হয়ে উঠলেন। সেরকমই আমার অনুভূতি হতে লাগল। ভয়ে ভয়ে ডাঃ এর মুখের দিকে তাকালাম। পরীক্ষা করে উনি কিছুই বললেন না। এসব মনে হয় বলতে হয়না। সবাই বুঝে গেল যে উনি আর নেই। আমি স্তম্ভিত। পুরো কেবিন স্তম্ভিত! মৃত্যু এসে যেন ঘর ভর্তি মানুষ গুলোকে মূক করে দিয়ে গেল...
আরো অনেকটা সময় বিহ্বল দাঁড়িয়ে থেকে, মৃত্যুকে পেছনে ফেলে ধীর পায়ে কেবিন থেকে বেড়িয়ে এলাম। আশ্চর্য মানুষের জীবন তার চেয়েও অধিক আশ্চর্য মানুষের মৃত্যু! কেন যেন খুব কষ্ট হতে লাগল। লম্বা করিডোর ধরে বিষণ্ণ কদমে হাঁটছি। মহিলার মৃত্যুর জন্য নয় বরং তার যাপিত জীবনের জন্য আমার অসম্ভব কষ্ট হতে লাগল। হয় নয় করে সারাটাদিন গেল, কই মহিলার স্বামী তো এলেন না। ছেলে এলো সেও তো এক জম্বু জানোয়ার ছাড়া আর কিছু মনে হলনা। “নেশা” এই একটি শব্দই যথেষ্ট কারো জীবন বোঝার জন্য। সারাজীবন মহিলা কেমন কাটিয়েছেন, সুখ-পাখি তার দ্বারে কতবার দোল খেয়েছে তা জানার জন্য কি আরো বেশি তথ্যের দরকার! অজানা অচেনা মহিলার জন্য আমার পাথর হয়ে আসা দুচোখ বেয়ে অঝোরে জল গড়াতে লাগল...
বন্ধুদের দেয়া নাম ‘ব্ল্যাক ডায়মন্ড’ এর জন্য আজ নিজেকে আশির্বাদপুষ্ট আর এই স্বর্ণচাঁপার জন্য বড্ড করুণা এলো ভেতরে। পারিবারিক স্ট্যাটাস, মেধা, যোগ্যতা সব থাকা স্বত্বেও শুধুমাত্র গায়ের রঙের কারণে এইযে আমি আমার ছোট্ট গাড়িটির স্টিয়ারিং হুইলের মত জীবনের স্টিয়ারিং হুইলও নিজের হাতে রেখেছি, তাইবলে আমি কি ভালো নেই! সুখ-পাখি আমার দ্বারে কী দোল খায়না! হ্যাঁ জোড় গলায়, দু আঙ্গুলে তুড়ি মেরে বলতে পারি আমি ভাল আছি। দুর্দান্ত কেটে যাচ্ছে আমার জীবন। কেবল কালো-সাদার এই নগণ্য ইস্যুটা মাঝে মাঝেই আমাকে বড় যন্ত্রণা দেয়।
অসম্ভব ক্লান্ত অবসন্ন লাগছে... বাইরে এসে গাড়িতে উঠে বসলাম। ভালো লাগছেনা। ঢাকা শহরের সান্ধ্য-কালীন ভয়াবহ জ্যাম পেরিয়ে গুটি গুটি বাসার দিকে যাচ্ছি। আজকাল আর বাদুরের ডানায় ভরকরে সন্ধ্যা নামেনা। কিন্তু তারপরও সন্ধ্যা নামে বৈকি শেষ রবির সর্বশেষ লালিমা আর কারো কারো মনের উঠানে বিষণ্ণতা ছড়িয়ে। মেইন রোড ছেড়ে সাইড রোডে চলে এলাম। মসজিদ মসজিদে আজানের সুর ধ্বনিত হতে লাগল। আশপাশের কোন কোন ফ্ল্যাটের জানালা দিয়ে উলু বা শঙ্খধ্বনি শোনা যেতে লাগল। চলে এলাম বাসায়। ব্যাগ থেকে চাবি বের করে লক খুলে আমার একরুমের নির্জন স্বর্গে ঢুকলাম চারদিকে তাকিয়ে সত্যিই আমার মনে হল এটি স্বর্গের একটি ক্ষুদ্রাংশ। কিযেন খটকা লাগল, সোফায় বসে ব্যাগ খুলে দেখি ভেতরটা ফাঁকা। তরাং করে মেজাজটা তেঁতে উঠল- উঠে দাঁড়ালাম, পরিষ্কার বুঝতে পারলাম ব্যাপারটা। কিছুক্ষণ ভেবে একটা শ্রাগ করে অবজ্ঞা ভরে বসে পড়লাম। বিবমিষা- বিবমিষা!
চোখের সামনে ভেসে উঠল ঈদের দিনের সকাল- এবারে ঐদিন ওরা সবাই পরবে বেবি পিংক কালারের ঘন কুঁচির ফ্রক, মাথায় একই রঙের ফুল। কে কার আগে আমাকে সালাম করবে, চুমু দেবে, জড়িয়ে ধরবে, ঈদি বা সেলামি নেবে এই নিয়ে হাসতে হাসতে সব হুটোপুটি করবে। ঐশ্বরিক আনন্দে ওদের সাথে সাথে আমারও হাসির কুটিপাটি চলবে...
গর্ভে না ধরেও আমি যাদের মা সেই পথ-শিশুদের আবাসিক স্কুলের ফুটফুটে বাচ্চাগুলির সাথে আসন্ন ঈদের দিনটি কাটাব, প্রতিবারের মত ওদের জন্যই “ঈদি” তুলেছিলাম ব্যাংক থেকে। হা কপাল! আমার নতুন নোট গুলো ঈদি না হয়ে ইয়াবা বা মারিজুয়ানার ভোগে লেগে গেল।
আগের অংশ
কাজী লাবণ্য, সিডনি
|