দোয়েলের চোখে কুকাবারা (৯) “দুঃখের রঙ” কাজী লাবণ্য
আগের পর্ব পরের পর্ব
ব্রিটিশ তো বটেই পৃথিবীবাসীর “হৃদয়ের রানী” ডায়ানাকে নিয়ে একটা সিনেমা দেখেছিলাম, ডায়ানার সেই মর্মান্তিক মৃত্যুর কয়েকবছর পরে। ডায়ানার জীবনের করুণ দিকটি সম্পর্কে কমবেশি সকল মানুষ অবহিত। সিনেমা দেখতে গিয়ে সে দুঃখগাঁথা যেন জীবন্ত হয়ে ওঠে চোখের সামনে। চার্লসের সাথে ১৯৮১ খ্রীস্টাব্দে বিবাহের পর থেকে ১৯৯৭ খ্রীস্টাব্দে মৃত্যুর পূর্ব পর্যন্ত ডায়ানাকে বলা হত পৃথিবীর সবচেয়ে খ্যাতিমান মহিলা। ফ্যাশন, সৌন্দর্য, এইডস রোগ বিষয়ে সচেতনতা সৃষ্টিতে তাঁর অবদান, এবং ভূমি মাইনের বিরুদ্ধে তাঁর আন্দোলন তাঁকে বিখ্যাত করেছে। তাঁর জীবদ্দশায় ডায়ানাকে বলা হত বিশ্বের সর্বাধিক আলোকচিত্রিত নারী। রূপবতী, গুনবতী, বিপুলা ক্ষমতার রানীর এত দুঃখ দেখে আমার মনে হয়েছিল- “ডায়ানা আর আমাদের হতভাগ্য সখিনা” একই নারী।
#
সিডনিতে আসার পর থেকেই কন্যার নানান বায়না- “মা, চল তোমার চুল কাটায় আনি” “মা, চল তোমার চুলে মেহগনি কালার করিয়ে আনি” “একবার করে দেখ কেমন লাগে, কি হয় কালার করলে”? “চলনা... চলনা”... একসময় হাল ছেড়ে দিয়ে বলে “তুমি একটা হুদু বাঙালি”। দিনের পর দিন একই ঘ্যানঘ্যান, একদিন বললাম- “আচ্ছা চল”। ব্যাংক্সটাউন (Bankstown) নামক এলাকার সেন্ট্রো মার্কেটের (Centro market) একটি সেলুনে গেলাম চুল কাটাতে। দেখা যাক লাল, নীল কালার ফালার করা যায় কিনা! বিশাল শপিংমলের বিউটি সেলুন। এদের সেলুনগুলি খোলা। মানে আমাদের পার্লারের মত বদ্ধ ঘরে নয়। সারি সারি দোকানের মাঝে খোলা স্পেস। সেখানে নারী কর্মী যেমন আছে তেমনি আছে পুরুষ কর্মীও।
আমাদের ঈদের সময় যেমন পার্লারগুলোতে তিল ঠাই আর নাহিরে অবস্থা হয় এদেরও বড়দিনে একই অবস্থা হয়। আমরা গিয়েছি বড়দিনের আগে আগে। তাছাড়া জগতের সকল নারী-ই সৌন্দর্যের বেলায় বিনা যুদ্ধে নাহি দেব সুচাগ্র মেদিনি। অর্থাৎ মৃত্যুর আগ মুহুর্ত পর্যন্ত কোনদিকে কোন সৌন্দর্য হারাতে দেবনা। স্কিন ট্যান, ব্লো ড্রাই, কার্ল, নানা ধরনের ফেসিয়াল, মেনি কিওর, পেডি কিওর, রিবন্ডিং ইত্যাদি আইটেমে ভরপুর পার্লারগুলো।
এই বিউটি স্যালুনেই পরিচয় হয় সারাহ নামে এক আফগান কন্যার সাথে। আমার কন্যা জানেনা কেবল সারাহর সাথে গল্প করার জন্য আমি পরেও ওর ওখানে গিয়েছি। অপুর্ব সুন্দর মেয়েটি সম্পুর্ণ কালো পরিচ্ছদে আবৃত। কালো প্যান্ট, কালো টপস, এবং মাথায় কালো স্কার্ফ জড়ানো। আমাদের আজকালকার হিজাবের মত উঁচু পিরামিড নয় সত্যিকারের মাথা কাঁধ স্মার্টলি ঢাকা। কোন ঝুলঝুল নেই হাতের কাজে প্যাঁচ লাগানোর মতো। কালোর মাঝে মেয়েটির রূপ লাবণ্য যেন আরো প্রস্ফুটিত হয়ে উঠেছে। সারাহ’র সাথে আমার অনেক গল্প হয়েছিল। কিন্তু ভাবতেও পারিনি এত রূপবতী, স্মার্ট, আত্মপ্রত্যয়ী মেয়েটি বুকে কী কষ্টের পাহাড় বয়ে বেড়াচ্ছে। ঘটনা অনেকটা এরকম- সারাহ যখন বড় হলো, তখন ওদের প্রতিবেশি আবার সম্পর্কে কাজিন ওকে বিবাহের প্রস্তাব পাঠায়। সারাহ’র বাবা একেবারে না করেনা তবে বলে যে- “মেয়ে এখনও ছোট এখন বিয়ে দেবনা” এমন করে কিছুদিন পরপরই তারা প্রস্তাব পাঠাতেই থাকে, যা একসময় বিরক্তকর এক বিষয় হয়ে দাঁড়ায়। এতই যখন আগ্রহ, সারাহ’র বাবা বিয়ে দিতে রাজী হয় একটি অনুরোধে- “মেয়েকে লেখাপড়া শেখাতে হবে”।
তারা রাজী হলে পরে বিয়ে হয়ে যায়। কিছুদিন সে ক্লাস করে, কিন্তু আর কিছুদিন পরেই সে কন্সিভ করে। স্বাভাবিকভাবেই লেখাপড়া বন্ধ থাকে। নির্দিষ্ট সময়ে একটি সন্তান আসে। সন্তানের বয়স একবছর হওয়ার পর থেকে শুরু হয় তাদের চাহিদা। সারাহ’কে বলে টাকার বড় দরকার তোমার বাবার কাছ থেকে নিয়ে আসো। দু/চারবার টাকা দেয়া হয়েছে, কিন্তু তাদের চাহিদা আরো বাড়তে থাকে। সারাহ’র বাবার জমি-জিরেতের উপর ওদের চোখ পড়ে যায়। টাকা না পেলে সারাহ’র উপর শুরু হয় অত্যাচার। বহুবার বহু বিচার সালিশ হবার পরেও তাদের অত্যাচার না কমায় সারাহ’র বাবা পরিবার নিয়ে গোপনে পালিয়ে আসে সিডনিতে। মাঝে মাঝে দেশে গিয়ে জমির ফসল বিক্রি করে অর্থকড়ি নিয়ে আসে, সারাহ এখানে কাজ করে এভাবেই সংসার চলে।
একসময় সে পকেট থেকে ফোন বের করে মেয়ের ছবি দেখায়। অপুর্ব এক পরি শিশু। চুল কেটে সেট করে যতটা মন ফুরফুরে হয়, সারাহ’র কাহিনী শুনে তারচেয়ে বহুগুণ মনটা বিষাদে ভরে যায়। জীবনযুদ্ধে সারাহ এক সংগ্রামী নারী এক সংগ্রামী মা। ওর মেয়েটাকে বুকে জড়াবার এক ব্যাকুলতা নিয়ে ওর কাছে বিদায় নিয়ে চলে আসি। (সারাহ’র সাথে আমার ছবি আছে কিন্তু ওকে যেহেতু বলা হয়নি আমি ওর ছবি দিলাম না)।
এই চমৎকার দেশে আমি এসেছি বেঁচে থাকার রসদ কুড়াতে, আনন্দময় হীরকুকুচি সঞ্চয় করতে... কাজেই মন খারাপের পোটলাটা তালাবদ্ধ রেখে আমরা শপিং করি, ফুডকোর্টে বসে টারকিস পিডে, চিকেন কাবাব, ফিসফ্রাই, আর আখের রসের অপুর্ব স্বাদের এক ড্রিংক্স খেয়ে ফিরতি পথ ধরি। (চলবে)...
আগের পর্ব পরের পর্ব
কাজী লাবণ্য, ঢাকা থেকে
|