দোয়েলের চোখে কুকাবারা (৬) মরিসেট কাজী লাবণ্য
আগের পর্ব পরের পর্ব
এই অভিনব প্রাণীটি একেবারেই অস্ট্রেলিয়ার নিজস্ব। প্রাণীটি উপজঠরী (marsupial)। পেটের তলার থলিতে শাবক বহন করে। মারসুপিয়াল গোত্রের এক প্রকারের স্তন্যপায়ী প্রাণী। এদের কেবলমাত্র অস্ট্রেলিয়া ও প্রতিবেশী দ্বীপগুলিতে দেখা যায়। এরা পিছনের দুই পায়ের উপর লাফিয়ে লাফিয়ে চলে। মারসুপিয়াল বলে এরা অপরিণত বাচ্চার জন্ম দেয়। বাচ্চাগুলি মায়ের পেটের থলিতে থেকে বড় হয়।
এরা কেবল অস্ট্রেলিয়ার মূল ভূখণ্ডে, নিউগিনিতে এবং আশেপাশের দ্বীপগুলিতে, যেমন তাসমানিয়াতে পাওয়া যায়। পরে, অন্য কিছু দেশে এদেরকে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। যেমন নিউজিল্যান্ডে টাম্মার এবং হাওয়াইতে ওয়ালাবির বসতি স্থাপন করানো হয়েছে। এদেরকে অস্ট্রেলিয়া ও নিউগিনির প্রায় সর্বত্র দেখতে পাওয়া যায়। এদের অনেক প্রজাতির অভিযোজন ক্ষমতা প্রবল। এরা উন্মুক্ত পার্ক, বাগান, এমনকি গল্ফ কোর্সেও বাসা গড়ে।
জোসেফ ব্যাংকের ১৭৭০ সালের ১২ই জুলাইয়ে ডায়রির পাতায় ক্যাঙ্গারু কথাটার প্রথম দেখা পাওয়া যায়। বর্তমানে যেখানে কুকটাউন অবস্থিত সেখানে ক্যাপ্টেন কুকের জাহাজ গ্রেট ব্যারিয়ার রিফের সঙ্গে সংঘর্ষে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। জাহাজ মেরামতির জন্য সাত সপ্তাহ তাদের সেখানে থাকতে হয়েছিল। জোসেফ ব্যাংক ও ক্যাপ্টেন কুক এখানে এদের দেখতে পান। একটা গল্প প্রচলিত আছে যে, তারা এক আদিবাসীর কাছে প্রাণীটার নাম জানতে চান। সেই আদিবাসী বলেন “কংগুরু” (Kanguru), অর্থাৎ “আমি তোমাদের কথা বুঝতে পারছি না”। কুক ও তার সঙ্গী ভাবে প্রাণীটার নামই বুঝি ক্যাঙ্গারু। এইভাবে ক্যাঙ্গারু নামটা সভ্য সমাজে প্রচলিত হয়ে যায়। ডিসেম্বর পেরিয়ে জানুয়ারি চলছে। এখানে ‘সামার’। কন্যা বলেছিল শীতের কোন কাপড় আনবা না। আর লাগলেও আমার তো আছেই। তবু কি মনে করে, হালকা একটা জ্যাকেট এনেছিলাম। এখন সেটাতো সেটা, কন্যার সোয়েটার বা জ্যাকেটও পরে ঘুরছি। এমন হুহু করা বাতাস বয় যে আমার শীত করে। আমি যে ঘরটাতে ঘুমাই সেটির পাশেই বিল্ডিঙের পকেট থাকায় যখন বাতাস বয়, এমন একটা হাহাকার ধ্বনি শোনা যায়, আমার বুকের ভেতর অকারণে হুহু করে ওঠে। কন্যা ভয় দেখায়- “আম্মু, ঐ যে শোন ডাইনী বুড়ির নিশ্বাস, ভয় পাচ্ছো? ভয় পেওনা”... ওর কাছে আমি যেন এক বঙ্গদেশীয় বালিকা... বাঙালী জাতির শৌর্য বীর্যের প্রতীক আমাদের জাতীয় পশু ‘রয়েল বেঙ্গল টাইগার’ বাঘ আমাদের ইতিহাস ঐতিহ্য আর সংস্কৃতির সাথে অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িয়ে আছে। আমরা আজও কোন ব্যক্তির সাহসিকতা কিংবা অসাধারণ কোন কাজের তারিফ করতে গিয়ে বলে থাকি “একটা বাঘের বাচ্চা”। বাংলাদেশের ক্রিকেট খেলাকে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে কেউ আর বাংলাদেশ ক্রিকেট না বলে, বরং বলে থাকে “রয়েল বেঙ্গল টাইগার্স” বাঙালীত্বের প্রতীক এই বাঘ আজ অতি সংকটময় দশায় টিকে আছে কেবল সুন্দরবনে। হয়ত আর কয়েকবছর পরে তাও থাকবেনা। চিড়িয়াখানা কিংবা ইন্টারনেটেই দেখে আমরা বলতে পারব যে “আমাদের দেশে বাঘ ছিল এককালে”। আমাদের জাতীয় প্রাণী ‘দ্যা রয়েল বেঙ্গল টাইগার’ দেখেছি চিড়িয়াখানায় এদের জাতীয় পশু ক্যাঙ্গারু দেখতে এক ছুটির দিনে চললাম মরিসেট। লং ড্রাইভ। অপূর্ব নৈসর্গিক দৃশ্য রাস্তার দুপাশে। মাঝে মাঝেই রাস্তার ডিভাইডার হিসেবে দাঁড়িয়ে আছে খাঁড়া পাহাড়। আর দুপাশে এক ধরনের ছাই ছাই গাছপালা আর ফার্ন নিয়ে ঋজু পাহাড়েরা। যাদের গা ঘেঁষে মসৃণ মোটর ওয়ে যা আমাদের এখানে হাইওয়ে নামে পরিচিত। সেই পথ ধরে শাঁ শাঁ করে ছুটে চলেছে গাড়ী। রাস্তা কোথাও অনেক উঁচু আবার ঢালু আবার চলতে চলতে উপরে উঠছি। তবে একটা জিনিস, আকাশ এখানে প্রবলভাবে নীল। সেই প্রগাঢ় নীলের উপর কার্পাস তুলো মেঘ ঘুরে বেড়ায় নিজ আনন্দে। রাস্তার দুপাশে বিস্তীর্ণ ঘাস-জমি বিছিয়ে রয়েছে একরের পর একর ধরে। কোথাও বৃক্ষরাজি আবার কোথাও লম্বা লম্বা শুকিয়ে আসা ঘাস। এই ফাঁকা পতিত তৃণভূমি দেখে নিজের অজান্তে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলি...। অনেক আগে টিভিতে দেখা রবিন হুডের মধ্যযুগীয় গল্পে এই নায়কের যে ওস্তাদ (নামটা মনে করতে পারছিনা) তাকে একটা ম্যাজিক দণ্ড বা লাঠির মত জিনিস দিয়ে বলতো এ তোমাকে পথ দেখাবে... রবিন সেটা নিয়ে অজানা অচেনা দীর্ঘপথ পাড়ি দিত। আমার কাছে মনে হয়, বহু আগে দেখা সেই জাদুর লাঠি-ই আজকের বিজ্ঞানের অবদান অপরিহার্য “জিপিএস”। জিপিএসের দেখানো পথ ধরে চলেছি... সৌন্দর্যমন্ডিত পথ দেখে মনে হচ্ছে- “এই পথ যদি না শেষ হয়, তবে কেমন হত”!
পথের এক জায়গায় থেমে আমরা দুপুরের খাবার খেয়ে নিলাম। একধরনের রুটি, আস্ত সামুদ্রিক মাছের গ্রিল, সস, সালাদ, আইসক্রিম নানা কিছু। এদেশে যখন, যেখানে যা খাচ্ছি অসম্ভব মজা লাগছে। যা দেখে আমার সন্ততিরা খুশি।
ধীরে ধীরে আমরা অনেক দূরের এক নিভৃত পল্লীর মতো সাবার্বে ঢুকে গেলাম। রাস্তার পাশেই পার্কিং, সেখানে গাড়ি পার্ক করে নেমে পড়লাম।
একটা ফাঁকা মাঠ, যার পেছনেই ঘন জঙ্গল সেখানে ঘুরে বেড়াচ্ছে নানা আকারের ক্যাঙ্গারু। রাস্তার পাশে বিশাল বোর্ড, সেখানে এখানকার নিয়ম কানুন লেখা আছে, এও লেখা আছে যে ওদেরকে কোন খাবার দেয়া যাবেনা। কিন্তু দেখলাম অনেকেই গাজর, কপি ইত্যাদি খাওয়াচ্ছে কিন্তু ওরা তা আগ্রহ নিয়ে খাচ্ছে না। আমরা নিয়ে গিয়েছিলাম পাউরুটি। ওমা যেই একটুকরো দেয়া হলো- অমনি সবাই একসাথে পাউরুটির উপর চড়াও হলো। রাফেদ চারিদিকে ছড়িয়ে ছিটিয়ে দিলে নিমিষেই ওরা সেগুলি সাবার করে ফেলে আরো খেতে চাচ্ছিল। এবারে আরেকটা পাউরুটি বের করলে সবাই চলে এলো রুটির কাছে। সাইজে বড়গুলো সামনের দু’পা ছেলের গায়ে তুলে দিলে... ও ভয়ে পাউরুটি ছুঁড়ে ফেলে দৌড়ে আরেক দিকে চলে গেল। আর মেয়ে ত ধারে কাছে এলোই না ভয়ে, কিন্তু ক্যাঙ্গারুর সাথে সেলফি নাহোক একখান ছবি তো তুলতে হবে! শেষে ওরা খেয়েদেয়ে সরে গেলে, যেদিকে ছোট ছোট ছিল তাদের ছবি তোলা হলো।
এখানেও এত প্রতুল বৃক্ষরাজি আর বিছিয়ে থাকা খালি জমিন... দেখে কেন যেন মনটা বিষণ্ণ হয়ে যায়... অবশ্য, অদৃশ্য সুখপাখিটি ডেকে উঠলে বিষণ্ণতা পালাবার পথ পায়না...
(চলবে...)
আগের পর্ব পরের পর্ব
কাজী লাবণ্য, ঢাকা থেকে
|