দোয়েলের চোখে কুকাবারা (৫) অপেরা হাউজ কাজী লাবণ্য
আগের পর্ব পরের পর্ব
একটা অদ্ভুত রকম সোনালি সন্ধ্যায় কন্যা লীলাবতী কাজ শেষে ফিরে এলে আমরা সবাই রেডি হয়ে বের হয়ে পড়লাম। গাড়ি ছুটে চলেছে প্যারাম্যাটা রোড ধরে। এই রোড সিডনি ভার্সিটি থেকে দ্বিতীয় শহরকেন্দ্র, প্যারাম্যাটা পর্যন্ত গিয়েছে। এরপরে রোডটি গ্রেটওয়েস্টার্ন হাইওয়ে নামে চলে গেছে ব্লু মাউন্টেইন পর্যন্ত। পৃথিবীর শহরগুলোর কি আলাদা করে কোন নির্দিষ্ট চেহারা আছে? থাকলে সেটা কি? লন্ডন, নিউইয়র্ক, প্যারিস কিংবা সিডনী শহরের চেহারায় নির্দিষ্ট বা স্পেসেফিক কি চিহ্ন আছে যা দিয়ে সেই শহরটাকে চিনে নেয়া যায়! আইফেল টাওয়ার, লন্ডন ব্রিজ, বিগবেন, স্ট্যাচু অফ লিবার্টি, বা এম্পায়ার স্টেট বিল্ডিং দিয়ে কোন শহরকে আসলেই কি চেনা যায়! কোন শহরের চারিত্র্য নির্ভর করে তার বাড়িঘরের চেহারার উপর। কোন ‘আইকনিক’ স্ট্রাকচারের উপর নয়। বাড়ির দরজা, জানালা, ব্যালকনি, রাস্তার রেলিং, স্ট্রিট ল্যাম্প, বিনের নির্মান শৈলীর ভেতর দিয়েই একটি শহরের নিজস্বতা খুঁজে পাওয়া যায়।
পথের দুপাশে পরিচিত এবং অপরিচিত গাছের সারি। সাদা দেয়ালের মাথায় লাল, এ্যাশ, হালকা নীল টালির টুপি পরা অদ্ভুত বাড়িগুলো যেন সারা অবয়বে একটা সরল বাঙালি আমন্ত্রণ মেখে দাঁড়িয়ে আছে। কি যেন বলতে চায়! কি যেন বোঝাতে চায়! বোঝাতে চাইলেও সভ্যতা এবং ম্যানার্সের বেড়াজাল আমরা অতিক্রম করতে পারি না। প্রতিটি বাড়ির সামনে বিভিন্ন গাছ- বেশীরভাগ ঝাউ, চাঁপা, গন্ধরাজ, জবা এবং বটলব্রাশ। এখানে আসার পর থেকেই আবিষ্কার করছি, আমার অতি পরিচিত গাছ যেমন কামিনী, গন্ধরাজ, কাঠচাপা, ঝাউ, জবা, হাসনাহেনা আর নিম সারা সিডনি জুড়ে বিরাজমান, যা আমি ঢাকা শহরেই কম দেখেছি। খুব অবাক হয়েছি হাজার হাজার মাইল দূরের বাংলার গাছপালা এখানে এলো কি করে! নাকি এখান থেকেই বাংলায় গিয়েছিল! যাই হোক এই পরিচিত গাছপালা যেন আমায় এ শহরকে আরো বেশী আপণ করে তুলে ধরতে সাহায্য করছে।
বাড়িগুলির গায়ে স্পষ্ট সংখ্যায় নম্বর লেখা। আমার খুব ইচ্ছে করে একটা অজানা বাড়ির ভেতরে ঢুকে পড়ি। দেখে আসি তাদের অন্দরমহল। হতে পারে এরা বৃটিশ, লেবানিজ, চাইনিজ, ভারতীয়, আফগান, বাংলাদেশী কিংবা পৃথিবীর কোন এক ভূখন্ডের। হতে পারে তাদের ভাষা, উচ্চতা, বর্ণ আলাদা কিন্তু তারা যে একই মানুষ তা আমি জানি আর এ জানায় আমি বিশ্বাস হারাতে চাইনা। আমরা পার হয়ে যাচ্ছি একের পর এক ব্রীজ, হাই রাইজ বিল্ডিং, ছোট ছোট পোর্ট এবং তারপরই সামনে চলে এলো সেই বিখ্যাত চমক- হারবার ব্রীজ ও অপেরা হাউজ। অস্ট্রেলিয়া একটি দ্বীপ মহাদেশ। মহাসাগরের এক প্রান্তে সিডনি বন্দরে অপেরা হাউজের অবস্থান। এটি দেখতে অনেকটা নৌকার পালের মত। বিশ্বের কোটি কোটি পর্যটকদের আকর্ষণের কেন্দ্রবিন্দু এই অপেরা হাউজ।
সুইডিশ স্থপতি জর্ন আটসন এর নকশায় তৈরি আধুনিক স্থাপত্যকলার অন্যতম নিদর্শন ‘সিডনি অপেরা হাউজ’ ১৯৭৩ সালের ২০ অক্টোবর আনুষ্ঠানিকভাবে উদ্ভোধন করেন রাণী দ্বিতীয় এলিজাবেথ। সেসময় প্রচুর আতশবাজি ফোটানো হয় এবং বিটোভেনের ৯নং সিম্ফোনী পরিবেশন করা হয়। বিস্মিত চোখে তাকিয়ে আছি সেই অপেরা হাউজের দিকে। স্থাপনাটির ভেতরে রয়েছে ২,৬৭৯ সিটের কনসার্ট হল, ১৫০৭ সিটের অপেরা থিয়েটার, ৫৪৪ সিটের ড্রামা থিয়েটার, ৩৯৮ সিটের প্লে হাউস এবং ৪০০ লোক একসাথে কাজ করার মতো স্টুডিও। কনফিগারেশন পরিবর্তন করে এইসব হলের আয়তন ও সিট ক্যাপাসিটি বাড়ানো বা কমানো যায়। বছরে প্রায় ৮০ লাখ মানুষ এই অপেরা হাউজ পরদর্শনে আসেন।
এরপরে আমরা চলে যাই হারবার ব্রিজের গোঁড়ায়। এটি পৃথিবীর ২য় প্রশস্ত ব্রিজ। যেটি প্রায় ৯ বছরের দীর্ঘ নির্মান কাজ সমাপ্ত করে ১৯ জানুয়ারি ১৯৩২ সালে সকলের জন্য উম্মুক্ত হয়। সিডনিবাসীর কাছে ‘কোর্ট হ্যাঙ্গার’ বলে পরিচিত এ ব্রিজ যখন উম্মুক্ত হয় তখন এটি প্রথমবারের মতো সিডনির বিখ্যাত পোতাশ্রয়ের উত্তর ও দক্ষিণ প্রান্তের মধ্যে সংযোগ রচনা করে। প্রতি বছর গ্রেগরিয়ান নববর্ষের সময় ব্রিজ, নিকটবর্তী অপেরা হাউজ এবং আশপাশের পোতাশ্রয়ের দুই প্রান্তে অনুষ্ঠিত হওয়া আতশবাজির খেলা উপভোগ করতে সারাবিশ্ব থেকে এখানে ভিড় জমায় উৎসাহী পর্যটকেরা। পৃথিবীর মানুষের কাছে এটি অসম্ভব আকর্ষণীয় একটি বিষয়।
হারবারের তীরে প্রবল বাতাস গায়ে মেখে আমরা মুগ্ধ চোখে দেখতে লাগলাম এই ব্রীজ আর অপেরা হাউজ। নাচুনি বুড়ির সাথে ঢোলের বাজনার মত আকাশে দেখা দিল পুর্ণিমার মস্তবড় চাঁদ, প্রচুর ছবি তুলে, একটি লেবানিজ রেস্টুরেন্টে ‘চারকোল চিকেন’ (যা পরে ইতিহাস রচনা করে) খেয়ে আমরা চলে এলাম বাসায়। এই খাবারের সাথে গার্লিক সস নামে একটি সস দিয়েছিল যেটি আমার কাছে অসম্ভব সুস্বাদু লেগেছে।
বাসায় এসে শুয়ে পড়লাম, কিন্তু ঘুম আসেনা। এদের রাত ভোরের দিকে গেলেও আমার চোখ থাকে দীপ্ত, ডালাখোলা বাক্স, বন্ধ হয়না কারণ আজন্মের দেহঘড়িতে তখন কেবল কলির সন্ধ্যে। দেশে তখন মাত্র পাখিরা কুলায় ফিরছে, আমিও প্রযুক্তির বাটন স্পর্শ করা মাত্রই শুনতে পাই, ওহ্ শোনা নয় দেখতে পাই “কেমন আছ? সব খবর ভালোত? খুব এঞ্জয় করছ বুঝি?” (চলবে...)
আগের পর্ব পরের পর্ব
কাজী লাবণ্য, ঢাকা থেকে
|