দোয়েলের চোখে কুকাবারা (৪) রেইনলিলি ও গালিপলি কাজী লাবণ্য
আগের পর্ব পরের পর্ব
শিশু বেলায় ফুল, পাখি, প্রজাপতি, রঙধনু পেলেই হা করে তাকিয়ে আনমনা হয়ে যেতাম আর সব শিশুদের মতই। গঙ্গাফড়িং যে কত অজস্র বর্ণ ও আকৃতির হয় তা আমি খুব জানতাম... “প্রজাপতির পাখা আমার আকাশ চাওয়া মুগ্ধ চোখে রঙিন স্বপ্ন মাখা” …
বাড়ির কাছেই মসজিদ, মসজিদের পাশেই প্রাচীন কবরস্থান, পাশে বিশাল এক তেঁতুল গাছ, কেমন যেন একটি গা ছমছম অদ্ভুত জায়গা, বাড়ি থেকে বেড়িয়ে সেতুটি পার হলেই। ছোট্ট বালিকার কাছে একটি আকর্ষণীয় জায়গা। না, মসজিদের কারুকাজ বা আধ্যাত্মিক কোন ব্যাপার নয়। মসজিদের সামনে ডানপাশের দেয়ালের ধার ঘেঁষে ফুটে থাকা কিছু ফুল, কুলীন কিছু নয়। তখন আমাদের বাড়ির সামনে মস্ত ফুলের বাগান, বাগান জুড়ে কুলীন সব ফুলের পদচারণা... অদ্ভুত সাদা, হালকা, গাঢ় গোলাপি সুগন্ধি গোলাপ, গন্ধরাজ, নানাধরনের জবা, বেলি সহ অনেক প্রকার ফুল, পাতাবাহার। কেবল এই ঘাস ফুলটিই (নাম জানিনা) ছিলনা। তাতে কি! আমাদের মসজিদ প্রাঙ্গণেই তো আছে। কচি সবুজ লকলকে চিকন পাতার মাঝখানে ডাটির মাথায় ফুল...গুচ্ছ গুচ্ছ ফুল...অগুনতি কুঁড়ি...
আমি সুযোগ পেলেই আমাদের দেখাশোনার জন্য যারা ছিল তাদের কারো একজনের হাত ধরে মসজিদের গেটের কাছে যাই, অপার মুগ্ধতায় মগ্ন তাকিয়ে থাকি মাথা দোলানো সবুজ পাতার মাঝে গাঢ় গোলাপি রঙ ফুলগুলির দিকে। এই অলিক ফুল আমাকে চুম্বকের মতো টানত। একদিন চুম্বকের আকর্ষণে পায়ে পায়ে কিছুটা ভেতরে চলে গেছি একেবারে হঠাত চোখ চলে যায় মসজিদ অভ্যন্তরে। সেখানে সাদা পরিচ্ছদের কিছু মানুষ ইবাদতে মগ্ন ছিলেন, যে জিনিসটা শিশুমনকে অবাক করল সেটি হচ্ছে মসজিদের গম্বুজের ভেতরের অংশটা। কি অদ্ভুত! সিলিং নেই, উঁচু গোল, সাদা ফাঁকা একখণ্ড আকাশ!
জানিনা, শিশুমনে তখন সেটা একটা অন্যরকম প্রভাব ফেলেছিল। এর পরে আমার আকর্ষণ বা কৌতূহল হয়ে উঠল মসজিদের ভেতর দেখার, সত্যি-ই কি সেখানে গোল আকাশ দেখা যায়! সেই বয়সেই জেনে গেছি মসজিদে প্রবেশ নিষেধ, কেউ বলেনি কিন্তু জানা কথা, বাতাসে ভাসে, হোক না সেটা কাজীদের মানে আমারই পূর্বপুরুষদের মসজিদ! আচ্ছা আমি না হয় দরজা থেকেই ভেতরটা দেখব, এই দেখতে গিয়ে একদিন একজন আমাদেরকে ধমক দিয়ে বাড়ি পাঠিয়ে দিলেন।
না, ঠিক রাগ নয় কিন্তু একটা বিবমিষা, একটা অসম্ভব মন খারাপের দলা! আর কোনদিন যাইনি, কিন্তু এক প্রবল আগ্রহ ইচ্ছা ভেতরে নিয়ে আমি বড় হতে থাকি, স্বভাব মতো কাউকে ইচ্ছের কথা জানাইনি। তবে প্রায়ই স্বপ্নে মসজিদ দেখি, আসলে মসজিদ অভ্যন্তর দেখি, উপরে ডোমাকৃতির গোল আকাশ, সারি সারি স্তম্ভ, সাদা পরিচ্ছদের ইবাদতে মগ্ন মানু্ষ, বিচিত্র স্বপ্ন...
আমাদের শহরের বাসার একদম কাছে রংপুরের নামকরা কেরামতিয়া মসজিদ। ঘাসফুল বালিকাকে, ফুল, প্রজাপতির পেছনে রেখে তখন আমি অনেক বড়- সংসার নামক এক অতল সমুদ্রে জলের সাথে জলকেলি করছি, তাতে কি! স্বপ্ন মরেনা, বিশেষ করে শৈশব স্বপ্ন, ফিরে ফিরে আসে, স্বপ্নে বা জাগরণে। গুনগুন করি – “ভেঙে মোর ঘরের চাবি নিয়ে যাবি কে আমারে”... একদিন, লোপা ভাবিকে বললাম- অনেক মহিলা নাকি কেরামতিয়া মসজিদে নামাজ পড়ে, চলো আমরাও পড়ে আসি। ভাবি রাজি হলোনা। আমিও আর গেলামনা। বুঝে গেলাম এই মসজিদ দেখা স্বপ্ন আর পুরবেনা, এটাই আমার জন্য নির্ধারিত। আরো অনেক ইচ্ছের সাথে ধিরে ধিরে ভুলে গেলাম ব্যাপারটা...আসলে কি মানুষ এত সহজে ভোলে!
কিছুদিন আগে অস্ট্রেলিয়া গিয়ে সেই বালিকাকালের ইচ্ছে পূরণের সুযোগ এলে হাতছাড়া করলাম না। সেখানকার দুটি মসজিদে আমি নামাজ আদায় করলাম এবং মসজিদের ভেতর বাহির, তাদের নিয়ম রীতি জানলাম, দেখলাম। প্রথম মসজিদটি হলো- সিডনীর অবার্ণ সাবার্বে টার্কিশ কমিউনিটির “অবার্ণ গালিপলি মসজিদ”। এটি বাইজেন্টাইন স্থাপত্যে, ইস্তাম্বুলের হাজিয়া সোফিয়ার আদলে নির্মিত। প্রথম মহাযুদ্ধের সময় অস্ট্রেলিয়া ও নিউজিল্যান্ডের সৈনিকরা তুরস্কের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে গিয়ে সেখানকার গালিপলি নামক স্থানে অসংখ্য সৈন্য নিহত হয়। পরে ঐ স্থানের নামানুসারে সিডনির টার্কিশ কমিউনিটি এই মসজিদের নামকরণ করে। তুরস্কের গালিপলিতে এখনও সেই সৈনিকদের সমাধিস্থল রয়েছে। আজো ANZAC Day তে অস্ট্রেলিয়া ও নিউজিল্যান্ড থেকে প্রচুর মানুষজন শ্রদ্ধা জানাতে ঐ সমাধিস্থলে উপস্থিত হয়।
এই মসজিদে প্রতিদিন ৫ ওয়াক্তে শ’পাঁচেক এবং শুক্রবারে জুম্মা সালাতে দু/ আড়াই হাজার নারী পুরুষ নামাজে অংশ গ্রহণ করেন। আমিও এখানে জুম্মা সালাতেই গিয়েছিলাম। এখানে প্রশস্ত একটি জায়গায় অসংখ্য কোরান শরীফ, বিভিন্ন ধর্মীয় বই, ইয়া বড় বড় তসবিহদানা... ইচ্ছে করলেই কেউ এসব ব্যবহার করতে পারে। কেউ ধমক দিয়ে বের করে দেয়না।
আরেক মসজিদে আমি মাগরিবের নামাজ আদায় করি সেটি হচ্ছে- মূলত, লেবানিজ অধ্যুষিত এলাকার “মসজিদ আলি বিন আবু তালিব”, এটি লাকেম্বায় অবস্থিত এখানে প্রচুর বাঙালি বাস করেন। এটি লেবানিজ মুসলিম এ্যাসোসিয়েশন পরিচালনা করে। মুসলমানরা কেউ মারা গেলে এখানে গোসল দেয়া, সংরক্ষণ করা এবং দেশে প্রেরণের ব্যাপারেও সহযোগিতা দেয়া হয়ে থাকে। ঢাকার মোহাম্মদপুর বাবর রোডে অবস্থিত মারকাজুল নামে এক প্রতিষ্ঠান এধরণের কাজ করে থাকে। এই মসজিদ গুলোতে খুব সাবলীলভাবে মহিলারা নিয়মিত নামাজ পড়েন, বা অন্যান্য ইবাদত করতে পারেন।
দেশে ফিরে যখন এই লেখা লিখছি, একদিন ফেসবুকের পাতায় আমার চোখ আটকে গেল, হৃৎপিণ্ড লাফিয়ে উঠল, এই সেই আমার বালিকাবেলার ফুল যার নাম “রেইন লিলি”। ব্রাজিলীয় লেখক পাওলো কোয়েলহো তার আলকেমিষ্ট বইয়ে বলেছেন “যখন তুমি কিছু চাও, তা পেতে পুরো বিশ্বব্রহ্মাণ্ড একযোগে তোমাকে সাহায্য করে”। দেরিতে হলেও সাহায্যটা আমি পেলাম। সেজন্যে আমি অশেষ ধন্যবাদ জানাই আমার সন্তানদের।
**নামাজ শেষে, ক্ষণিক পরিচয়ের সেই লেবানিজ পার্শ্ববর্তিনীর উদ্দেশ্যে আমার কটি পংতি-
এখানে না এলে প্রতীতি জন্মাবে না তোমার এ গলির পরে ও গলি, পাড়ায় মহল্লায় চোখে পড়ে ঝকঝকে মিনার, গম্বুজ, পরিচ্ছন্ন দেয়াল প্রতিধ্বনিত হয় সুমধুর বেলালের ধ্বনি এসবই কেবল এখানে মানুষদের এখতিয়ারে নারী তুমি অচ্ছুত, এমনকি ঐ ফুলবালিকাও গাছেরা পথ মাপে আয়নায়- সেখানে চেনা হরফে লেখা থাকে ‘নারীরাও মানুষ’! হায়! এ হরফ মানুষেরা পড়তে জানেনা।
(চলবে)...
আগের পর্ব পরের পর্ব
কাজী লাবণ্য, ঢাকা থেকে
|