দোয়েলের চোখে কুকাবারা (৩) লা পেরুজ বিচ কাজী লাবণ্য
আগের পর্ব পরের পর্ব
অস্ট্রেলিয়াতে এসে প্রথমেই যে জিনিসটি আমার সবচেয়ে বেশী ভাল লাগছে, সেটা হলো এই মহাদেশটির প্রাকৃতিক সৌন্দর্য! যে কারো মাথা খারাপ করে দেবার মত। আমি শুধু অবাক দুচোখ ভরে দেখছি। কি নেই এখানে! সুদৃশ্য সীবিচ থেকে শুরু করে মরুভূমি পর্যন্ত আছে! আজ আমরা গেলাম বোটানি বে’র লা পেরুজ বিচ এ। এরা আমাকে জানায়নি যে কোথায় যাচ্ছি- সারপ্রাইজ। আমির খানের জনপ্রিয় হিন্দি ছবি দিল চাহতা হ্যাঁয় এর শুটিং হয়েছিল যে টানেলে সেই এম ফাইভ টানেল পেরিয়ে এয়ারপোর্টের পাশ দিয়ে গাড়ি চলছে। আমি এখানে পৌঁছেছিলাম রাতের বেলা। ল্যান্ডিঙের সময় নিচে তাকিয়ে মনে হচ্ছিল বুঝি সমুদ্রের জলে ল্যান্ড করতে যাচ্ছি। এয়ারপোর্টের পূর্বপশ্চিমে একটি রানওয়ে, আরেকটি উত্তর দক্ষিণে টানা। পৃথিবীর অন্যান্য এয়ারপোর্টের তুলনায় অতিবৃহৎ না হলেও এটি একটি বিশাল এয়ারপোর্ট। এর নিচ দিয়ে আন্ডার গ্রাউন্ড ট্রেন লাইন গেছে যা পূর্বপশ্চিমের দুটি টার্মিনাল বিল্ডিং কে শহরের সাথে সংযুক্ত করেছে। ডোমেস্টিক টার্মিনাল পূর্বদিকে, ইন্টারন্যাশনাল পশ্চিম দিকে। আমাদের গাড়ি আরেকটি ছোট টানেল যখন পেরুচ্ছিল ঠিক মাথার উপর দিয়ে একটি প্লেন দৌড়চ্ছিল, আসলে মাথার উপরেই ছিল রানওয়ে।
এয়ার পোর্ট পেরিয়ে আমরা ধাবিত হচ্ছি বোটানি বে’র দিকে। দূর থেকেই দেখা যাচ্ছে গাঢ় সবুজ ঘন বেষ্টনী, বৃক্ষদেয়াল, ছুটন্ত গাড়ির জানালায় কত যে অচেনা বৃক্ষরাজি, নাম না জানা ফুল, পাহাড়চূড়া, গাড়ি ছুটে চলছে, মনে হচ্ছে যানজটে থামলে দু’চোখ ভরে পথপাশের নৈসর্গিক দৃশ্য দেখতাম। কখনও কখনও যানজটও বুঝি উপাদেয় হয়! পাহাড়ের গা ঘেঁষে মসৃণ কয়েক লেনের চওড়া রাস্তা উদার বুক পেতে রেখেছে পথিকের জন্য। কিছুদূর চলার পর গাড়ি বাঁক নিলে আমার চোখ ছানাবড়া! সামনেই এক অপূর্ব দৃশ্য- যেন সেটি এ জগতের নয় অন্যকোন অলৌকিক জগতের অথবা সেটি বাস্তবের নয়, সেটি একটি সুদৃশ্য বিশালাকৃতির ভিউকার্ড। এত সৌন্দর্য এই ধূলির ধরার!
সুনীল সাগরের জল, মাথায় শ্বেতশুভ্র টুপি পরে আছড়ে পড়ছে পরিচ্ছন্ন হালকা গোলাপি পাটাতনের উপর, ঢেউ ভেঙ্গে জীবন্ত জলেরা আবার গড়িয়ে যাচ্ছে সাগরতলে। বিস্তৃত সবুজ ঘাসে আচ্ছাদিত পাড়ে অগণিত নয়নলোভা ঝাকেঝাক নির্ভীক সি-গাল ঘুরে বেড়াচ্ছে, দূরে পাহাড়, ঘন বৃক্ষরাজি... মাথা খারাপ হবার মতো দৃশ্য। গাড়ি থেকে নেমে দাঁড়ালাম মন যেন কেমন করে উঠল- বিপুলা সৌন্দর্যের মুখোমুখি হলে মানুষ মনেহয় এক ধরনের বিষাদাক্রান্ত হয়ে পড়ে...
একটি অতি প্রাচীন-গন্ধী কাঠের সাঁকো পেরিয়ে আমরা নিচে নেমে গেলাম। হয়ত এরা সাঁকোটি আগের মতই অবিকৃত রেখেছে বলেই এমন প্রাচীন। পায়ের তলায় অর্ধবৃত্তাকার পাথুরে উপতট দেখে মনে হয় মূল্যবান টাইলস নির্মিত মেঝে। কোথাও কোথাও বয়সী স্যান্ড-স্টোন খানাখন্দ নিয়ে বুক পেতে রেখেছে, পাশেই একটি উঁচু পাথুরে পাহাড়। পাহাড়ের গায়ে অদ্ভুত খাঁজকাটা, সে খাঁজ কোথাও গভীর, কোথাও আঁকাবাঁকা, কোথাও কার্নিশের মতো ছাদ বিনির্মাণ করেছে। স্তরের পর স্তর এই খাঁজ বিভিন্ন মাত্রার গোলাপি বর্ণে বর্ণিল। এই পাহাড় দেখে আমার চিটাগাঙের ‘বাটালি হিল’ এর কথা মনে পড়ে গেল। সেখানকার গাছপালা বেষ্টিত হলুদরঙ এক বাংলোতে আমরা কয়েকবছর ছিলাম। সেসময় আমরা প্রায়ই বাটালি পাহাড়ের চুড়ায় ওঠে যেতাম, পরে সেখানে সিঁড়ি তৈরি হয় আর গড়ে ওঠে একটি বিজয় স্তম্ভ। চট্টগ্রামের টাইগারপাস এলাকায় অবস্থিত শহরের সর্বাধিক উঁচু এই পাহাড়ের চুড়া থেকে বঙ্গোপসাগর এবং চট্টগ্রাম শহরের একটা বড় অংশ পরিষ্কার দেখে যায়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়ে এই পাহাড়ের চূড়ায় বিধ্বংসী কামান স্থাপন করা হয়েছিল।
অবশ্য আমাদের দেশের পাহাড় মাটির তৈরি। প্রতি বছর এখানে পাহাড় ধ্বসে প্রাণহানি ঘটে থাকে। এই যে বারবার এমন মর্মান্তিক ঘটনা ঘটে, তা কি নিছক প্রাকৃতিক দুর্যোগ! নাকি পাহাড়খেকো নামক কিছু প্রাণীর ভূমিকা! আমরা পাহাড়কে নিজস্ব নিয়মে থাকতে দেইনা, নদীকে নিজস্ব গতিতে চলতে দেইনা, উন্নয়নের নামে প্রতিনিয়ত পাহাড়-বন-নদী হত্যা করে চলেছি এখন প্রকৃতিও প্রতিশোধ নিচ্ছে।
মাথায় দুধ-সাদা কাশফুল নিয়ে বিপুলা উর্মিমালা ছুটে আসছে গোলাপি সৈকতে, যেন খলবলে এক শুভ্র শিশুর দল ছুটে আসছে মায়ের বুকে ঝাঁপাতে। অদূরেই এয়ারপোর্টে টপাটপ ল্যান্ড করছে বিশাল এক একটি যান্ত্রিক পাখি।
সত্যি সত্যি মুগ্ধপাগল হয়ে গেলাম। সি-গাল গুলোকে খাবার খাওয়ালাম, ওদের জন্য খাবার আনা হয়েছিল। কন্যা দূরে দূরে রইল, এমনিতে সাহসী কিন্তু জানিনা কেন সে অসম্ভব ভয় পায় পক্ষীকুলকে। এখানকার পাখিরা মানুষজনকে একটুও ভয় পায়না, মানুষ ওদের কাছে ভীতিকর প্রাণী নয়। পাহাড়ের উল্টোদিকে সবুজ বিশাল প্রান্তরের মাঝে নিঃসঙ্গ দাঁড়িয়ে রইল একটি মিউজিয়াম। মিউজিয়ামের প্রতি তেমন আকর্ষণ বোধ করিনা।
আমরা যখন উঠে আসছিলাম তখন দলেবলে নবদম্পতিরা বিভিন্ন পোজে ছবি তুলছিল, ভিডিও করছিল। এখানকার নয়নাভিরাম স্থানগুলিতে এমন হরহামেশাই হয়ে থাকে। এখানে এটাই কালচার। তবে ছবির এই পোজ দিতে গিয়ে ছোটখাটো দুর্ঘটনাও ঘটে। অবশ্য সেগুলিকে দুর্ঘটনা না বলে মজার ঘটনা বলা যায়। লা-পেরুজ দেখা হয়ে গেল, আসলে কি দেখা হয়ে যায়! সৌন্দর্য পিপাসা মানুষের মেটেনা, সাময়িক একটা তৃপ্তি আসে মাত্র। এই বোটানি বে কেবল রূপে অপরূপ রূপবতী-ই নয়, ঐতিহাসিক স্থানও বটে। কারণ ১৭৭০ খ্রিস্টাব্দে একজন ব্রিটিশ নাবিক ক্যাপটেন জেমস্ কুক, তাঁর জাহাজ এবং নাবিকদের নিয়ে এখানেই অবতরণ করেছিলেন। অবশ্য এখন ঐ পাহাড়চূড়ায় ওঠা নিষেধ। তারকাটা দিয়ে উপরে ওঠার রাস্তা বন্ধ করে দিয়েছে।
অস্তমিত সূর্য আকাশে রঙ বদলের খেলা খেলে বহু আগেই ঘরে ফিরে গেছে... বিচ ঘুরে, অপূর্ব সুন্দর চোখ ধাঁধানো দৃশ্য ও ঐতিহাসিক স্থান দেখে আর কিছু স্মৃতিময় দৃশ্য হৃদয় ও ক্যামেরা বন্দী করে আমরাও ঘরের পথ ধরলাম। (চলবে)...
আগের পর্ব পরের পর্ব
কাজী লাবণ্য, ঢাকা থেকে
|