bangla-sydney
bangla-sydney.com
News and views of Bangladeshi community in Australia












এই লিংক থেকে SolaimanLipi ডাউনলোড করে নিন



দোয়েলের চোখে কুকাবারা (১)
অলিম্পিক পার্ক
কাজী লাবণ্য



আগের পর্ব পরের পর্ব



সাড়ে বারোটায় শিডিউল থাকলেও, বৃহস্পতিবার রাত ১টার পরে ঢাকার আকাশে উড়াল দিল মালয়েশিয়ান এয়ারের ফ্লাইটটি। সেটি প্রভাতের দরোজা উদ্ভাসিত করে, অলৌকিক বর্ণিল আকাশের তলা থেকে কুয়ালালামপুর এয়ারপোর্টে অবতরণ করলে হ্যান্ড লাগেজ এবং ল্যাপটপের ব্যাগ সামলাতে সামলাতে দৌড় লাগাই পরবর্তী ফ্লাইটের জন্য।

বিশ্বের ষষ্ঠ বৃহত্তম দেশ অস্ট্রেলিয়া, প্রশান্ত মহাসাগরীয় এই দেশটির উত্তরে- পাপুয়া নিউগিনি, ইন্দোনেশিয়া ও পূর্ব তিমুরের অবস্থান, উত্তরপূর্বে সলোমন দ্বীপপুঞ্জ এবং দক্ষিণপূর্বে নিউজিল্যান্ড। সম্পদ, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, জীবনমানের দিক থেকে বিশ্বের অন্যতম সেরা বাসযোগ্য দেশ অস্ট্রেলিয়া। আয়তনের তুলনায় এর লোক সংখ্যা খুব কম। ধারনা করা হয় আদিবাসী জনগোষ্ঠীর মানুষ ৪০ হাজার বছর আগে এশিয়া থেকে অভিবাসী হিসেবে ওই ভূখণ্ডে পা রাখে। ব্রিটিশরা সেখানে বসতি স্থাপন করে ১৭৮৮ সালে। রাজধানী ক্যানবেরা হলেও অস্ট্রেলিয়ার সর্ববৃহৎ শহর সিডনী।

আমার গন্তব্য এই সিডনী শহর। না, আগে কখনই অস্ট্রেলিয়া যাইনি, বরং এই দেশকে চিনতাম ক্রিকেট দিয়ে আর চিনতাম রেডকাউ গুঁড়ো দুধের টিন দিয়ে।

কুয়ালালামপুর আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর মালয়েশিয়ার বৃহত্তম এবং ব্যস্ততম বিমানবন্দরের মনিটরে চঞ্চল চোখ রাখি পরের গেট নাম্বার জানার জন্য, দেখানো তীরচিহ্ন ধরে আরো মানুষের সাথে আমিও ছুটতে থাকি। কখনও ট্রাভেলেটর, কখনও হাঁটা। এরপরে অদ্ভুত এক ট্রেনে চেপে টানেল পেরিয়ে চলে আসি আরেক টার্মিনালে সিডনীর প্লেনের জন্য। বিজনেস ক্লাসের ঠিক পেছনের সারিতেই আমার সিট। এই জায়গাটি বেশ প্রশস্ত, তার উপর দু’টি সিটের একটি ফাঁকা, সামনেও অনেকখানি ফাঁকা জায়গা। বসি জানালার পাশে। স্থানীয় সময় সকাল ১০ টার পরে ওরা বেশ ভারি খাবার পরিবেশন করে- যা খেতে বেশ সুস্বাদু। সাথে ছিল অ্যাপেল জুস, এসিডিটির জন্য আমি সর্বদাই এসব খাবার এভোয়েড করলেও আজ আর করলামনা। যা থাকে কপালে, খেয়ে নিয়ে ঘুমিয়ে পড়লাম। আগের রাতে সারারাত জেগে ছিলাম, এবারে ঘণ্টা তিনেক ঘুমালাম। এরপরে পুরো সময় অন্তরীক্ষে দেখলাম কেবল মেঘের রাজত্ব, মেঘের আকার, রূপ, আকৃতি, রঙ, তাদের বিন্যাস যে এমন, যতবারই চোখ রাখি বিস্মিত হই, মুগ্ধ হই। অস্থির লাগতে থাকে। সবাই নিজ নিজ মনিটরে মন লাগিয়ে মুভি বা অন্যকিছুতে মগ্ন থাকলেও আমি পারিনা। হাতে বরাবরের মত বই থাকলেও মন বসাতে পারিনা, অস্থির সময়ে কখনই ঘড়িতে চোখ রাখিনা, তাতে অস্থিরতা আরো বাড়ে, ঘড়ির সুস্থতা নিয়ে সন্দেহ দেখা দেয়। কাজেই কেবল অপেক্ষা করি... অপেক্ষা করি... মনে হয় প্লেনটা কি আরো জোরে ছুটতে পারেনা! মন যতটা গতিতে ছোটে! যে মন কখনও আলোকের ঝর্ণাধারা! আবার কখনও ঘোর অমাবস্যা! আরো কতটা সময়! কতক্ষণে পৌঁছুব! শাহজালাল বিমান বন্দরে আমাকে বিদায় জানাতে এসেছিল মেজভাই হেলাল, রানা, গিনি, দিনার, ও আইরিন, বিশেষভাবে সকল কাজে সহযোগিতা করেছে সোহরাব আলী খান রানা। জানি, আমাকে একা পাঠিয়ে ওরা চিন্তিত থাকবে, না পৌঁছানো পর্যন্ত।

অতঃপর, ১ ডিসেম্বর ২০১৭, স্থানীয় সময় রাত সাড়ে নটায় পৌঁছে গেলাম সিডনীর কিংসফোর্ড স্মিথ এয়ারপোর্টে। নয় হাজার কিলোমিটার দূরে আমার নাড়িপোতা মাটি এবং আমার মাকে রেখে পৌঁছে গেলাম নাড়িছেঁড়া ধনের কাছে। এই পৌঁছানোর জন্য কতরকম আয়োজন, কত ব্যবস্থা, কত প্রতীক্ষা... কাস্টমস-ইমিগ্রেশন পার হয়ে লাগেজ বেল্ট থেকে নিজের মালামাল খুঁজে, সব বিধি বিধান সমাপ্ত করে হাতের লাগেজের ট্রলি নিয়ে চলে এলাম বাইরে। সেখানে অপেক্ষমাণ অসংখ্য মানুষের ভিড়ে ট্রলি ঠেলতে ঠেলতে উৎসুক দৃষ্টি ফেলছি। ব্যাকুল দু’চোখে যাদের খুঁজছিলাম, পেয়ে গেলাম। একজন একটি ঢাউস বেলুন হাতে নিয়ে, যেখানে লেখা-“ওয়েলকাম টু অস্ট্রেলিয়া”। আরেকজনের হাতে “টকটকে লাল গোলাপ”। আমি ভেজা চোখে, তৃষ্ণার্ত বুকে জড়িয়ে ধরলাম আমার সন্ততিদেরকে। বাতাস কানে কানে ফিসফিস করে লেবানিজ কবি ‘কাহলিল জিবরানের অন চিলড্রেন কবিতার লাইন মনে করিয়ে দেয়-

“তোমার সন্তানেরা তোমার নয়।
তারা জীবনের জন্য জীবনের আকুল প্রত্যাশার পুত্রকন্যা
তারা তোমাদের মাধ্যমে আসে, কিন্তু তোমাদের ভেতরে জন্ম নেয় না
এবং তারা যদিও তোমাদের সাথে থাকে, তোমাদের সম্পদ নয়”...

এই মহান সুবিখ্যাত কবিকে সামনাসামনি পেতে ইচ্ছে করে-
কবিকে বলতে ইচ্ছে করে আপনার কথা মানি কিন্তু তালগাছটি আমার। আমার সন্তান আমারই, আমার কাছ থেকে থাকুক তারা দূরে, যাক ছড়িয়ে পৃথিবীর বুকে, এগিয়ে নিক সৃষ্টিকে... কিন্তু তাদের স্থান আমার অতল গহীনে।

স্টিয়ারিং এ দক্ষ হাতে বসা মায়ের ছোট্ট লীলাবতী ঘার ঘুরিয়ে সিট বেল্ট বাঁধতে বলে মাকে নিয়ে ছুটছে... ওদের পরিকল্পনা অনুযায়ী গাড়ি ছুটতে থাকে আলোকিত সিডনির মসৃণ পথ ধরে।

রকডেল নামে একটি এলাকায় বেশ কিছু বাঙালি রেস্টুরেন্ট আছে, নাম ‘বনলতা’, ‘হাট-বাজার’ ‘ফুচকা হাউজ’ ইত্যাদি। হাটবাজারে আমরা বিশাল রূপচাঁদা সহ নানা পদের খাবার খেয়ে অলিম্পিক পার্কের পথ ধরি। অলিম্পিক পার্কের ভেতরে অস্ট্রেলিয়া এভিনিউয়ের যমজ টাওয়ারের একটির উপরের দিকের ফ্লোরে ওদের নীড়, ভালোবাসার নীড়। সবাই হাসছি গল্প করছি কিন্তু আমার মন খচ খচ করছে কারণ আমি লাগেজ পাইনি। কেবল আমি নই অনেক মানুষ পায়নি, এ এক আজব বিড়ম্বনা!

লাগেজ না পেয়ে মন মেজাজ খারাপ করে ‘ব্যাগেজ ক্লেইম’ কাউন্টারে ক্লেইম করে চলে এসেছি। আমার কন্যা ও আমার পুত্রসম জামাতার জন্য ঘরে বানানো ওদের প্রিয় কিছু খাবার সাথে এনেছি, কিন্তু সেগুলি ওরা খেতে পারবে না! নষ্ট হয়ে যাবে! এ আশংকায় মনটা অসম্ভব বিষণ্ণ হয়ে রইল।
ছোট ছোট সারপ্রাইজ গিফট, টুকরো টাকরা ভালোবাসা বোঝাই ঢাউস বাক্সোটি কবে পাব কে জানে!

রাতের অন্ধকারকে আলগোছে সরিয়ে চারদিক আলোকিত করে রেখেছে এরা, সেই আলোয় নতুন দেশ দেখতে দেখতে চলে এলাম ওদের বাসায়, যা দেখব বলে ছুটে এসেছি এতটা উড়াল পথ। চমৎকার পাখির নীড়, যার একটা দিক পুরো গ্লাস, বাইরের সবটাই দেখা যায়- অপূর্ব সুন্দর! মোহিত হয়ে গেলাম।

আমার আঙুলের ডগা যে এতদিন সন্তানকে স্পর্শের জন্য তৃষ্ণার্ত ছিল তার কিছুটা মিটিয়ে শুয়ে পড়লাম। কিন্তু চোখের পাতা এক করা গেলনা। ইহাই জেটল্যাগ। (চলবে...)



আগের পর্ব পরের পর্ব



কাজী লাবণ্য, ঢাকা থেকে





Share on Facebook               Home Page             Published on: 2-Oct-2018

Coming Events:

Nomination Form is available at the end of the notice