ধেড়ে ইঁদুর কাজী লাবণ্য
নিম্নমধ্যবিত্ত পরিবারের মেয়েটি আশ্চর্য রকম প্রাণবন্ত, শৌখিন, আর সংস্কৃতি-মনা। সে নিজে কলেজে পড়ে, গান শেখে আবার একজন নিবেদিত নাট্যকর্মী। এই নাটক করার পথে কত বাধা বিপত্তি এসেছে, কিন্তু সে সকল বিপত্তি ওর নিজস্ব তীব্র ভালোলাগার কাছে মাছির মত উড়ে গেছে।
সাধারণত নাটকের মেয়ে বলতে মানুষ যেমন বোঝে রুনু তা নয়। সে ভদ্র সংযত এবং পর্দানশীন একটি মেয়ে। সে নিজের ইচ্ছায় ওড়না দিয়ে পেঁচিয়ে ঢেকে রাখে তার ঝলমলে চুল, লাবন্যপ্রভার কাঁধ, গলা মুখের চারপাশ। ওর ড্রেস কোন দামী বা নামী ব্র্যান্ডের ড্রেস নয়। কিন্তু কী অপূর্ব তার কালার। সর্ষে হলুদ আর টিয়ে সবুজের সজীবতায় সে যেন ঠিক নয়া বসন্তের কচিপাতা।
এই মেয়ে কোথায় পেয়েছে এত রুচি! এত মানসিক জোর! এত ব্যক্তিত্ব! যে টিউশনি করে নিজের পড়ার খরচ চালায়, ছোট ভাইয়ের যতটা পারে বায়না মেটায় আবার বই কেনে। প্রচুর বই কেনে, বই পড়ে। সময়াভাবে রাত জেগে সে বই পড়ে। অর্থনীতির নামতা পড়া এসব পরিবারে সাধারণত জোরালো ভাবে ধর্মকর্ম মানা হয়ে থাকে। ধর্মই হয় তাদের আশ্রয়। মায়ের সাথে সাথে এই মেয়েটিরও নামাজ পড়ায় বা রোজা রাখায় কোন আলিস্যি নেই। সে যা কিছুই করে সবই স্বাভাবিক, সাবলীল। ওর পাশ দিয়েই ওরই বয়সী টিশার্ট জিন্স পরা তরুণীকে নিয়ে, কড়া পারফিউমের সুঘ্রাণ ছড়িয়ে হুসহাস করে প্রাডো, মার্সিডিজ, পাজেরো চলে গেলেও ওর মনে কোনরকম প্রভাব পড়েনা। এসবে রুনুর কিছুই মনে হয়না। সে তার মত। কোন হীনমন্যতা, কোন সংকীর্ণতা তাকে স্পর্শ করতে পারেনা।
জন্মসূত্রেই বাস করার জন্য মেয়েটি পেয়েছে এক চমৎকার পরিবেশ। যেমন হাইরাইজ বিল্ডিং এর ঘুলঘুলিতে নীড় বাঁধা পাখি জোড়া অনেক নিরাপদ থাকে গাছের ডালের পাখির চেয়ে। তেমনি রুনুরাও পেয়েছিল দেশের সর্বোচ্চ নিরাপদ, সুন্দর, পরিচ্ছন্ন, এবং ছায়াঘেরা এক অবারিত পরিবেশ। হয়ত এই পরিবেশের কারনেই সে ছিল আলোকিত একজন মানুষ। দেশের সর্বোচ্চ সুযোগ সুবিধাপ্রাপ্ত একটি ডিপার্টমেন্টে ওর বাবা ক্ষুদ্র একটি কাজে নিয়োজিত থেকে জীবন এবং পরিবার নির্বাহ করত।
রুনু একটা অদ্ভুত বয়সে পৌঁছে গিয়েছিল। খুব অদ্ভুত। একেক সময়ে একেক চিন্তা ভাবনার বয়স সেটি। এই রোদ তো এই বৃষ্টি, এই কান্না তো এই হাসি আর মনের আয়নায় কত বিচিত্র স্বপ্ন-ভুক তোলপাড়। এ সময়টাকে কিছুটা পরিণত হাতে নিয়ন্ত্রণ করতে হয়। সবাই কি তা পারে! এই মেয়েটি পেরেছিল। সে তার জীবনের লক্ষ্যে স্থির থাকতে পেরেছিল। না খুব বিশাল কিছু চাওয়া হয়ত তার ছিলনা। তবে হ্যাঁ ওর নিজের মত করে সে বড় হতে চেয়েছিল। বিকশিত হতে চেয়েছিল। এই চাওয়া একটি নির্মল এবং নুন্যতম চাওয়া।
অন্যান্য দিনের মতই একটি দিন। ফাগুনের সন্ধ্যে। মা নামাজে, রুনু যাবে টিউশনিতে। মা তাড়াতাড়ি সালাম ফিরিয়ে মেয়ের মঙ্গলের জন্য দুহাতে ভিক্ষা মাগেন বিধাতার কাছে। মেয়েটি বড় হওয়ার পর থেকেই মায়ের দুর্ভাবনা। বাসার পেছনে বড় আম গাছটিতে একটি হুতুম পেঁচা থাকে সেটি মাঝে মধ্যে সময় অসময়ে ডেকে উঠে। অন্য সময় সেটির ডাকে মায়ের অন্তরাত্মা কেঁপে উঠলেও ছেলে মেয়ের মুখে মজার হাসি ফুটে ওঠে। আজও ডেকে উঠলে মায়ের মন যেন কেমন করে কেঁপে উঠে।
রুনুর পড়াতে যেতে ভালো লাগে কারণ বাচ্চাটি পড়াশোনায় খুব মনোযোগী আর কি মায়াকাড়া চেহারা। ওর মাও আবার রুনুকে খুব আদর করে। ভালোমন্দ কিছু রান্না হলে না খেয়ে আসতে দেয়না।
তাড়াহুড়ো করে ঘর থেকে বের হয়ে সে গলা তুলে মায়ের কাছে বিদায় নিয়ে প্রায় ছুটতে থাকে। মাও পেছন পেছন আসে
- “মা তোর ফেরার সময় আমি ওই মোড়ের কাছে থাকব”
-”তোমাকে আর কত বলব, লাগবে না। এত ভয় পাও কেন? এইটুকু পথ, ও আমি ঠিক আসতে পারব”। আবার কি মনে করে ঝট করে ফিরে এসে মায়ের গলা জড়িয়ে মায়ের কপালে একটা চুমু দিয়েই দৌড়ুতে থাকে মেয়েটা। মা মনে মনে দোয়া পড়ে ফু দেন মেয়ের উদ্দেশে। ভেবে রাখেন ওর বাবাকে বলে মেয়ের এই সন্ধ্যের পড়াতে যাওয়া বন্ধ করে দেবেন। দরকার নেই রাতের এই পড়াতে যাবার। যা দিনকাল পড়েছে!
আকাশে কি চাঁদ আছে, না থাকলেও রোড লাইটের আলোয় চারপাশ ঝকঝকে ফকফকে। হাতের তালুর মতই চেনা জায়গা, জানা রাস্তা। জন্ম এখানে, বেড়ে উঠাও এখানে। এখানকার ধুলোমাটি, ঘাস, প্রতিটি গাছ, ডাল পাতা সবই ওর চেনা সবাই ওর বন্ধু। মা যে কি ছেলেমানুষ! খালি ভয় পায়। মায়ের জন্য মনটা আদ্রতায় ভরে উঠে। নিত্যদিনের মতই রুনু আপনমনে পা চালিয়ে হাঁটতে থাকে। পরের দিনের কি কি কাজ আছে তাও মাথায় খেলতে থাকে। হাতের বাম পাশে কাঁটাতারের বেড়া, যার ওপাশে সারিবদ্ধ জারুল বীথি আরো এগুলে সামনে একটি কালভার্ট আছে সেটি পার হয়ে সোজা এগোলেই ওদের বাসা। হঠাৎ করে চোখে পরে কালভার্টের ঢালু জায়গাটায় ঢাউস সাইজের একটা গোল চাকতির মত কি যেন চকচক করছে। প্রথমে ও ভয় পেয়ে যায়, ভাবে একটা ভোঁ দৌড় দেবে। আবার তীক্ষ্ণ-চোখে তাকিয়ে কি যেন ভাবে- “আচ্ছা এটি কি কোন বিশেষ যন্ত্রযান! যেমন ও সায়েন্স ফিকশনে পড়ে তেমন কিছু! হতেও তো পারে! উত্তেজনায় ও অস্থির হয়ে পরে। অদম্য কৌতূহলে পায়ে পায়ে ও এগিয়ে যায়। আরে একি! সত্যিই এটি একটি যান। ভিনগ্রহের কিনা তা ও বোঝেনা কিন্তু সেটি একটি আকাশযান তা বোঝে। বিভিন্ন মুভিতে এরকম ও দেখেছে, বইয়ের বর্ণনায় পড়েছে। পায়ে পায়ে সে এগিয়ে যায়-
যানটির চারপাশের মাটি দেবে গিয়ে কিছুটা গর্তের মত তৈরি হয়েছে আর পুরো মাটি পুড়ে তামা তামা হয়ে আছে। আশ্চর্য, ও কাছে যাওয়া মাত্র গোল একটি দরজা খুলে গেলে সেখান থেকে কেউ একজন বের হয়ে আসে, আর ও অবাক হয়ে তাকিয়ে দেখে সেটি ওরই বয়সী মিষ্টি একটি মেয়ে। রুনুর বিশ্বাস হয়না, বিশ্বাস হতে চায়না এসব কি দেখছে সে, কাল কলেজে গিয়ে বন্ধুদের বললে একদম কেউ বিশ্বাস করবেনা। ইশশশ! এখন কোনভাবে যদি ওর একজন বন্ধুও এখানে উপস্থিত হত!
রুনুর সাথে মেয়েটির জিগরি বন্ধুত্ব হতে পিকো সেকেন্ডও লাগেনা। মেয়েটি অল্প সময়ে রুনুর সাথে সব বিষয়ে কথা বলে। সে জানায় ঐযে তোমরা যাকে আকাশ বল- তার বহু দূরে গ্যালাক্সির পর গ্যালাক্সি আছে, তারই একটাতে আমি থাকি। এরপর বেশ কিছু সময় একটা ঘোরের মধ্যে কেটে যায়। রুনু একটুও বুঝতে পারেনা, যে সামনের মেয়েটি তার সাথে যে সকল বিষয় নিয়ে কথা বলছে সেগুলো ওর জানার কথা নয়। তার বাড়ির কথা, কলেজের কথা, তার নাটকের কথা এমন কি ওর টিউশনি নিয়েও কথা বলে সদ্য হওয়া নতুন বন্ধুটি। এরপর সে বলে – “তোমরা যাকে অলৌকিক ক্ষমতা বল সেরকম কিছু ব্যাপার আমার আছে, তুমি কি কিছু চাও আমার কাছে, কিছু অন্যরকম ক্ষমতা”? মুহুর্ত না ভেবে রুনু মাথা নেড়ে জানায় না তার কিছু চাওয়ার নেই। এরপর আগন্তুক মেয়েটি জানায় এখন তাকে চলে যেতে হবে। ব্যাকুল রুনু বলে আরেকটু থাকো। সে রুনুর মত করেই একটু গা মুচড়ে বলে- “নাহ আর সময় নাই, এখন যেতে হবে”। অল্প সময়ের মধ্যেই সে চলে যায়, তবে রুনুর মন খারাপ বুঝতে পেরে সে আবার আসার প্রতিশ্রুতি দিয়ে বিদায় নেয়। দেখতে দেখতেই চকচকে যানটি ঘুরতে ঘুরতে উপরে উঠতে উঠতে এক সময় ওই আকাশে উজ্জ্বল বিন্দু হয়ে যায়।
রুনুর মনে হয় অনেক সময় ধরে এখানে সে আছে। আসলে কিন্তু নিমিষ মাত্র। রুনু মনটা একটু খারাপ করে ঘুরে হাঁটতে শুরু করলে পায়ে কিছু একটা ছোবল মারে। প্রচণ্ড জ্বলুনি আর ব্যথায় রুনু আঁতকে উঠে মাথা নিচু করে দেখতে যায় কিসে ছোবল দিল। এখানে এই অতি পরিচিত, পরিচ্ছন্ন জায়গায় কিসে তাকে ছোবল মারবে! এখানকার লাল কালো পিঁপড়ার সারিও রুনুর পদশব্দ চেনে। ফড়িং, প্রজাপতি, এমনকি পথের কুকুর গুলোও রুনুকে ভালোবাসে। তাহলে! কিন্তু তার আগেই আবার, এবং আবার... সে কিছু বুঝতে পারে না কি ঘটছে। মুহুর্ত মাত্র সময় পরেই সে নিজেকে আবিষ্কার করে মাটিতে লুটানো অবস্থায়। তার পুরো শরীর জ্বলে যাচ্ছে। সে দেখতে পায় তার চারপাশে কিছু বনবিড়াল সাইজের ধেড়ে ইঁদুর তাকে ঘিরে একের পর এক কামড় দিয়েই যাচ্ছে। এসব কি! এগুলি কোথা থেকে এল! এগুলি কি ঐ ভিনগ্রহ থেকে আসা যানটিতে ছিল! এরা তো এই মাটির কোন প্রাণী নয়! এই মাটি কি পারে এমন ভয়াল দর্শন মানুষখেকো প্রাণীর জন্ম দিতে! এতো আমাজন জঙ্গল নয়! দেশের সর্বোচ্চ নিরাপত্তা বেষ্টিত এলাকা! এই বীভৎস কুৎসিত জন্তু গুলি কোত্থেকে এলো রুনু ভেবে পায়না... এসবের কোন অস্তিত্ব আছে বলে আগে সে শোনেনি। ওর এই আজন্ম পরিচিত নিরাপদ এলাকায় এসব কি করে এলো! কিভাবে সম্ভব! আগন্তুক বন্ধুর পরামর্শ মত ও যদি কোন একটা অলৌকিক ক্ষমতা শিখে নিত! অদৃশ্য হবার ক্ষমতাটা শিখে নিলেও এখন কাজে লাগত! রুনুর চোখের সামনে এক নিমিষেই ওর হাতের আঙ্গুলগুলো একটি একটি করে খেয়ে ফেলল জন্তুগুলো। রুনু প্রাণপণ শক্তিতে সর্বোচ্চ নিরাপদ এরিয়ার নিরাপত্তা ফালা ফালা করে চিৎকার করে উঠল... রুনুর চিৎকার বাংলার আকাশে, বাতাসে, পাহাড়ে, সমুদ্রে, গাছের শাখায় শাখায় ইকো হতে থাকল... অবিশ্বাস্য হলেও সত্যি মাত্র কয়েক লহমায় আস্ত একটি মানুষ বোন প্লেটের উচ্ছিষ্টে পরিণত হল। পরদিন এক কান দুকান হতে হতে সারাদেশে খবরটি ছড়িয়ে পড়ল। দেশের অতি সাধারণ কিছু মানুষ সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যম গুলোতে তীব্র প্রতিবাদ ও নিন্দার ঝড় তোলে। মানুষ মিছিল করে, মানব বন্ধন করে, বিক্ষোভ সমাবেশ করে। ফেসবুক নামে একটি সামাজিক মাধ্যমে মানুষ নানা ভাবে ঘৃণা জানায়, সুবিচার দাবি করে, সঠিক তদন্তের কথা বলে। সত্য প্রকাশের দাবিতে, বিচারের বাণী নিভৃতে না কাঁদার জন্য মানুষগুলো বলতে বলতে মুখে ফেনা তুললেও সত্যবতী কথা বলেনা।
ন্যায্য পাওনার দাবীতে পুনঃপুন ব্যর্থ মানুষগুলোরও যেন আর কোন কাজ নেই! কোথায় এই মানুষগুলো টেবিল ভর্তি খাবার, ছাদ-ভর্তি ফুল, প্রেম ভর্তি যুগলের ছবি দেবে, তা নিয়ে কাব্য চর্চা করবে, তা না রুনু! রুনু! রুনু!
রুনু কিন্তু খারাপ নেই। তার নতুন বন্ধুর সাথে সে এখন পৃথিবীর মানুষের ব্যাখ্যাতীত, কল্পনাতীত এক অন্য জগতে অন্যভাবে বেঁচে থাকে। ওর বন্ধুটি ওকে জানায় আসলে তোমাকে আক্রমণ করেছিল যে ধেড়ে ইঁদুরগুলি ওদের কিছু সমস্যা ছিল। কি সমস্যা রুনু জানতে চাইলে বলে- “ দেখ, সকল প্রাণীর মস্তিষ্কের জায়গায় কম বেশী যাই হোক কিছু গ্রে ম্যাটার থাকে। কিন্তু ওদের মস্তিষ্কের জায়গাটি ছিল বিষ্ঠা দিয়ে ভরা, ওটা বদলে দিলেই ওরা স্বাভাবিক হয়ে যাবে”।
রুনুর পুরনো কথা, ছেড়ে আসা জীবনের কথা তেমন মনে পড়েনা। কেবল মাঝে মাঝে মাথার ভেতরে করুন মায়াবী একটি মুখ চকিতে ভেসে উঠে- ওর মাথার ভেতরে ঘুম পাড়ানি গানের মত, মাতৃদুগ্ধ পানের নেশার মত একটা তরঙ্গ, একটা প্রবাহ কম্পন তোলে -
“মা, তুই কোথায় মা! একবার, শুধু একবার বুকে আয় মা”।
(সোহাগী জাহান তনুর প্রতি, ভালোবাসা)
কাজী লাবণ্য, ঢাকা থেকে
|