বুমেরাং / কাজী লাবণ্য
আগের অংশ
অফিসের কাজে ছেলে দুদিনের জন্য চিটাগাং গেল। সে বিদায় নিয়ে চলে গেলে তিনি নিজের ঘরে গেলেন। শুয়ে পড়বেন। শরীর ভালো না। রোজকার মতো ঠিক মেয়েটি এখুনি আসবে খোজ খবর নিবে সব ওষুধ খাওয়া কমপ্লিট হয়েছে কিনা দেখে মশারী গুজে দিয়ে তবেই ঘুমাতে যাবে। তিনি বিছানায় উঠতে গিয়ে আবার কি মনে করে বের হয়ে আসলেন। জয়া নিজের ঘরে। অন্যদিন ছেলে থাকে বলে তিনি কখনই ছেলে বৌমার ঘরে যাননা। আজ কি মনে হলো তিনি ঘরে ঢুকে মিষ্টি করে ডাকলেন- জয়া!
জয়া শামীমের ছেড়ে যাওয়া তোয়ালে, গেঞ্জি, ট্রাউজার বারান্দার তারে মেলে দিচ্ছিল। সাড়া দিয়ে শাশুড়ির কাছে এলো, নিজস্ব উচ্চারণে বলল-
‘কি মা, কিছু লাগবে? আমি আপনার কাছে আসছিলাম’...
‘কিছু লাগবে না মা, আমিই এলাম তোমাকে দেখতে। এসোতো আজ আমি তোমার চুল বেঁধে দেই।
‘না মা, আপনি পারবেন না। এমনিই আপনার শরীর ভালনা’
‘আর শরীরের কথা বলবানা। সারাজীবন ছাত্রী পড়িয়ে, ঘরসংসারের কাজ করে এতদূর এসেছি। তোমার শ্বশুর তো চলে গিয়ে বেঁচে গেছেন, আমি চাকরি সামলে দুটি সন্তান নিয়ে খুব কষ্ট করে, নিরন্তর লড়াই করে এ পর্যন্ত এসেছি মা আর এখন এই শরীর হয়ে গেছে বোঝা! তবে জানো কি মা- শরীরের নাম মহাশয়, যতই সওয়াও ততই সয়। তুমি চিরুনি নিয়ে এসো, সামনে বসো। এত চমৎকার চুল তোমার’। শাশুড়ির কথার জোর দেখে জয়া হেসে ফেলে। সে চিরুনি নিয়ে এসে শাশুড়ির সামনে বসে। তিনি অনেক যত্নে পুত্রবধূর লম্বা চুলে চমৎকার বিনুনি বেঁধে দেন। চুল বাঁধা শেষ হলে তিনি তাকিয়ে থাকেন- মেয়েটি এত সুন্দর! এত সুন্দর তার নাক চোখ ঠোঁট আর কি অপূর্ব গায়ের রঙ। কেবল আল্লাহ-পাক তাকে সুস্থ করলেননা! তিনি শৌখিন ও আরামদায়ক ঘরের চারদিকে তাকান আবার মেয়েটির মায়াবী মুখের দিকে তাকান, ওর চলে যাওয়ার দিকে তাকিয়ে ভাবেন- আচ্ছা, শামীম জয়াকে নিয়ে সুখী তো! শামীম মনে মনে কি ভাবে কে জানে! চাপা স্বভাবের ছেলে, যতই মা ন্যাওটা হোক তিনি ঠিক বুঝতে পারেননা। আজ ওদের বাবা বেঁচে থাকলে তিনিই ছেলেকে বুঝতেন। এই বিয়েতে রাজী হয়ে তিনি কি ভুল করেছেন না ঠিক করেছেন! আজ জয়ার শরীরে তার বংশধর... সন্তান যদি আবার মায়ের মতো... না, না, হে মাবুদ! তা যেন না হয়। হঠাৎ তার খারাপ লাগতে শুরু করে। শরীরটা যেন কেমন করে উঠে। নিজের ঘর পর্যন্ত যেতে পারবেন কিনা, আবার জয়াও ভয় পেতে পারে ভেবে তিনি ওখানেই চুপচাপ শুয়ে পড়েন। ভাবেন একটু পরেই উঠে চলে যাবেন। জয়া বাথরুম থেকে এসে দেখে মা ওদের বিছানাতেই শুয়ে পরেছে। সে এসে কাছে বসলে তিনি বলেন- ‘যাও মা তুমি টি ভি দেখ, এই আমি আসছি’। কিন্তু রাত বাড়লে জয়া এসে দেখে মা ঘুমিয়ে পড়েছে। সে আর বেচারিকে না জাগিয়ে সাবধানে মশারি গুজে দিয়ে একটা পাতলা চাদর গায়ে দিয়ে খুব সহনীয় তাপমাত্রায় এসি ছেড়ে দিয়ে শাশুড়ির রুমে গিয়ে ঘুমিয়ে পড়ে।
**
চিটাগাং শহরের অভিজাত এলাকার অভিজাত একটি হোটেল কক্ষ। রাতের মাঝামাঝি সময়ে শামীমের ফোনে একটি কল আসে। রিসিভ করে সে কেবল কানে লাগিয়ে হ্যালো বলে কিছু শুনে ফোন কেটে দিয়ে পার্শ্ববর্তিনীর কানে কুট্টুস কামড় দিয়ে খলবলে কণ্ঠে বলে-
"এবার তোমার রাস্তা ক্লিয়ার আর কোন ঝামেলা রইল না এরপর আমাদের বিয়েটা এই একটু সময়ের ব্যাপার মাত্র"। কাঁচ-ভাঙ্গার শব্দ ঝংকৃত হয়। আহ্লাদিত কণ্ঠে প্রশ্ন আসে-
"কিভাবে"? "সে তোমাকে শুনতে হবে না"। কিন্তু আহ্লাদ বেড়ে গেলে সে কেবল বলে "বালিশ বালিশ, দেখ আমি আমার প্লান মতো সব করছি কেবল তোমার জন্য, কাজেই তুমি আর একটু ধৈর্য ধর, তুমি আমার উপর আস্থা রাখো... তোমাকে আমি রাজরানী বানাব। টাকাওয়ালা বুড়াভাম আমার ঘাড়ে পাগল গছায়, হাহ"! এই বুড়োকেও একদিন বালিশ থেরাপি দেবো। কথা বলতে বলতে আবার তারা হারিয়ে যায় তাদের এত বছরের রুদ্ধশ্বাস অপেক্ষার ওপারে...
ভোরবেলা শামীমের ফোনে আরেকটি কল আসে। ঘুম চোখে সে একটু চোখ কুচকে তাকায়, এমন একটি কল আসবে সে জানত, সে জানত কলটি আসবে মায়ের ফোন থেকে, কিন্তু এটি তো জয়ার নং। সে ইচ্ছে করে একটু সময় নিয়ে রিসিভ করে... কিন্তু মা নয়-
জয়ার অস্পষ্ট উচ্চারণের হাউ মাউ কান্নায় সে কেবল একটি শব্দই বোঝে- মা- মা- মা-
আগের অংশ
কাজী লাবণ্য, ঢাকা থেকে
|