আসিয়া / কাজী লাবণ্য
আগের অংশ
আশ্বিনের সংক্ষিপ্ত বিকেল দ্রুত ফুরিয়ে আসার আগেই অনতিদূর থেকে শোনা যায় গাড়ির আওয়াজ। সবাই উৎকর্ণ হয়ে তাকিয়ে থাকে সেদিকে, সকলের জোড়া জোড়া কৌতূহলী চোখের সামনে গাড়ি এসে থামলে দেখা যায় আরোহী আর কেউ নয় শহরের ডাঃ ভাইজান আর মোজা। সকলের কল-গুঞ্জন থেমে যায়। এই ডাঃ থাকেন শহরে, তাঁর পূর্বপুরুষ এই প্রামাণিক পাড়াতেই থাকতেন। তিনি থাকেন শহরে কিন্তু প্রতি শুক্রবারে এসে গ্রামের সব মানুষের বিনা পয়সায় চিকিৎসা করেন। ফি তো নেনই না উলটা আরো সবার ঔষধ দেন পথ্যের জন্য টাকা দিয়ে যান। গ্রামের মানুষের বিপদে আপদে সব সময় তিনি পাশে থাকেন। সবার ছেলেমেয়েরা যেন স্কুলে যায় সেদিকে তিনি কঠিন নজর রাখেন। সুস্থ জীবন যাপনের নিয়ম কানুন তিনি সব সময় সবাইকে বলেন। পুরো গ্রামের মানুষ তাঁকে দেবতা জ্ঞান করে। তিনি কারো ভাইজান, কারো চাচা, কারো দাদু আবার বয়োজ্যেষ্ঠ কেউ কেউ তাঁকে অধিকার বলে নাম ধরেই ডাকে।
ডাঃ কে দেখা মাত্রই যে যার মত ছুটে গেল চেয়ার বেঞ্চ আনার জন্য। ডাঃ এলে কি করতে হয় সবাই জানে, কেবল সবার মনে মনে প্রশ্ন আজতো শুক্রবার নয়, তাহলে আজ কেন? এযে মোজার জন্যই আসা তা মনে মনে সবাই টের পায়। বাতাসের আগে খবর ছুটে যায়, কাজেই যে যেখানে আছে সব্বাই এসে জমা হয় সেন্দুরাই আমের তলায়।
ডাঃ এসেই লেবু দিয়ে শরবত খায় সে শরবতও এসে যায়, খাওয়ার পর সকলের সাথে টুকটাক কুশল বিনিময় করেই আসল কথায় আসে ডাঃ। একজন মুরব্বীর দিকে তাকিয়ে বলা শুরু করে-
-আর বলেন না চাচা, এই গাধা মোজা গিয়ে আমার হাতে পায়ে ধরে হাউমাউ করে কান্না... কিছুই বলতে পারেনা খালি কাঁদে তারপর ওর মুখে শুনলাম এখানকার ব্যাপার স্যাপার। আবার মোজার দিকে তাকিয়ে বলে
-এই মোজা! যা আসিয়াকে বাইরে এসে বসতে বল, আমি যা বলি তোরা মন দিয়ে শোন। আমার হাতে সময় খুব কম, কে যেন আসিয়াকে ডেকে এনে বাইরে বসায়, সে লম্বা ঘোমটা টেনে একটু দূরে বসে। ডাঃ সাহেব বলতে শুরু করেন-
-আরবিতে ‘তালাক’ শব্দের অর্থ হলো কোন কিছু ভেঙ্গে ফেলা বা ছিন্ন করা। বিয়ের মাধ্যমে যে সম্পর্ক দুজন মানুষের মধ্যে হয় তা আইনসিদ্ধ উপায়ে ভেঙ্গে দেয়াকে মুসলিম আইনে তালাক বা বিবাহ বিচ্ছেদ বলে। স্বামী স্ত্রীর সম্পর্ক যদি এমন পর্যায়ে পৌঁছায় যে তাঁদের পক্ষে একসাথে থাকা আর কিছুতেই সম্ভব নয়, সেক্ষেত্রে নির্দিষ্ট উপায়ে বিবাহ বিচ্ছেদ ঘটানো যেতে পারে। কিন্তু বিচ্ছেদের জন্য কিছু সঠিক নিয়ম আছে। ডাঃ ধীরে ধীরে বলতে থাকেন যেন সবাই শুনতে ও বুঝতে পারে -
রাগের মাথায় মুখে পর পর তালাক বললেই অথবা একসাথে ‘বায়েন তালাক’ কথাটি বললেই তালাক কার্যকর হয়না। যদিও এই ভুল ধারনাটি সবার মধ্যে আছে। এসময় ডাঃ সাহেবের চোখ যায় হুজুরের দিকে। হুজুর আস্তে করে মাথা নামিয়ে নেয়। আমাদের গ্রাম দেশে স্বামীরা অহরহই মুখে মুখে তালাক দিয়ে থাকে। আসলে তালাকের নিয়ম অনুযায়ী তালাক দেবার পর নোটিশের মাধ্যমে স্ত্রীর এলাকার চেয়ারম্যানকে জানাতে হবে। নোটিশ পাবার পর ত্রিশ দিনের মধ্যে চেয়ারম্যান স্বামী স্ত্রীর মধ্যে পুনর্মিলন ঘটানোর উদ্দেশ্যে উভয় পক্ষের প্রতিনিধিদের নিয়ে একটি সালিশি পরিষদ গঠন করবে এবং তাদের মধ্যে সমঝোতা আনার প্রয়োজনীয় সমস্ত ব্যবস্থা নেবে। এ পর্যন্ত বলে ডাঃ সাহেব সবাইকে উদ্দেশ্য করে জিজ্ঞেস করেন আমার কথা কি খুব কঠিন লাগছে, বুঝতে অসুবিধা হচ্ছে? ভিড়ের মাঝ থেকে বয়স্ক দু-চারজন বলে ওঠে না না কঠিন কিছু না। ডাঃ এবারে মোজার দিকে তাকিয়ে বলে
-ঐ হাঁদারাম বুঝতে পারছিস? না বুঝলে আমাকে জিজ্ঞেস করবি। মোজা ঘাড় কাঁত করে হ্যাঁ জানায়। ডাঃ বলতে থাকেন -
ওই সালিশিতে কাজ না হলে ৯০ দিন পর তালাক কার্যকরী হবে। ৯০ দিন পার না হওয়া পর্যন্ত তারা আইনসিদ্ধ স্বামী স্ত্রীই থাকবে। এখানে আরো একটি গুরত্তপুর্ণ কথা আছে, সেটি হলো আইন অনুযায়ী তালাকের মাধ্যমে কোন বিবাহ বিচ্ছেদ ঘটলে তালাক হওয়া দম্পতি চাইলে পুনরায় বিয়ে করতে পারে, তবে তার জন্য মধ্যবর্তী বা ‘হিল্লা’ বিয়ের কোন প্রয়োজন নাই। আবার তালাকের সময় স্ত্রী যদি গর্ভবতী থাকে তবে তালাক কার্যকরী হবে না।
ডাঃ থেমে গিয়ে সবার দিকে তাকিয়ে বলেন -
-মোজা আমাকে বলেছে সে রাগের মাথায় ওইসব কথা বলে ফেলেছে সেটা ওর মনের কথা নয়। ও ওর বউকে নিয়ে আগের মত সংসার করতে চায়। আপনারা নিশ্চয়ই বুঝতে পারছেন নিয়ম অনুযায়ী মোজা আসিয়ার মধ্যে তালাক হয় নাই। কাজেই ওদের সংসার করতে কোন অসুবিধা নাই। কি বলেন সবাই? কণ্ঠস্বর উঁচু করে তিনি সবার দিকে তাকান। বয়স্করা বলে উঠে-
-অয় যদি সংসার করতে চায় হামরা আর কি কই?
-হ্যাঁ, ও সংসার করতে চায় বলেই আমার কাছে ছুটে গেছে ‘হ্যাঁ’ উপর বেশ জোর দিয়ে তিনি বলেন। অনেক অনুরোধ করে আমাকে এখানে নিয়ে এসেছে। আমার হাতে সময় একদম নাই, কিন্তু ওর আকুলতা দেখে না এসে পারলামনা, কারো মনে এ নিয়ে কোন প্রশ্ন আছে কি, মওলানা সাব কি বলে? মওলানা মাথা নেড়ে বলে, না কিছু বলার নাই। আচ্ছা বেশ, তাহলে তো এ নিয়ে আর কোন সমস্যা রইল না। এই মোজা! যা আসিয়াকে নিয়ে বাড়ির ভেতরে যা। ফের যদি এমন কিছু করিস তখন কিন্তু আমি নিজে তোর ব্যবস্থা নেব। মোজা একগাল হাসি দিয়ে ওর দেবতার মত ভাইজানের দিকে তাকিয়ে হে হে করে হেসে উঠে ...
এতবড় একটা ঘটনার পরিসমাপ্তি হলো একদম পানসে ভাবে, নাটক জমে উঠলনা - আজকের জমায়েত মানুষের অর্ধেক মানুষ এমন ভাবনা মাথায় নিয়ে আর বাকি মানুষ – যাক ব্যাপারটা ভালয় ভালয় মিটে গেল, সংসারটা রক্ষা পেল, জগতের সকল প্রাণী সুখী হোক এমন ভাবনা নিয়ে বহু ঘটনা অঘটনার সাক্ষী সেন্দুরার তল ত্যাগ করল। ডাঃ সাহেবের গাড়ির শব্দও দূরে মিলিয়ে গেলে আসিয়া-মোজার বড় মেয়ে ময়না যে এই ডাঃ সাহেবের পরামর্শ ও সহযোগিতায় এবারে ৯ম শ্রেণির ছাত্রী, গত ৩দিন ধরে কেঁদে কেঁদে চোখ দুটি করমচার মত লাল করে, ঠোঁট মুখ ফুলিয়ে ফেলেছে, গত ৩দিন মেয়েটি সংসারের সব কাজ করেছে, ভীত, অসহায় ছোট বোন দুটোকে আগলে রেখেছে আর তীক্ষ্ণ দৃষ্টি রেখেছে মায়ের উপর কারণ প্রতি বছর এ পাড়ায় ও পাড়ায় এমন ঘটনায় বহু মায়েরা হয় গলায় ফাঁস নেয় অথবা জমিতে দেওয়ার কীটনাশক পান করে মারা যায়। ময়না ভাবে আল্লাহর দয়ায় হামার সংসারটা বাঁচি গেইছে, সে চোখের পানি মুছতে মুছতে বিড়বিড় করে বলে-
-ডাঃ দাদু মানুষ নয় ফেরেশতা। হে দয়াল আল্লাহ তার ভালো করো।
আগের অংশ
কাজী লাবণ্য, ঢাকা থেকে
|