bangla-sydney













কাউসার খানের প্রতিবেদন
সাম্প্রতিক অস্ট্রেলিয়া (৪১)

হামলায় কি ঘটেছে সিডনির বন্ডাই শপিংমলে


অস্ট্রেলিয়ার সিডনির বণ্ডাই ওয়েস্টফিল্ড শপিং মলে আচমকা এক ব্যক্তির এলোপাতাড়ি ছুরিকাঘাতে ৬ জন নিহত এবং ১২ জন মারাত্মক জখম হওয়ার ঘটনা ঘটেছে। এরপর পুলিশের গুলিতে এই আক্রমণকারী ব্যক্তিও নিহত হন। গত ১৩ এপ্রিল শনিবার সিডনির জনপ্রিয় ভ্রমণ গন্তব্য বণ্ডাই সমুদ্র সৈকতের নিকটবর্তী ওয়েস্টফিল্ড বণ্ডাই শপিং সেন্টারে এই মর্মান্তিক হামলা ঘটে। সাম্প্রতিক দশকের মধ্যে এটিই দেশটির সবচেয়ে মারাত্মক গণ-সহিংসতার ঘটনা বলে আখ্যায়িত করা হয়েছে। তবে দেশটির পুলিশ এখন পর্যন্ত নিশ্চিত করেছে, এই ঘটনার পেছনে কোনো জঙ্গিবাদ বা নির্দিষ্ট কোনো উদ্দেশ্য নেই। গত রোববার পর্যন্ত সরেজমিনে বণ্ডাই পরিদর্শন করেছেন এই প্রতিবেদক। কোনো বাংলাদেশির হতাহতের খবর পাওয়া যায় নি।


সিডনির দুপুরে আচমকা হামলা

সিডনির সময় দুপুর ৩:২০। এক ব্যক্তি প্রায় ১ ফুট লম্বা ছুড়ি হাতে সিডনির ওয়েস্টফিল্ড বণ্ডাই জংশন শপিং সেন্টারে প্রবেশ করে। এর পরপরই এই ব্যক্তি এলোপাতাড়ি ভাবে টানা ৯ জনকে ছুড়ি দিয়ে আঘাত করে। শপিং মলের ভিতর শতাধিক মানুষের ছোটাছুটি শুরু হয়ে যায়। এরপর আক্রমণকারী এদিক ওদিক দৌড়ে আরও ৯ জনকে আঘাত করে।


হামলার শিকার হলেন যারা

সিডনির এই হামলায় শিকার বেশিরভাগই নারী। ছুরিকাঘাতে ঘটনাস্থলে ৫ জন এবং হাসপাতালে নেওয়ার পর আরও একজন নিহত হয়েছেন। নিহতদের মধ্যে ৫ জনই নারী এবং আক্রমণকারীকে বাঁধা দেওয়ার চেষ্টায় শপিং মলের নিরাপত্তাকর্মী একজন পুরুষ রয়েছেন। এরমধ্যে একজন চীনের শিক্ষার্থীও রয়েছেন। আহত ১২ জনের মধ্যে ৯ মাস বয়সী মেয়ে শিশু থেকে ৫৫ বছর বয়সী নারীও রয়েছেন। আহতদের মধ্যে ৮ জন গুরুতর অবস্থায় চিকিৎসাধীন রয়েছেন।


আক্রমণকারী পুলিশের গুলিতে নিহত

জরুরী অবস্থার কল পেয়ে দ্রুত ঘটনাস্থলে পৌঁছায় পুলিশ। তৎক্ষণাৎ পুলিশ গোটা শপিং মল এবং আশপাশের এলাকা বন্ধ করে দেয়। প্রথমে পরিস্থিতি সামাল দেওয়ার চেষ্টা করেন তাঁরা। আক্রমণকারীর গতিবিধি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাওয়ায় পুলিশ আক্রমণকারীকে গুলি করে এতে ঘটনাস্থলেই নিহত হয় আক্রমণকারী।


কোনো বাংলাদেশি হতাহত হননি

বণ্ডাই এলাকায় অনেক বাংলাদেশিদের ব্যবসা এবং বাংলাদেশি কর্মী রয়েছে। তবে এখন পর্যন্ত কোনো বাংলাদেশির হতাহতের খবর পাওয়া যায় নি।


আক্রমণকারী অস্ট্রেলিয়ার কুইন্সল্যান্ড রাজ্যের বাসিন্দা

নিহত আক্রমণকারীকে শনাক্ত করেছে পুলিশ। তাঁর নাম জোল কাওচি, বয়স ৪০। তিনি অস্ট্রেলিয়ার সিডনির রাজ্য নিউ সাউথ ওয়েলস রাজ্যের পার্শ্ববর্তী কুইন্সল্যান্ড রাজ্যের বাসিন্দা ছিলেন। জোল ‘ব্যাগপ্যাকার’ ভ্রমণকারী ছিলেন, অর্থাৎ তাঁর নির্দিষ্ট কোন ঠিকানা নেই। তিনি একটি গাড়িতে বসবাস করতেন। এক মাস আগে তিনি সিডনিতে ঘুরাঘুরি শুরু করেন। তিনি বেকার এবং অবিবাহিত। পরিবার হিসেবে তাঁর মায়ের সঙ্গে গত মার্চ মাসে তিনি শেষবার কথা বলেছিলেন। বলা হচ্ছে, ১৭ বছর বয়স থেকে মানসিক সমস্যায় ভুগছিলেন জোল। হামলার এক ঘণ্টা আগেও ঘটনাস্থলের কাছেই তিনি স্বাভাবিকভাবে মুরগির তরকারি আর ভাত দিয়ে দুপুরের খাবার খেয়েছিলেন। এর আগে তাঁর বিরুদ্ধে রাজ্য পুলিশের কাছে কোনো অপরাধের রেকর্ড নেই।


প্রত্যক্ষদর্শী বাংলাদেশির বক্তব্য

শপিংমলটির ভেতরের লবস্টার টেইল সীফুড রেস্টুরেন্টের শেফ হিসেবে কাজ করেন প্রবাসী বাংলাদেশি সিডনির রকডেলের বাসিন্দা সুমন আহমেদ। শুধুমাত্র শপিংমলটিতেই ৫০’র অধিক বাংলাদেশি বিভিন্ন পেশায় কাজ করেন বলে জানিয়েছেন তিনি। পুলিশের ডাকে গিয়ে শপিংমলের বাইরে অবস্থানকালে মুঠোফোনে এই প্রতিবেদকের সঙ্গে কথা হয় তাঁর। হামলার সময়ের ঘটনার বর্ণনায় তিনি বলেন, ‘আমাদের তো সীফুডের রেস্টুরেন্ট। পুলিশ ভিতরের সব বন্ধ করে রেখেছে। তাঁরা ফোন করে জানিয়েছে সামুদ্রিক মাছ পচে দুর্গন্ধ ছড়াচ্ছ। আমাদের কেউ যেন এসে পুলিশ পাহাড়ায় তা পরিষ্কার করে যায়, তাই এসেছি।...ওয়েস্টফিল্ড শপিং সেন্টার এমনিতেই একটি ব্যস্ত জায়গা। প্রচুর ভীড় হয় আর সাপ্তাহিক ছুটির দিন হওয়ায় সেদিন আরও বেশি ভীড় ছিল। আমি একটু বিরতিতে রেস্টুরেন্টের বাইরে এসে হাঁটাহাঁটি করছিলাম। তখন দেখি প্রচুর মানুষ ছোটাছুটি করছে। কয়েকজন এসে ভয়ে ক্রন্দনরত অবস্থায় বলছিল, ওদিক যেও না, ও সবাইকে মেরে ফেলছে, ভাগো ভাগো। পরে আমিও দৌড়ে বাইরে চলে যাই আর এর মিনিট দশেক পর পুলিশ আসে।


সার্বিক পরিস্থিতি

ওয়েস্টফিল্ড বণ্ডাই জংশন শপিং সেন্টার এলাকা এখন শোক আর আতঙ্কের ছায়ায় ছেয়ে রয়েছে। বণ্ডাই দেশি-বিদেশি ভ্রমণকারীদের জন্য একটি জনপ্রিয় গন্তব্যস্থল। আর শপিং সেন্টারটিতে তিন হাজারেরও বেশি গাড়ি পার্কিং করার স্থান রয়েছে। এত বিশাল একটি শপিংমলসহ আশপাশের আর অনেক দোকানপাট কড়া পুলিশি পাহাড়ায় বন্ধ রাখা হয়েছে। এর মধ্যে জোল কাওচির পরিবারের সঙ্গে যোগাযোগ করেছে কুইন্সল্যান্ড রাজ্য পুলিশ। তাঁরা পুলিশকে সার্বিক সহযোগিতা করবেন বলে জানিয়ে একটি লিখিত বিবৃতি দিয়েছেন। সেখানে তাঁরা বলেছেন, ‘সিডনির যে মর্মান্তিক ঘটনা ঘটেছে তাতে আমরা একেবারেই ভেঙ্গে পড়েছি। সকলের ভুক্তভোগী এবং তাঁদের পরিবারের জন্য আমাদের প্রার্থনা জারি রয়েছে। জোলের কাজগুলি সত্যিই ভয়ঙ্কর ছিল।


ফুলে ফুলে নীরবতা আর শোক প্রকাশ

সরেজমিনে বণ্ডাই পরিদর্শন করেছেন এই প্রতিবেদক। তখন দেখা যায় অসংখ্য মানুষ নীরবে দাঁড়িয়ে আছেন ওয়েস্টফিল্ড বণ্ডাই জংশন শপিং সেন্টারের সামনে। পুলিশ তখনও জনসাধারণের জন্য চলাচল নিষিদ্ধ করে রেখেছিল শপিংমলসহ আশপাশের দোকানপাট। মানুষ অনেক দূর থেকে পায়ে হেঁটে এসে শপিং মলের উল্টো পাশে ফুল দিয়ে শোক প্রকাশ করছেন। আবার নিহতের পরিবার ও আহতদের জন্য সান্তনা বার্তা লেখার জন্যেও ছিল জায়গা। মোম জ্বালিয়ে কেউ কেউ প্রকাশ করছেন নীরব দুঃখ। সেখানে আবার সরকারি মানসিক স্বাস্থ্য সংস্থার কর্মীরাও উপস্থিত আছেন। তাঁদের উপস্থিতির কারণে জানতে চাইলে বলেন, ‘অনেকেই শোক প্রকাশ করতে এসে মানসিকভাবে ভেঙে পড়ছেন, তাঁদের সহযোগিতা করার জন্যই আমরা আছি।’ চারদিকে অস্ট্রেলিয়ার প্রায় সকল গণমাধ্যমের সংবাদকর্মীরা অবস্থান করছিলেন নতুন কোন তথ্য পরিবেশনের জন্য।
এদিকে, গতকাল দেশটির প্রধানমন্ত্রী অ্যান্থনি আলবানিজ ও রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী ক্রিস মিনস ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেছেন। এ সময় তাঁরা শোক প্রকাশ করেন। এই হামলার শোক প্রকাশ করে আজ অস্ট্রেলিয়ার জাতীয় পতাকা অর্ধনমিত রাখা হয়েছে।



কাউসার খান: অভিবাসন আইনজীবী, সিডনি, অস্ট্রেলিয়া। ইমেইল: immiconsultants@gmail.com





Share on Facebook               Home Page             Published on: 16-Apr-2024

Coming Events: