bangla-sydney
bangla-sydney.com
News and views of Bangladeshi community in Australia













কাউসার খানের প্রতিবেদন
সাম্প্রতিক অস্ট্রেলিয়া (৩৮)



চীন-অস্ট্রেলিয়া সম্পর্ক, ধীরে হলেও গলছে বরফ

গত বছরের মে মাসে অস্ট্রেলিয়ার জাতীয় নির্বাচনে অকল্পনীয় জয় পায় লেবার পার্টি। প্রায় এক দশক পর ক্ষমতায় এসে মন্ত্রণালয়ের ভাগ-বাঁটোয়ারা আর অস্ট্রেলিয়ার আন্তর্জাতিক সম্পর্ক পুনরুদ্ধারে ব্যস্ত হয়ে পড়ে নতুন সরকার, যার শুরুটা হয় শপথ গ্রহণের পরের দিনই প্রধানমন্ত্রী অ্যান্থনি অ্যালবানিজের সামরিক জোট ‘কোয়াড’ সম্মেলনে যোগ দেওয়ার টোকিও সফর দিয়ে। অস্ট্রেলিয়ার আন্তর্জাতিক দুশ্চিন্তার অন্যতম বিষয় এখন চীন। ফলে অস্ট্রেলিয়ার মধ্য-বাম সরকার চীনের সঙ্গে তার সম্পর্ক ঠিক করার চেষ্টা করছে, যা সাবেক রক্ষণশীল সরকারের অধীনে যথেষ্ট খারাপ হয়েছিল। একের পর এক ভুল-বোঝাবুঝি আর দোষ ছোড়াছুড়ির কারণে দেশটির সবচেয়ে বড় এই বাণিজ্যিক হাব চীনের দরজা প্রায় বন্ধের পথে ছিল। তবে নতুন বছর ২০২৩ সালে চীনের সঙ্গে সম্পর্ক উন্নয়নের আশার আলো দেখছে অস্ট্রেলিয়া। কয়েক বছর কূটনৈতিক স্থবিরতার পর ২০২২ সালের দ্বিতীয়ার্ধে অস্ট্রেলিয়া এবং চীনা প্রতিরক্ষামন্ত্রী, পররাষ্ট্রমন্ত্রী এবং সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে, উভয় দেশের শীর্ষ নেতাদের মধ্যেও দ্বিপক্ষীয় বৈঠক হয়েছে।

অস্ট্রেলিয়ার বন্ধু দেশ চীনের সঙ্গে সম্পর্কের টানাপোড়ন শুরু হয়, যখন করোনাভাইরাসের উৎপত্তি নিয়ে চীনকে স্বাধীন তদন্তের আহ্বান জানায় অস্ট্রেলিয়া। কিন্তু চীন ব্যাপারটিকে গ্রহণ করে মহামারির কারণ হিসেবে চীনকে দায়ী করা হচ্ছে—এমন দৃষ্টিকোণ থেকে। এতে অস্ট্রেলিয়ার ওপর চটে বসে চীন। শুরু হয় দুই দেশের বাণিজ্যিক বিরোধ। একের পর এক পাটকেল ছুড়তে শুরু করে চীন। অস্ট্রেলিয়া যেসব পণ্য চীনে রপ্তানি করত, প্রায় সবকিছুর ওপরই আমদানি নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে চীনা সরকার। ফলে অস্ট্রেলিয়ার সবচেয়ে বড় বাজার চীনে কয়লা, যব, তামা, বার্লি, ওয়াইনসহ বেশ কয়েকটি উল্লেখযোগ্য রপ্তানি শিল্প প্রভাবিত হয়।

অন্যদিকে সামরিক জোট হিসেবে পরিচিত ‘কোয়াড’-এ অস্ট্রেলিয়ার যুক্ততাকেও ভালো চোখে দেখেনি চীন। আর সে বিরোধে একসময়ের ঘনিষ্ঠ বন্ধু দেশ চীন অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে চলে যায়। এ বিরোধ কোনো দিকে মোড় না নিতেই অস্ট্রেলিয়ায় অবস্থানরত চীনা নাগরিকেরা বর্ণবাদের স্বীকার হচ্ছে—এমন অভিযোগে আবারও ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠে চীন। ফলে অস্ট্রেলিয়ার আন্তর্জাতিক শিক্ষা খাতে সবচেয়ে বড় অংশীদার চীনা শিক্ষার্থীদের অস্ট্রেলিয়ায় পড়তে আসা নিরাপদ নয়, এমন বিজ্ঞপ্তি দেয় চীন।
বিপরীতে চীনে বসবাসরত অস্ট্রেলিয়ান কূটনৈতিকরা নিরাপদ নয় বলেও মন্তব্য করে বসেছিল অস্ট্রেলিয়া। ফলাফলে দুই দেশই দুই দেশের কূটনৈতিক প্রতিনিধিদের ওপর জিজ্ঞাসাবাদ চালানো শুরু করে। বিষয়টিকে চীন, পররাষ্ট্র বিষয়ে অস্ট্রেলিয়ার নিকৃষ্টতম হস্তক্ষেপ বলে মন্তব্য করেছিল।

২০২১ সালে অস্ট্রেলিয়ার পারমাণবিক শক্তি-চালিত সাবমেরিন নির্মাণ চুক্তির ঘটনায়ও ক্ষিপ্ত হয়ে উঠেছিল চীন। সংক্ষেপে ইন্দো-প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে চীনের আধিপত্য ঠেকানোর জন্যই এই সাবমেরিন নির্মাণ করা হচ্ছিল বলে মতবাদ ছড়িয়ে পড়ে। আর এতে অস্ট্রেলিয়াকে ‘যুক্তরাষ্ট্রের মাউথ-পিস’ বলে মন্তব্যও করে চীন। এ ছাড়া অস্ট্রেলিয়াতে একটি বড় ধরনের সাইবার হামলাও হয়, যার দোষ দেওয়া হয় চীনকে। সব মিলিয়ে দুই দেশের কাদা ছোড়াছুড়িতে অস্ট্রেলিয়া-চীনের সম্পর্ক একেবারে কাদায় মাখামাখি হয়ে ওঠে।

অস্ট্রেলিয়ার নতুন সরকার ক্ষমতায় এলে চীনের সঙ্গে বন্ধুত্ব আবারও গড়ে তোলা এবং বাণিজ্য চালু করায় মনোনিবেশ করে লেবার পার্টি। এর ফল দেখা যায় নতুন সরকারের মন্ত্রণালয়ে। এশিয়ায় জন্মগ্রহণকারী চীনা বংশোদ্ভূত পেনি ওংকে দেওয়া হয় অস্ট্রেলিয়ায় পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব। আর এর সুফল পেতে বেশি দিন অপেক্ষা করতে হয়নি অস্ট্রেলিয়াকে। ২০২২ সাল শেষ হওয়ার আগেই দুই দেশের প্রতিরক্ষামন্ত্রী, পররাষ্ট্রমন্ত্রী এবং সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়, উভয় দেশের শীর্ষ নেতারা দ্বিপক্ষীয় বৈঠকে বসেছেন। গত ডিসেম্বর ছিল দুই দেশের মধ্যে কূটনৈতিক সম্পর্ক প্রতিষ্ঠার ৫০তম বার্ষিকী। এ উপলক্ষে বেইজিং-এ আয়োজিত ষষ্ঠ অস্ট্রেলিয়া-চীন বৈদেশিক ও কৌশলগত সম্মেলনে যোগ দেন দুই দেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী পেনি ওং এবং ওয়াং ই। সম্মেলন শেষে পেনি ওং বলেন, ‘আমরা আমাদের দুই দেশের মধ্যে সম্পর্ক স্থিতিশীল করার দিকে আরও একটি ধাপ এগিয়ে গেলাম।’
বিগত বছরে চীনের সঙ্গে নানান বিবাদে জড়িয়ে অস্ট্রেলিয়া তার কূটনীতিক শক্তিকে আবার আবিষ্কার করতে পেরেছে। তবে চীনের সঙ্গে সম্পর্ক উন্নয়নের ক্ষেত্রে এ শিক্ষা কতটুকু কার্যকর হলো, তা প্রমাণে ২০২৩ সালে আবারও পরীক্ষার সম্মুখীন হবে অস্ট্রেলিয়া। যদিও অস্ট্রেলিয়ার নতুন সরকার আগের সরকারের চেয়ে কূটনৈতিকভাবে অনেক বেশি অগ্রসরমান বলে ধারণা রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের। তবে বাস্তবতা হলো, অস্ট্রেলিয়া-চীন সম্পর্ক সেই হারে এগিয়ে যাচ্ছে না। তাহলে প্রশ্ন ওঠে, ২০২৩ সালে অস্ট্রেলিয়া-চীন সম্পর্কের উন্নয়নের বিশেষ চ্যালেঞ্জ কি? পাঁচটি বিষয়কে প্রধান করে দেখছেন রাজনৈতিক বিশ্লেষকেরা।

চ্যালেঞ্জ একঃ যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বাধীন সাবমেরিন প্রকল্প ‘এইউকেইউএস’, সামরিক জোট ‘কোয়াড’, গোয়েন্দা সংস্থা ‘ফাইভ আই’-এর মতো কথিত চীনের আধিপত্য ঠেকানোর সংগঠনগুলোতে অস্ট্রেলিয়ার ঘনিষ্ঠতা। যদিও কোনো পক্ষ পছন্দের পরিস্থিতিতে নেই অস্ট্রেলিয়া। তবে অস্ট্রেলিয়ার এ পরিস্থিতিকে বন্ধু-সুলভ নাকি অন্য দৃষ্টিতে দেখবে, তা নির্ভর করবে একান্তই চীনের ওপর।

চ্যালেঞ্জ দুইঃ অস্ট্রেলিয়ায় চীনা বিনিয়োগ বিষয়ে একচোখা দৃষ্টিভঙ্গি রয়েছে বলে মনে করে চীন। ফলে অস্ট্রেলিয়ার অন্যতম সমুদ্রবন্দর ডারউইনকে ৯৯ বছরের জন্য চীনা প্রতিষ্ঠানের কাছে ইজারা দেওয়া না-দেওয়া নিয়ে সৃষ্ট পরিস্থিতি ঠিকভাবে সামাল দেওয়া।

চ্যালেঞ্জ তিনঃ লিথিয়ামসহ আরও খনিজ সম্পদ রয়েছে অস্ট্রেলিয়ার, যার প্রধান ক্রেতা চীন। খনিজ সম্পদ সরবরাহ নিয়ে কানাডা, ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন ও যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে চীনকে চাপে রাখা না-রাখা।

চ্যালেঞ্জ চারঃ গত বছর অস্ট্রেলিয়া ও চীন উভয়কেই প্রশান্ত মহাসাগরীয় দেশগুলোকে সুরক্ষা সহযোগিতা করার নামে সমুদ্রাঞ্চলে আধিপত্য দেখানোর প্রতিযোগিতায় মত্ত হতে দেখা যায়। আর এসব দ্বীপরাষ্ট্রের মধ্যে অন্যতম সলোমন দ্বীপপুঞ্জ। এখানে প্রতিযোগিতা হ্রাস করা না-করা।

চ্যালেঞ্জ পাঁচঃ দ্বীপরাষ্ট্রের প্রতিযোগিতায় আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ ইস্যু হলো, পাপুয়া নিউগিনির কূটনৈতিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ এবং প্রাকৃতিক সম্পদ-সমৃদ্ধ অঞ্চল বোগেনভিলের স্বাধীনতা। চলতি বছর সংসদীয় ভোটে এ অঞ্চলকে স্বাধীনতা দেওয়া হবে কি না, তা নিয়ে একটি বিতর্ক রয়েছে, যার প্রভাব রয়েছে অস্ট্রেলিয়া-চীন সম্পর্কে। অস্ট্রেলিয়ার সবচেয়ে নিকটবর্তী প্রতিরক্ষা অংশীদার পাপুয়া নিউগিনি। আর এখানে বোগেনভিলের স্বাধীনতা মানে বাণিজ্যিক সহযোগিতার নামে চীনের অনুপ্রবেশ, যা অস্ট্রেলিয়ার ভয়ের বিষয়। এ নিয়ে কূটনৈতিক সমাধান করা না-করা।

যদিও সামনে থাকা এসব চ্যালেঞ্জ ছাড়াও কিছু ইস্যু আছে, সম্পর্ক উন্নয়নে দ্রুত হাত দিতে হবে বলে বিশেষজ্ঞদের মত। উদাহরণস্বরূপ, গত বছর চীনা এবং পশ্চিমা সামরিক বিমান ও নৌযানগুলোর মধ্যে বেশ কয়েকটি বিপদজ্জনক সংঘর্ষ দেখা দিয়েছিল, যা অনিরাপদ ও অগ্রহণযোগ্য হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে। যদিও অস্ট্রেলিয়া এ ধরনের সংঘর্ষ ঠেকাতে একটি নির্দেশিকা প্রণয়নের প্রস্তাব রেখেছে।
অন্যদিকে রাজনৈতিক বিশ্লেষকেরা এ-ও মনে করেন, এক বৈঠকেই সম্পর্ক আগের পর্যায়ে পৌঁছে যাবে, বিষয়টি এমনও নয়। সম্পর্কের এ ঘা শুকাতে সময় লাগবে দীর্ঘ। এখন পর্যন্ত ২০২৩ সালের ৩১ অক্টোবরে অস্ট্রেলিয়ার প্রধানমন্ত্রী অ্যান্থনি অ্যালবানিজের বেইজিং সফরের একটা পেনসিল মার্ক করা গেছে মাত্র। সবকিছু ঠিক থাকলে ওই সফরের পর হয়তো বরফ আরও গলতে পারে দুই দেশের টানাপোড়ন সম্পর্কের।
আবার এর মধ্যেও টক-ঝালের অভাব নেই। প্রায়ই এটা-সেটা ঘটছে। সম্প্রতি অস্ট্রেলিয়া চীনের আঞ্চলিক প্রতিদ্বন্দ্বী জাপানের সঙ্গে একটি নতুন নিরাপত্তা চুক্তিতে স্বাক্ষর করেছে, যা প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে বেইজিংয়ের শক্তি সীমিত করার প্রচেষ্টা হিসেবে দেখা হচ্ছে। এতে অস্ট্রেলিয়াকে সতর্ক করে চীন বলেছে, দেশটির আঞ্চলিক শক্তির সঙ্গে মিলিত হওয়ার আগে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় জাপানের যুদ্ধাপরাধের কথা মনে রাখতে। অস্ট্রেলিয়ায় চীনের রাষ্ট্রদূত জিয়াও কিয়ান ‘চীন অস্ট্রেলিয়ার বন্ধু’এ কথা উল্লেখ করেন বলেন, ‘দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় অস্ট্রেলিয়ার ওপর আক্রমণের কারণে জাপানকে বিশ্বাস করার বিষয়ে সতর্ক হওয়া উচিত অস্ট্রেলিয়াকে।’ ফলে চীন-অস্ট্রেলিয়ার সম্পর্কের বরফ গলতে শুরু করলেও ২০২৩ সালে দুই দেশের যেকোনো সিদ্ধান্তই তাদের জাতীয় স্বার্থ ও দ্বন্দ্বকে যেকোনো দিকে ঠেলে দিতে পারে। অব্যাহত থাকতে পারে বাণিজ্যিক দ্বন্দ্ব ও আন্তর্জাতিক উত্তেজনা। এরপরও এই বিপজ্জনক সন্ধিক্ষণের কাছে আসার সঙ্গে অস্ট্রেলিয়ার জন্য সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ থাকবে কূটনৈতিক নৈপুণ্য ও প্রত্যাশার মধ্যে ভারসাম্য বজায় রাখা।



কাউসার খান: অভিবাসন আইনজীবী, সিডনি, অস্ট্রেলিয়া। ইমেইল: immiconsultants@gmail.com





Share on Facebook               Home Page             Published on: 31-Jan-2023

Coming Events:





A day full of activities, games and fun.







Blacktown Lakemba Mascot