কাউসার খানের প্রতিবেদন সাম্প্রতিক অস্ট্রেলিয়া (২৯)
শিক্ষার্থী ভিসায় নতুন সুবিধা
উচ্চশিক্ষা গ্রহণের দিক থেকে অস্ট্রেলিয়া বর্তমানে বিশ্বের তৃতীয় জনপ্রিয়তম দেশ। এক পরিসংখ্যান অনুযায়ী প্রায় আট লাখ আন্তর্জাতিক শিক্ষার্থী রয়েছেন দেশটিতে। তবে অন্য সব পেশার মানুষের মতোই শিক্ষার্থীদের ওপর প্রভাব পড়েছে বৈশ্বিক করোনাভাইরাস মহামারির। আর বিপুল সংখ্যক আন্তর্জাতিক শিক্ষার্থীর জন্য নতুন নীতি প্রণয়ন করেছে অস্ট্রেলিয়ার সরকার। শিক্ষার্থীদের সহায়তা করতেই মূলত বেশ কয়েকটি নতুন পরিবর্তন আনা হয়েছে। এর মধ্যে বিনা মূল্যে স্টুডেন্ট ভিসায় নতুন করে আবেদন করা এবং পোস্ট-স্টাডি ওয়ার্ক ভিসায় আবেদন করার যোগ্যতা প্রদানও রয়েছে। গতকাল সোমবার দেশটির অভিবাসন বিভাগ নতুন শিক্ষার্থী ভিসার পরিবর্তনগুলো ঘোষণা দেয়। পাঁচটি পরিবর্তন নিয়ে চালু হচ্ছে অস্ট্রেলিয়ার স্টুডেন্ট সাব ক্লাস ৫০০ ভিসা ও গ্র্যাজুয়েট সাব ক্লাস ৪৮৫ ভিসা।
প্রায় ৪০ বিলিয়ন অস্ট্রেলীয় ডলারের আন্তর্জাতিক শিক্ষার্থী খাতে আনা অস্ট্রেলিয়ার সরকারের নতুন পাঁচটি পরিবর্তনগুলো হলো:
১. অস্ট্রেলিয়ার বাইরে থেকে আবেদন করা শিক্ষার্থী ভিসা পুনরায় প্রদান শুরু করা হবে। এর মানে হলো যখন আন্তর্জাতিক সীমানা খুলে দেওয়া হবে, তখন শিক্ষার্থীদের কাছে ইতিমধ্যে ভিসা থাকবে এবং তাঁরা শুধু ভ্রমণের ব্যবস্থা করবেন।
২. আন্তর্জাতিক শিক্ষার্থীরা কোভিড-১৯ এর কারণে তাঁদের মূল ভিসার মেয়াদের মধ্যে পড়াশোনা শেষ করতে না পারলে তাঁরা আবার বিনা খরচায় শিক্ষার্থী ভিসার আবেদন করতে পারবেন।
৩. কোভিড-১৯ এর কারণে অস্ট্রেলিয়ার বাইরে অনলাইনে অধ্যয়নরত বর্তমান শিক্ষার্থী ভিসা-ধারীরা পড়াশোনা শেষে অস্ট্রেলিয়ায় কর্ম ভিসার জন্য আবেদন করার জন্য সেই পড়াশোনাকে যোগ্যতা হিসেবে ব্যবহার করতে পারবেন।
৪. যেসব স্নাতক-ধারী শিক্ষার্থী ভিসা নিয়েছিলেন, তাঁরা কোভিড-১৯ এর কারণে নিজ দেশে ফিরতে না পারলে অস্ট্রেলিয়ায় পোস্ট-স্টাডি ওয়ার্ক ভিসার জন্য আবেদন করতে পারবেন।
৫. আবেদনকারীদের ইংরেজি ভাষার দক্ষতা প্রমাণের সনদ প্রদানের জন্য অতিরিক্ত সময় দেওয়া হবে। নতুন এই নীতি প্রণয়ন করার সময় দেশটির ভারপ্রাপ্ত অভিবাসন মন্ত্রী অ্যালান টজ বলেন, ‘আশা করছি, এই পরিবর্তনগুলো আমাদের শিক্ষা খাতকে পুনরুদ্ধারে সহায়তা করবে। যা আমাদের চতুর্থ বৃহত্তম খাত।’
চীনের জন্য প্রস্তুত হচ্ছে অস্ট্রেলিয়া
চীনকে বরাবরই সবচেয়ে বড় বাণিজ্যিক বন্ধুর চোখে দেখেছে অস্ট্রেলিয়া। কিন্তু চীনের একগুঁয়েমি স্বভাবের কারণে দেশটির প্রতি আস্থা হারাচ্ছে অস্ট্রেলিয়া। করোনা পরবর্তী বিশ্বের জন্য নিজেদের তাই প্রস্তুত রাখতে সামরিক বাহিনীকে সম্পূর্ণ নতুনভাবে প্রস্তুত করবে অস্ট্রেলিয়া। দেশটির প্রতিরক্ষা বাহিনীর আগামী দশ বছরের ৪০ শতাংশ বর্ধিত বাজেট পরিকল্পনা করেছে মরিসন সরকার। দূরগামী ক্ষেপণাস্ত্র, সুপারসনিক আগ্নেয়াস্ত্র এবং অত্যাধুনিক যুদ্ধজাহাজ ও বিমান কেনা সহ নানা খাতে প্রায় ২৭ হাজার কোটি অস্ট্রেলীয় ডলার ব্যয় করার কথা রয়েছে। এশিয়া এবং প্রশান্ত-মহাসাগরীয় অঞ্চলে ক্ষমতার বিস্তার নিয়ে যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের মধ্যকার সৃষ্ট প্রতিযোগিতাকেও মারাত্মক ঝুঁকি হিসেবে দেখছে অস্ট্রেলিয়া। গত পহেলা জুলাই অস্ট্রেলিয়ার প্রধানমন্ত্রী স্কট মরিসন এসব কথা জানান। চীনকে সন্তুষ্ট করে চলার বহু চেষ্টা বেশিরভাগ সময়ই দেখা যেত দেশটির বিভিন্ন নেতাকর্মীদের। তবে চলতি করোনাকালের শুরুতে চীনকে ভাইরাসের মুল উৎপত্তিস্থল কিনা তা শনাক্তকরণের নিরপেক্ষ আন্তর্জাতিক তদন্ত দাবি করেছিল অস্ট্রেলিয়ার সরকার। আর সে থেকেই দুই দেশের সুসম্পর্কের অবনতি ঘটে। অন্যদিকে এশিয়া এবং প্রশান্ত-মহাসাগরীয় অঞ্চলে চলমান সীমান্তের লড়াই নিয়ে চীনকে মূল ক্রীড়ানক হিসেবে ইঙ্গিত করেছে প্রধানমন্ত্রী মরিসন। আর এমন ঘটনাকে কেন্দ্র করেই নতুন প্রতিরক্ষা কৌশল গ্রহণ করবে অস্ট্রেলিয়া। দেশটি তাদের সৈন্য সংখ্যা বাড়ানোর পাশাপাশি দূরপাল্লার ক্ষেপণাস্ত্র কেনার কথাও রয়েছে। প্রস্তাবিত পরিকল্পনা অনুযায়ী আগামী চার বছরে অস্ট্রেলিয়ার প্রতিরক্ষা বাহিনীতে নতুন ৮০০ সেনা যুক্ত করা হবে এবং নৌবাহিনীতে ৬৫০ জন ও বিমান বাহিনীতে ১০০ জন। নতুন প্রতিরক্ষা কৌশলের পরিকল্পনা জানানোর সময় প্রধানমন্ত্রী মরিসন বলেন, ‘অস্ট্রেলিয়া চায় এশিয়া এবং প্রশান্ত-মহাসাগরীয় অঞ্চল স্বাধীন থাকবে এবং যেকোনো একটি দেশের নিয়ন্ত্রণ সেখানে চলবে না।‘ প্রধানমন্ত্রী আরও জানান, সীমান্ত ও বাণিজ্য সহ নানান কারণে যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের মধ্যে বিরোধ গত কয়েক বছরে বেড়েছে। আর তাদের এই বিভেদ এখন পর্যন্ত চরম পর্যায়ে। করোনার মহামারি এই বিরোধকে আরও খারাপের দিকে নিয়ে গেছে যা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর বৈশ্বিক নিরাপত্তার সবচেয়ে অস্থিতিশীল দিক। এ প্রসঙ্গে মরিসন বলেন, ‘যেকোনো সময় একটি ভুল সিদ্ধান্ত মারাত্মক ভয়াবহতা ডেকে আনতে পারে। আর সেজন্য আমরা নিজেদের প্রস্তুত করে তুলছি।‘ এসময় তিনি ভারত ও চীনের চলমান সীমান্ত বিরোধের কথাও উল্লেখ করেন। অন্যদিকে মরিসনের প্রস্তাবিত প্রতিরক্ষা বাজেটে প্রকাশ করার পর থেকে মিশ্র প্রতিক্রিয়া দেখা দেয় দেশটির অর্থনীতিবিদদের মধ্যে। প্রতিরক্ষা খাতে সরকারের বাজেট অস্ট্রেলিয়ার জিডিপি’র প্রায় দুই শতাংশ। বাজেটের বেশিরভাগই ব্যয় হবে অস্ত্র ও সামরিক সরঞ্জাম উন্নয়নে। অস্ট্রেলিয়া তাদের নৌবাহিনীর জন্য যুক্তরাষ্ট্রের নৌবাহিনীর কাছ থেকে এজিএম ১৫৮ সি ধরনের ২০০টি দীর্ঘ যুদ্ধজাহাজ ও ক্ষেপণাস্ত্র কিনবে যা ৩৭০ কিলোমিটার দূরে আক্রমণ করতে পারে। সামরিক শক্তির পাশাপাশি সাইবার আক্রমণ ঠেকাতেও আরও তৎপরতা বৃদ্ধি করছে অস্ট্রেলিয়া। সাইবার খাতে দেড় হাজার কোটি অস্ট্রেলীয় ডলার বিনিয়োগ হবার কথা রয়েছে। গত মাসে অন্য কোনো দেশের ইন্ধনে অস্ট্রেলিয়ার বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের ওপর সাইবার হামলার চেষ্টা করা হয়েছে অভিযোগ করে প্রধানমন্ত্রী মরিসন বলেন, ‘ভবিষ্যতে এই খাতে বড়সড় হুমকি মোকাবিলা করতে হবে।‘
আবার দ্রুত ছড়াচ্ছে করোনা
অস্ট্রেলিয়ায় করোনাভাইরাসের শুরু থেকে সবচেয়ে বেশি সংক্রমণ হয়েছে গত বুধবার। দেশজুড়ে গত ২৪ ঘণ্টায় নতুন করে আক্রান্ত হয়েছেন ৫০২ জন। তার মধ্যে প্রায় ৯৫ শতাংশই হচ্ছে মেলবোর্নের রাজ্য ভিক্টোরিয়ায়। ওই রাজ্যে গত ২৪ ঘণ্টায় নতুন করে আক্রান্ত হয়েছেন ৪৮৪ জন। এ ভাইরাসে এখন পর্যন্ত দেশটিতে মৃত্যুবরণ করেছেন ১২৮ জন। এখন পর্যন্ত অস্ট্রেলিয়ায় একজন বাংলাদেশি আক্রান্ত হয়েছেন। তিনি সম্প্রতি বাংলাদেশ থেকে এসে মেলবোর্নে হোটেল কোয়ারেন্টিন শেষ করেছিলেন। তারপর সিডনিতে কাজে যোগদানের দুই দিনের মাথায় করোনা পরীক্ষার পজিটিভ রিপোর্ট আসে। তিনি ভালো আছেন।
অস্ট্রেলিয়ায় করোনাভাইরাসের এটা দ্বিতীয় প্রবাহ। প্রথম প্রবাহ প্রায় সামলিয়ে নিয়েছিল দেশটি। সংক্রমণ কমে প্রায় শূন্যের কোঠায় চলে এসেছিল। পুরোপুরি নির্মূলের প্রত্যাশা নিয়ে দেশজুড়ে নতুন কর্মপরিকল্পনা ঘোষণা করেছিল দেশটির সরকার। কিন্তু গত মাসের শেষ দিক থেকে আবার বাড়তে থাকে করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাব।
প্রথম প্রবাহে অস্ট্রেলিয়ার প্রধান বাণিজ্যিক শহর সিডনিতে আক্রান্তের সংখ্যা ছিল দেশটির আটটি রাজ্য ও অঞ্চল থেকে অনেক বেশি। কিন্তু এবার এই মহামারির ভরকেন্দ্র হচ্ছে মেলবোর্ন শহর। ২২ জুলাই বুধবার সিডনির রাজ্য নিউ সাউথ ওয়েলসে মোট শনাক্তকরণ হয়েছে ১৬ জন। এর আগে এই রাজ্যে দ্বিতীয় ধাপের সংক্রমণে একটি পাবলিক বারে যাওয়া–আসা প্রায় ৫৩ জনকে কোভিড-১৯ আক্রান্ত পাওয়া গেছে। আক্রান্ত ব্যক্তিদের জিনোম সিকোয়েন্সিং বা জিন নকশা পরীক্ষা করে দেখা গেছে, আক্রান্ত ব্যক্তিরা ভিক্টোরিয়া রাজ্যের সংযুক্ত। তাঁরা কোনো না কোনোভাবে ভিক্টোরিয়া রাজ্যের ঝুঁকিপূর্ণ করোনাভাইরাস এলাকা থেকে ঘুরে এসেছেন। ফলে এবারের সংক্রমণ ঠেকাতে ভিক্টোরিয়া রাজ্যের সঙ্গে দেশটির সব রাজ্যের সীমান্ত বন্ধ রয়েছে। তবে ঠিক কীভাবে ভিক্টোরিয়া রাজ্যে ভাইরাসটি এত দ্রুত আবার ছড়িয়ে পড়ছে, তা নিয়ে চুলচেরা তদন্ত চলছে। বুধবার এক তদন্ত রিপোর্টে বলা হয়েছে, দেশটির নাগরিক ও স্থায়ী বাসিন্দা যারা বাইরে থেকে এসে হোটেল কোয়ারেন্টিনে ছিলেন, তারা স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলেননি। তাঁদের দেখভাল করার জন্য যে প্রহরী নিয়োগ দেওয়া হয়েছিল, তারাও তাদের কাজের নিয়ম মেনে চলেননি। তারা নিয়ম ভেঙে হোটেল কোয়ারেন্টিনে থাকা মানুষের সঙ্গে রাত্রি যাপন করেছেন, এমন অভিযোগও উঠেছে। এবারের সংক্রমণ ছড়ানোর পেছনে বিষয়টি অন্যতম কারণ বলে তদন্তে উঠে এসেছে। ভাইরাসটির গতিবিধি, ধরন, গড়ন বোঝার জন্য ব্যাপক হারে জিন নকশা উন্মোচন করে যাচ্ছে দেশটি। ভিক্টোরিয়া রাজ্যে বর্তমানে লকডাউন চলছে। রাজ্যটিতে মাস্ক ব্যবহার করা এখন বাধ্যতামূলক। নিউ সাউথ ওয়েলসে ২৪ জুলাই থেকে বিধিনিষেধ আরও কঠিন হচ্ছে। গণ পরিবহনে মাস্ক ব্যবহার বাধ্যতামূলক করার পরিকল্পনা করছে রাজ্যের সরকার। ভিক্টোরিয়া রাজ্যে লকডাউন থাকার পরও করোনাভাইরাস সংক্রমণ উত্তরোত্তর বাড়তে থাকায় রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী (প্রিমিয়ার) ড্যানিয়েল অ্যান্ড্রুস হতাশা ব্যক্ত করেছেন। তিনি বলেন, ১০ জনের মধ্যে ৯ জনই সঠিক স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলছেন না। ৩ হাজার ৮১০ জন পজিটিভ করোনা আক্রান্ত ব্যক্তির মধ্যে অসুস্থ হলেও ৩ হাজার ৪০০ জন নিজেকে ঘর-বন্দী করেননি। অন্যদিকে, বিদেশি শিক্ষার্থীদের ব্যাপারে দেশটি সরকার ইতিবাচক কিছু পদক্ষেপ নিয়েছেন। এখন থেকে ভিসা–সংক্রান্ত কিছু বাড়তি সুবিধা পাবেন আন্তর্জাতিক শিক্ষার্থীরা। করোনাকালে দেশটির নাগরিক ও স্থায়ী বাসিন্দাদের জন্য দেওয়া প্রণোদনা আগামী বছর মার্চ মাস পর্যন্ত বর্ধিত করা হয়েছে।
কাউসার খান: অভিবাসন আইনজীবী, সিডনি, অস্ট্রেলিয়া। ইমেইল: immiconsultants@gmail.com
|