কাউসার খানের প্রতিবেদন সাম্প্রতিক অস্ট্রেলিয়া (২৮)
সিডনিতে করোনায় আক্রান্ত প্রথম বাংলাদেশি
অস্ট্রেলিয়ার সিডনিতে এই প্রথম কোনো বাংলাদেশি কোভিড-১৯-এ আক্রান্ত হয়েছেন। তিনি বাংলাদেশ থেকে সদ্য ফিরে গত রোববার কাজে যোগ দিয়েছিলেন। কিন্তু সেখানে তিনি অসুস্থ বোধ করলে করোনাভাইরাস পরীক্ষা করার পরামর্শ দিয়ে বাসায় পাঠিয়ে দেওয়া হয় তাঁকে। গত বুধবার দুপুরে তাঁর করোনাভাইরাস পরীক্ষার ফল পজিটিভ আসে। গতকালই তাঁকে বাসা থেকে স্থানীয় কোয়ারেন্টিন কেন্দ্রে নিয়ে সঙ্গ-নিরোধ করে রাখা হয়েছে। তিনি সিডনির দক্ষিণাঞ্চল শহরতলি আর্নক্লিফে দুজন বাংলাদেশির সঙ্গে থাকতেন। অন্যদিকে, সম্ভাব্য সংস্পর্শে আসা তাঁর কর্মক্ষেত্রের ৫০ জন কর্মীকে বাধ্যতামূলক সঙ্গ-নিরোধ করে রাখা হয়েছে। তিনি সিডনির মধ্য-পশ্চিমাঞ্চল ব্যালমেইনে অস্ট্রেলিয়ার বৃহৎ চেইন সুপার মার্কেট উলওয়ার্থসে কাজ করতেন।
নিউ সাউথ ওয়েলস রাজ্যের প্রধান স্বাস্থ্য কর্মকর্তা কেরি চ্যান্ট গণমাধ্যমে বলেন, সংক্রমিত ব্যক্তি কম ঝুঁকিপূর্ণ। উলওয়ার্থসের পাওয়া প্রতিবেদনগুলো থেকে জানা গেছে, সংক্রমিত ব্যক্তি কাজ করার সময় সুপার মার্কেটটিতে ভিড় ছিল না। তবে রাজ্যের স্বাস্থ্যমন্ত্রী ব্র্যাড হ্যাজার্ড বলেন, ব্যালমেইনের উলওয়ার্থসে কেনাকাটা করা লোকদের সতর্ক থাকা উচিত।
আর্নক্লিফে বসবাসরত সংক্রমিত ব্যক্তির প্রতিবেশী ফখরুজ্জামান লেনিন বলেন, করোনাভাইরাস মহামারি রূপ নেওয়ার আগেই তিনি বাংলাদেশে যান বিয়ে করতে। তারপর হঠাৎ করে বিমান চলাচল বন্ধ হয়ে গেলে তিনি বাংলাদেশে আটকা পড়েন। পরে মধ্য জুনে বিশেষ ফ্লাইটে মেলবোর্নে আসেন। ওখানে ১৪ দিন হোটেল কোয়ারেন্টিন শেষ করে সিডনি ফেরেন গত শুক্রবার। বাংলাদেশে তিনি সময় কাটিয়েছেন ঢাকায়। গত বছরের অক্টোবর মাসে তিনি অস্ট্রেলিয়ার নাগরিকত্ব গ্রহণ করেন।
কিছুদিন ধরে অস্ট্রেলিয়ায় আবার করোনাভাইরাসের সংক্রমণ বাড়ছে।
সংক্রমণ বাড়ছে
অস্ট্রেলিয়ায় করোনাভাইরাস সংক্রমণ কমে প্রায় শূন্যের কোঠায় চলে এসেছিল। পুরোপুরি নির্মূলের প্রত্যাশা ছিল দেশজুড়ে। কিন্তু তা আর হলো না। এক সপ্তাহ ধরে প্রতিদিন বেড়েই চলেছে সংক্রমণের হার।
প্রথম দফায় গত মার্চ থেকে অস্ট্রেলিয়ায় সংক্রমণ বাড়ছিল দ্রুত। তখন এমনও দিন ছিল, প্রতিদিন তিন/চার শত মানুষ সংক্রমিত হচ্ছিল। দেশটির সরকারের বিভিন্ন কঠোর বিধি-নিষেধের কারণে করোনাভাইরাস পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে চলে এসে প্রায় স্বাভাবিক হয়ে উঠেছিল অস্ট্রেলিয়ার জীবনযাত্রা। মে মাসের প্রথম দিকে গড়ে ছয়জন করে নতুন শনাক্ত হচ্ছিল পুরো অস্ট্রেলিয়ায়। দেশটির কোনো কোনো রাজ্যে দীর্ঘদিন ধরে করোনাভাইরাসে আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা ছিল শূন্য।
তাই অস্ট্রেলিয়ার অন্যতম শহর সিডনির রাজ্য নিউ সাউথ ওয়েলস ও মেলবোর্নের রাজ্য ভিক্টোরিয়াতে বিধিনিষেধ আরও সহজ করা হয়েছিল জুনের ১ তারিখ থেকে। কিন্তু গত কিছুদিন ধরে বিশেষ করে মেলবোর্নে সংক্রমণের হার ঊর্ধ্বমুখী। গত পরশু নতুন করে ৭৭ জনের সংক্রমণ শনাক্ত হয়েছে ওই রাজ্যে। এরই মধ্যে ভিক্টোরিয়াতে এই সংক্রমণ ঠেকাতে সীমিত আকারে দেশটির সামরিক বাহিনীর সদস্যদের মাঠে নামানো হয়েছে। আগামী বৃহস্পতিবার থেকে মেলবোর্নের বেশি মানুষ সংক্রমিত এলাকাগুলোকে আলাদা করে লকডাউন করা হয়েছে।
করোনাভাইরাস শনাক্তকরণে বিশ্বে প্রথম লালা পরীক্ষা প্রবর্তন করেছে অস্ট্রেলিয়া। নতুন এই সহজ পরীক্ষা ব্যাপক হারে চলছে ভিক্টোরিয়া রাজ্যে। রাস্তায় গাড়িতে গাড়িতে এই পরীক্ষা চলছে। এ ছাড়া ভিক্টোরিয়া রাজ্য ছাড়া দেশটির সব রাজ্যের জন্য কুইন্সল্যান্ড রাজ্য তাদের সীমান্ত খুলে দিচ্ছে আগামী ১০ জুলাই থেকে। অন্যদিকে, আবারও করোনার আতঙ্কে মেলবোর্ন শহরের লোকজনের মধ্যে সাময়িক টয়লেট পেপার কেনার হিড়িক পড়ে গিয়েছিল। যদিও দ্রুতই এই হিড়িক থেমে যায়।
সাইবার আক্রমণ
অস্ট্রেলিয়া সাইবার আক্রমণের শিকার হচ্ছে বলে জানিয়েছেন দেশটির প্রধানমন্ত্রী। তিনি বলেন, অস্ট্রেলিয়ার সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলো রাষ্ট্র-ভিত্তিক সংঘবদ্ধ সাইবার আক্রমণের শিকার হচ্ছে। এতে সব পর্যায়ের প্রতিষ্ঠান, রাজনৈতিক সংগঠন, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, জরুরি সেবাসহ বিভিন্ন খাতকে লক্ষ্যবস্তু করা হচ্ছে। এক সম্মেলনে প্রধানমন্ত্রী স্কট মরিসন এসব কথা বলেন। তবে এই হামলার পেছনে কারা এবং কেন কিংবা কী পরিমাণ ক্ষতি হয়েছে জানতে চাইলে স্কট মরিসন বিস্তারিত জানাননি। তিনি বলেন, সাইবার হামলার ধরন থেকে বোঝা যাচ্ছে, এই আক্রমণ নিশ্চিতভাবে কোনো দেশের রাষ্ট্রীয় মদদ পুষ্ট। তবে কোন রাষ্ট্র এ আক্রমণ চালিয়েছে, সে ব্যাপারে তিনি কিছু বলেননি।
অস্ট্রেলিয়ার প্রতিরক্ষামন্ত্রী লিন্ডা রেনল্ডস বলেন, এসব আক্রমণে বড় পরিসরে কোনো ক্ষতি হয়নি। প্রধানমন্ত্রী মরিসন স্পষ্ট করে হামলাকারী দেশটির নাম না বললেও দেশটির কিছু উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা গণমাধ্যমে এ আক্রমণের জন্য সরাসরি চীনকে দায়ী করেছেন। তবে এই অভিযোগ চীনের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র ঝাঁও লিজিয়ান অস্বীকার করেন। তিনি বলেন, চীন ‘সাইবার সুরক্ষার দৃঢ় সমর্থক’।
সম্প্রতি অস্ট্রেলিয়া চীনকে করোনাভাইরাস মহামারির উৎস সম্পর্কে নিরপেক্ষ ও স্বাধীন তদন্তের আহ্বান জানালে চীন অস্ট্রেলিয়ার বিরুদ্ধে ক্ষুব্ধ হয়ে ওঠে। এ জন্য চীন নিজেদের পররাষ্ট্রনীতিতে আক্রমণাত্মক হয়ে উঠেছে। চীন তাদের শিক্ষার্থী এবং পর্যটকদের অস্ট্রেলিয়া যাওয়ার ব্যাপারে সতর্কতা জারি করেছে। তা ছাড়া অস্ট্রেলিয়ান পণ্যের ওপর বাণিজ্য নিষেধাজ্ঞাসহ ক্রমাগত হুমকি দিচ্ছে। তার ওপর গত সপ্তাহে মাদক পাচারের দায়ে অস্ট্রেলিয়ার এক নাগরিককে মৃত্যুদণ্ড দিয়েছে চীন। ফলে অস্ট্রেলিয়ায় এই সাইবার আক্রমণের জন্য সন্দেহের তির বেইজিংয়ের দিকেই যাচ্ছে।
কাউসার খান: অভিবাসন আইনজীবী, সিডনি, অস্ট্রেলিয়া। ইমেইল: immiconsultants@gmail.com
|