bangla-sydney
bangla-sydney.com
News and views of Bangladeshi community in Australia













কাউসার খানের প্রতিবেদন
সাম্প্রতিক অস্ট্রেলিয়া (২২)



রুবি প্রিন্সেস। একটি প্রমোদ-তরির নাম। নিউজিল্যান্ড ঘুরে অস্ট্রেলিয়ায় এসেছিল যাত্রীদের একদণ্ড শান্তির খোঁজে। কিন্তু সে আর হলো কই? এসেই কাঠগড়ায় দাঁড়াতে হলো আসামি হয়ে। কয়েক দিনের মধ্যেই দুঃসহ যন্ত্রণার করোনাভাইরাস ছড়ানোর দুর্নামে পরিণত হলো এক খলনায়কে।

অস্ট্রেলিয়ার নিউ সাউথ ওয়েলস রাজ্যের করোনাভাইরাস সংক্রমণ বৃদ্ধির জন্য অনেকটাই দায়ী করা হয় বিলাসবহুল প্রমোদ-তরিটিকে। শুধু দায়ী করেই শেষ নয়, কী করে করোনাভাইরাস শনাক্তকরণ পরীক্ষা ছাড়া শত শত যাত্রী নামলেন নিউ সাউথ ওয়েলস রাজ্যের রাজধানী, অস্ট্রেলিয়ার প্রধান শহর সিডনির ডকে, সে তদন্ত করতে অস্ট্রেলিয়া সরকার জব্দ করেছে জাহাজটির ব্ল্যাকবক্স, জবানবন্দি নিয়েছে অনেক যাত্রীসহ ক্রুর। আর অন্যদিকে সংক্রমণ থেকে আক্রান্ত ব্যক্তিদের সারিয়ে তুলতে দেশটিকে এখন মূল্য দিতে হচ্ছে চড়া।

যে দেশে একজন মানুষ মরলে কেঁপে ওঠে শহর থেকে রাজ্য, সেখানে শুধু একটি জাহাজেই গুনে গুনে মরল ২১ জন। আর এ ভাইরাস ছড়িয়ে পড়ল দেশটির হাজার হাজার মানুষের মধ্যে। তো, তার নাম খলনায়কের তালিকায় ও আসামির খাতায় থাকবে, সেটাই স্বাভাবিক মনে করে এ দেশের বেশির ভাগ মানুষ। ফলে আরও অনেক দূর যাবে এর বিচার-আচার, সেটা নিশ্চিত।

কিন্তু গতকাল সাময়িক রেহাই দেওয়া হয়েছে জাহাজটিকে। অনেক টানাপড়েনের পর রুবি প্রিন্সেসকে অস্ট্রেলিয়া ছেড়ে যেতে চূড়ান্ত অনুমতি দিয়েছে সরকার এবং বিকেল ৫টা নাগাদ ছেড়েও গেছে দেশটির জলসীমা। তবে যে জাহাজকে নিয়ে এত কথা, যে খলনায়ককে তাড়াতে এত বিক্ষোভ, সে যখন অস্ট্রেলিয়া ছেড়ে যায়, তখন কিন্তু মন খারাপ হয়েছে অনেকেরই। এই করোনার দিনে জাহাজে থেকে যাওয়া মানুষের জন্য হৃদয় কেঁদে ওঠে। ‘রুবিও’ কম যায়নি। যন্ত্রণা ভুলে নির্দেশমতো সিডনির পোর্ট কেম্বলায় ছেড়ে যায় সময় মতোই। প্রমোদ-তরিটি উল্টো ঘুরে রওনা দিতেই রিনঝিনি করে ওঠে অস্ট্রেলিয়ানদের হৃদয়। জাহাজের পেছনে বড় বড় করে লেখা ‘ধন্যবাদ’ কথাটি স্পর্শ করে তাদের।

রুবি প্রিন্সেস ছিল মূলত আমেরিকার লস অ্যাঞ্জেলসের বিলাসবহুল প্রমোদ-তরি। ক্যালিফোর্নিয়ার উপকূল থেকে হাওয়াই দ্বীপে চলাচল করত। বেশির ভাগ বয়স্ক মানুষ এই প্রমোদ-তরিতে ঘুরতে যেতেন অবসরে। গত বছরের শেষ দিকে প্রমোদ-তরিটি যোগ দেয় অস্ট্রেলিয়ার রুটে। প্রথম থেকেই নিউজিল্যান্ড ও অস্ট্রেলিয়া—এ দুই দেশে কার্নিভ্যাল অস্ট্রেলিয়া নামে একটি ট্যুরে চলাচল করে মহাসমারোহে। ভালো যাচ্ছিল সবকিছু। সাধারণ অন্যান্য ক্রুজের মতোই জীবন ছিলও রুবি প্রিন্সেসের। কিন্তু করোনাভাইরাসের প্রবল ধাক্কায় সবকিছুর সঙ্গে কপাল পুড়ে এই প্রমোদ-তরিরও।

১৯ মার্চ, ২০২০। করোনাভাইরাসের মহামারিতে পৃথিবী থমথমে, সঙ্গে অস্ট্রেলিয়াও। চলাচলে বিধিনিষেধ শুরু হয়ে গেছে চারদিকে। বন্দরে বন্দরে নিষেধাজ্ঞা। বিমান থেকে জাহাজ—সবকিছু বন্ধ হচ্ছে দ্রুত। এই মুহূর্তে রুবি প্রিন্সেস ভিড়তে আসে সিডনিতে। পড়ে নিষেধাজ্ঞার বেড়াজালে। তারপর কোনোমতে অনুমতি পেয়েই সিডনিতে নামিয়ে দেয় ২ হাজার ৭০০ যাত্রীকে। যাঁদের মধ্যে শুরুতেই পাওয়া যায় ১৩৩ জন কোভিড-১৯–এ আক্রান্ত। এর কয়েক দিনের মাথায় মৃত্যুবরণ করেন কয়েকজন যাত্রী। শুরু হয়ে যায় তীব্র সমালোচনা।

খোঁজখবর নেওয়া হয় জোরেশোরে। কীভাবে কী হলো, এই নিয়ে শুরু হয়ে যায় দায়িত্বশীল কয়েক পক্ষের বাগযুদ্ধ। বের হয়ে আসে গত মাসের ৮ তারিখ রুবি প্রিন্সেস নিউজিল্যান্ডের উদ্দেশে অস্ট্রেলিয়ার সিডনি ছেড়ে যায় ১৩ রাতের ভ্রমণ প্যাকেজে। ভ্রমণটি ছিল নিউজিল্যান্ডের ফি–অর্ডল্যান্ড ন্যাশনাল পার্ক, পোর্ট চাল্মার্স, অ্যাকারোয়া, ওয়েলিংটন, নেপিয়ার, টৌরাঙ্গা, অকল্যান্ড ও পাইহিয়া ঘুরে আসার। কিন্তু ১৫ মার্চ প্রমোদ-তরিটি ভ্রমণ সংক্ষিপ্ত করে নেপিয়ার থেকে সরাসরি সিডনিতে ফিরে আসে। কর্তৃপক্ষের সন্দেহ হয়, কেন ফিরে আসে। তারা ধারণা করে, নিউজিল্যান্ডের নেপিয়ার শহরে তখন করোনা ভাইসের বিপর্যয় শুরু এবং জাহাজের মধ্যেও করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাব দেখা দেয়, তাই ওখান থেকেই ফিরে আসে জাহাজ। অভিযোগ ওঠে, সে তথ্য গোপন করে রুবি প্রিন্সেস বিনা পরীক্ষায় সিডনিতে নামিয়ে দেয় যাত্রীদের।

অন্যদিকে দেখতে দেখতে ৩০ মার্চ পর্যন্ত জাহাজের যাত্রীদের মধ্যে করোনাভাইরাসে আক্রান্তের সংখ্যা দাঁড়ায় কমপক্ষে ৪৪০ জনে এবং শঙ্কার বিষয়, সব যাত্রী ছড়িয়ে পড়েন পুরো অস্ট্রেলিয়ায়। সিডনির রাজ্য নিউ সাউথ ওয়েলসে ২১১ জন, আডিলেড শহরের রাজ্য দক্ষিণ অস্ট্রেলিয়ায় ৭১ জন, ব্রিজবেন শহরের রাজ্য কুইন্সল্যান্ডে ৭০ জন, পশ্চিম অস্ট্রেলিয়ার পার্থে ৪৩ জন, অস্ট্রেলিয়ার রাজধানী ক্যানবেরাতে ২২ জন, মেলবোর্ন শহরের রাজ্য ভিক্টোরিয়ায় ১৮ জন, তাসমানিয়ায় ৩ এবং উত্তর অঞ্চল রাজ্যে ২ জন আক্রান্ত এবং পরদিন তাঁদের ৫ জন মৃত্যুবরণ করেন। তারপর দিন দিন এখন পর্যন্ত আক্রান্তের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ৬৫০–এর ওপর এবং মারা যান ২১ জন।

এ নিয়ে তদন্ত চলছে কারা করোনায় আক্রান্ত এই যাত্রীদের সিডনিতে নামার অনুমতি দিল। স্বাস্থ্য বিভাগ থেকে সীমান্ত রক্ষাবাহিনী, এ রকম পাল্টা অভিযোগ চলে কয়েক দিন। তারপর নিউ সাউথ ওয়েলসের প্রিমিয়ার গ্ল্যাডিস বেরেজিক্লিয়ান বলেন, ‘দায়টি আমাদের সম্মিলিত।’ কেন কীভাবে এই বিধিনিষেধের মধ্যেও বিনা পরীক্ষায় আক্রান্ত যাত্রীদের নামিয়ে দিয়ে অস্ট্রেলিয়াকে এই বিপর্যয়ের মুখে ফেলে দেওয়া হলো, তা নিয়ে তদন্ত করছে অস্ট্রেলিয়া সরকার। এর মধ্যে প্রাথমিক তদন্তের পর প্রমোদ-তরিটিকে অস্ট্রেলিয়ার জলসীমা ত্যাগের নির্দেশ দেওয়া হয়েছিল গত রোববার। কিন্তু জাহাজটির ক্রুদের মধ্যে সংক্রমণের ঘটনা পাওয়া যাওয়ায় মানবিক বিবেচনায় এর যাত্রা স্থগিত করা হয়। অস্ট্রেলিয়া সরকার আগেই ঘোষণা দিয়েছিল, একজন ক্রুরও জীবনের ঝুঁকি থাকলে জাহাজটিকে এখান থেকে চলে যেতে বাধ্য করা হবে না। সবার করোনাভাইরাস পরীক্ষা সম্পন্ন করে অস্ট্রেলিয়া কর্তৃপক্ষ। প্রায় ১ হাজার ক্রু মধ্যে বিভিন্ন দেশের ৫৪২ জন। যারা সুস্থ, তাঁদের বিমানযোগে নিজ নিজ দেশে পাঠিয়ে দেওয়া হয়। এ ছাড়া সিডনিতে গতকালের ১১ জনসহ মোট ৩৩ জনকে রাখা হয়েছে আইসোলেশনে।

প্রমোদ-তরিটিকে সিডনি থেকে প্রায় ১০০ কিলোমিটার দূরের ইলাওয়ারার পোর্ট কেম্বলায় রাখা হয়েছিল তদন্তের জন্য। সেখানে যেন কেউ না নামেন সে নিয়ে বিক্ষোভও করেছিল স্থানীয় মানুষ। কিন্তু তারপর যারা অসুস্থ হয়েছিলেন, বিশেষ ব্যবস্থায় নামিয়ে হাসপাতালে নেওয়া হয়েছিল। তারপর অভিযোগ ওঠে, ফৌজদারি অপরাধের। নিউ সাউথ ওয়েলস পুলিশ জানিয়েছে, তদন্ত করতে লাগবে কয়েক মাস। তাই গতকাল বিভিন্ন প্রমাণ রেখে অন্য ক্রুদের সহ ‘খলনায়কের মোড়কে’ রুবি প্রিন্সেসকে বিদায় জানায় অস্ট্রেলিয়া।



কাউসার খান: অভিবাসন আইনজীবী, সিডনি, অস্ট্রেলিয়া। ইমেইল: immiconsultants@gmail.com





Share on Facebook               Home Page             Published on: 27-Apr-2020

Coming Events:





A day full of activities, games and fun.







Blacktown Lakemba Mascot