কাউসার খানের প্রতিবেদন সাম্প্রতিক অস্ট্রেলিয়া (১৬)
নতুন বছরে অস্ট্রেলিয়ায় পরিবর্তন-পরিবর্ধন
শুরু হয়ে গেল নতুন বছর ২০১৯এর পথচলা। নতুন বছরে অস্ট্রেলিয়ার জাতীয় জীবনে আনা হয়েছে বেশ কিছু নতুনত্ব ও পরিবর্তন। এর মধ্যে বেশ কয়েকটি আইন ও পরিবর্তন গতকাল ১ জানুয়ারি থেকেই চালু করা হয়েছে। দেশটির জনজীবনের বিভিন্ন ক্ষেত্রে নতুন ও পরিবর্তিত এসব বিষয়গুলো প্রভাব ফেলতে পারে।
বিদ্যুৎ ও গ্যাসের খরচ কমবে: নিউ সাউথ ওয়েলস (এনএসডব্লিউ), অস্ট্রেলিয়ান ক্যাপিটাল টেরিটোরি (এসিটি), কুইন্সল্যান্ড ও সাউথ অস্ট্রেলিয়া রাজ্যের বাসিন্দাদের জন্য সুখবর এনেছে শক্তি সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠানগুলো। ১ জানুয়ারি থেকে ব্যবহারকারীদের বিদ্যুৎ ও গ্যাস বিলের ওপর স্বয়ংক্রিয়ভাবে ১০ থেকে ১৫ শতাংশ ছাড় দেওয়া হবে। ভিক্টোরিয়া রাজ্যে ২৫০ থেকে ৭২০ ডলার পর্যন্ত ছাড় দেওয়া হবে। অন্য রাজ্যেও থাকছে বিশেষ ছাড়।
বাড়বে গণ-পরিবহনের ভাড়া: এসিটি, কুইন্সল্যান্ড ও ভিক্টোরিয়ার মেলবোর্নে গণ-পরিবহনের ভাড়া বাড়তে চলেছে। এসিটিতে জানুয়ারির পাঁচ তারিখ থেকে আড়াই শতাংশ ভাড়া বাড়বে। ৭ জানুয়ারি থেকে ব্রিসবেনে ১ দশমিক ৮ শতাংশ ও মেলবোর্নে ভাড়া বাড়বে ২ দশমিক ২ শতাংশ।
স্যানিটারি পণ্যে কর প্রত্যাহার: অস্ট্রেলিয়ায় নতুন বছরের নতুনত্বের সবচেয়ে আলোচিত পরিবর্তন, নারীদের ব্যবহৃত প্রায় সকল স্যানিটারি পণ্যের ওপর থেকে সরকারের কর উঠিয়ে নেওয়া। কেননা, এই পরিবর্তনের জন্য দীর্ঘ ১৮ বছর ধরে বিভিন্ন সংগঠন কাজ করে আসছিল। অবশেষে, স্যানিটারি পণ্যের ওপর ধার্য করা ১০ শতাংশ জিএসটি তুলে নিয়েছে সরকার। দেশটির সকল রাজ্য সরকার এর সঙ্গে একমত জানিয়েছে। দেশটিতে সবচেয়ে বেশি ব্যবহৃত স্যানিটারি পণ্য টেম্পন ও প্যাড ইত্যাদির কর বাতিল করা হয়েছে।
এনএসডব্লিউ রাজ্যে শিশুর জন্য উপহার: এনএসডব্লিউ রাজ্যে এ বছর থেকে প্রতি শিশুর জন্য ৩০০ ডলার মূল্যের শিশুতোষ সামগ্রী উপহার দেবে রাজ্য সরকার। গত জুন মাসে প্রায় ১৬ কোটি ডলারের এই উপহার সামগ্রী বিতরণের কথা জানায় রাজ্য সরকার। নতুন বছর থেকে জন্মানো সকল শিশুই পাবে এই উপহার।
সৃজনশীলতায় মিলবে ১০০ ডলার: এনএসডব্লিউ রাজ্যের শিশুদের বিদ্যালয়ের বাইরে সৃজনশীল সংস্কৃতি চর্চার জন্য ১০০ ডলার দেবে রাজ্য সরকার। রাজ্যের সংগীত, নাটক, শিল্প ইত্যাদি ক্লাসগুলোর ফিতে এই ছাড় পাবে শিশুরা।
টিকা নয় তো, স্কুলও নয়: ওয়েস্টার্ন অস্ট্রেলিয়া রাজ্যের স্বাস্থ্য বিভাগ শিশুদের সুস্বাস্থ্য নিশ্চিতে কঠোর পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে। ১ জানুয়ারি থেকে টিকা গ্রহণ করেনি এমন কোনো শিশুকেই বিদ্যালয়ে প্রবেশ করতে না দেওয়ার আইন চালু করেছে রাজ্য সরকার। প্রকল্পটির নাম দেওয়া হয়েছে, টিকা নয় তো, শিক্ষাও নয়। আইন অমান্যে বিদ্যালয় কর্তৃপক্ষকে হাজার ডলার জরিমানা করা হবে।
ন্যাশনাল ব্যাংকের গ্রাহকদের ২ ডলার এটিএম ফি
ন্যাশনাল অস্ট্রেলিয়া ব্যাংকের (ন্যাব) গ্রাহকেরা রেডিএটিএম থেকে যেকোনো পরিমাণ অর্থ উত্তোলনে ২ অস্ট্রেলীয় ডলার ফি প্রদান বাধ্যতামূলক করেছে ব্যাংকটি। ১ জানুয়ারি থেকে এ শর্ত চালু হয়েছে। ফি-ফ্রি এটিএম ব্যবহারের ক্ষেত্রে এ শর্ত প্রযোজ্য নয়।
অস্ট্রেলিয়ায় স্বল্প দক্ষ কর্মীদের স্থায়ী ভিসার সুযোগ
যেসব কাজে কম দক্ষতা প্রয়োজন, এমন কাজের পেশাদারদের জন্য নতুন বছরের শুরুতেই সুখবর আনছে অভিবাসন খ্যাত দেশ অস্ট্রেলিয়া। দেশটিতে তাদের জন্য স্থায়ী বসবাসের সুযোগ দিয়ে রাজ্যভিত্তিক নতুন ভিসা চালু করছে দেশটির অভিবাসন বিভাগ। শুধু তাই নয়, ইংরেজি ভাষায় দক্ষতা কম হলেও এ ভিসায় আবেদন করা যাবে। দেশটির ফেডারেল সরকার ইতিমধ্যেই নর্দান টেরিটরি ও ভিক্টোরিয়া রাজ্য সরকারের সঙ্গে ভিসা সংক্রান্ত চুক্তি সাক্ষর করেছে। অন্য রাজ্যের সঙ্গেও এই চুক্তি হতে পারে। Designated Area Migration Agreements (DAMA) নামের প্রকল্পের আওতায় নতুন ভিসাটি অনেকটা দেশটির সাবক্লাস ৪৮২ কর্মভিসার মতোই। এই ভিসার চাহিদার পেশা তালিকায় ১১৭টি পেশা রয়েছে। পেশাগুলো প্রধানত কৃষি ও আতিথেয়তা শিল্পকে কেন্দ্র করে। পেশাগুলোর জন্য উচ্চকর্ম ও ইংরেজি ভাষা দক্ষতার প্রয়োজন নেই। ভিসার আবশ্যিক শর্তগুলোর মধ্যে রয়েছে, যে রাজ্যের জন্য ভিসা মঞ্জুর হবে, ভিসার ধরনের ওপর নির্ভর করে সেই রাজ্যে দুই ও চার বছর পর্যন্ত বসবাস ও কাজ করতে হবে। রাজ্যের অর্থনৈতিক উন্নয়ন ও শ্রমের ঘাটতি পূরণে সহজ শর্তের এই ভিসা চালু করছে সরকার। যদিও ভিসাটির আবশ্যিক শর্ত ও আবেদন প্রক্রিয়া এখনো প্রকাশ করেনি অভিবাসন বিভাগ। চলতি বছরের মাঝামাঝির মধ্যেই নতুন ভিসাটির আবেদন প্রক্রিয়া চালুর কথা জানিয়েছেন দেশটির অভিবাসন মন্ত্রী ডেভিড কোলম্যান।সরকার দেশের নির্দিষ্ট অঞ্চলের প্রয়োজন পূরণ করতে অভিবাসন কার্যক্রমকে আরও উন্নতও করার চেষ্টা করছে, বলেন কোলম্যান। দেশটির প্রধান শহরে জনসংখ্যার চাপ কমাতে নতুন অভিবাসীদের বিভিন্ন অঞ্চলে ভাগ করে দেওয়ার পাশাপাশি বিভিন্ন রাজ্যের শ্রম বাজারের ঘাটতি পূরণেই সরকার নতুন প্রকল্প চালু করেছে বলে জানান তিনি। ডিএএমএ প্রকল্পটির যেকোনো তথ্য রাজ্যভিত্তিক অভিবাসন বিভাগের ওয়েবসাইটে হালনাগাদ করবে সরকার।
অস্ট্রেলিয়ার গণমাধ্যমে বাংলাদেশের নির্বাচন
বিশ্বের অন্য দেশের মতো অস্ট্রেলিয়ার শীর্ষস্থানীয় প্রায় সব সংবাদমাধ্যমে বাংলাদেশের একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের খবর প্রকাশিত হয়েছে। প্রভাবশালী সংবাদমাধ্যম সিডনি মর্নিং হেরাল্ড এবং অস্ট্রেলিয়ান ব্রডকাস্টিং করপোরেশনসহ (এবিসি) দেশটির প্রায় সব সংবাদমাধ্যম ফলাও করে নির্বাচনের খবর প্রচার করেছে। ক্ষমতাসীন শেখ হাসিনা বাংলাদেশের নির্বাচনে বড় জয় পেয়েছেন শিরোনামে গতকাল সোমবার একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করে সিডনি মর্নিং হেরাল্ড। নির্বাচনের পুরো চিত্র তুলে ধরা হয় প্রতিবেদনে। এ ছাড়া এসবিএস নিউজ, দ্য অস্ট্রেলিয়ান, নিউজ ডটকম ডট এইউ এবং নাইন নিউজ, স্কাই নিউজ টেলিভিশন চ্যানেলসহ অন্য সব সংবাদমাধ্যমে নির্বাচনের সংবাদ প্রকাশিত হয়। সংবাদগুলোর শিরোনাম ও বিষয়ে নির্বাচনী সহিংসতার খবরও প্রাধান্য পেয়েছে। নির্বাচনে সরকারি দলের প্রভাব বিস্তারের কথাও বলা হয়েছে কয়েকটিতে।
সিডনি মর্নিং হেরাল্ড বাংলাদেশের নির্বাচন নিয়ে তিনটি প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। নির্বাচনের দিন প্রকাশিত প্রতিবেদনটির শিরোনাম ছিল সহিংসতা অব্যাহত, বাংলাদেশিদের নির্বাচন চলছে। প্রতিবেদনটিতে বলা হয়, সহিংসতার পর নির্বাচনে অংশ নিচ্ছেন বাংলাদেশিরা, যেখানে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তৃতীয় মেয়াদের জন্য লড়বেন আর সংসদের বাইরের বিরোধী দলের নেত্রী কারাগারে আছেন। মোবাইল ইন্টারনেট বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে আর রাজধানী শহরের রাস্তা খালি হয়ে গেছে। কেননা শহরের বাসিন্দারা নিজ নিজ এলাকায় ভোট দিতে গেছেন। এবারের নির্বাচনে লাখো নতুন ভোটার যুক্ত হয়েছেন। এর আগে ২০১৪ সালে সুষ্ঠু ও স্বাধীন নির্বাচন হবে না দাবি করে প্রধান বিরোধী দল বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি) নির্বাচন প্রত্যাহার করে। এবারের নির্বাচনে দলটির নেত্রী সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়া দুর্নীতির অভিযোগে ফেব্রুয়ারি থেকে কারাগারে আছেন। এবিসি নিউজ মারাত্মক সংঘর্ষ, ভোট কারচুপি আর নানা অভিযোগে বাংলাদেশে নির্বাচন অনুষ্ঠিত শিরোনামে প্রতিবেদন প্রকাশ করে। খবরের শুরুতেই নির্বাচনকে কেন্দ্র করে ১৭ জনের প্রাণহানির কথা বলা হয়। তৃতীয় বারের মতো শেখ হাসিনা প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হচ্ছেন। নির্বাচনের সার্বিক পরিস্থিতির পাশাপাশি প্রতিবেদনটিতে উল্লেখ করা হয় নির্বাচনে বিরোধী দলের নড়বড়ে অবস্থানের কথাও। এসবিএস নিউজ, দ্য অস্ট্রেলিয়ান, নিউজ ডটকম ডট এইউ পত্রিকা এবং নাইন নিউজ, স্কাই নিউজ টেলিভিশনসহ অন্য সব গণমাধ্যমের সংবাদে নির্বাচনই সহিংসতার কথা উল্লেখ ছিল।
এবার অস্ট্রেলিয়ার ট্রেনের সিটে সুই
অস্ট্রেলিয়ার যাত্রীবাহী ট্রেনের আসনে সুই গেঁথে রাখার ঘটনা ঘটেছে। দেশটির ভিক্টোরিয়া রাজ্যের রাজধানী মেলবোর্নে গত মঙ্গলবার এ ঘটনা ঘটে। মেলবোর্নের ওয়াটারগার্ডেন লাইনের একটি ট্রেনে এক আরোহী আসন গ্রহণের পর আসনে সুই খুঁজে পান। দুএকটি নয়, প্রায় ২০টি সুই ছিল। এ ঘটনায় মারাত্মক কোনো দুর্ঘটনার খবর পাওয়া যায়নি। তবে ঘটনার তদন্তে নামা রাজ্য পুলিশ ধারণা করছে, এ ঘটনার প্রায় ৯০ মিনিট আগে আরও একজন যাত্রী এই সুই দ্বারা আহত হয়েছেন। প্রাথমিক তদন্তে ১৬ বছর বয়সী এক কিশোরকে সুই গেঁথে রাখার অভিযোগে আটক করেছে পুলিশ। শিগগিরই তাঁকে শিশু আদালতে হাজির করা হবে। পুলিশ সবাইকে আসন গ্রহণের আগে সেটি নিরীক্ষণ করে নেওয়ার জন্য সতর্ক করেছে। গত বছরের সেপ্টেম্বরে দেশটিতে স্ট্রবেরি ফলে সুই পাওয়ার ঘটনা ঘটে। গোটা দেশ থেকেই স্ট্রবেরিতে সুই পাওয়ার অনেক অভিযোগ আসে। সুই আতঙ্কে দেশটির স্ট্রবেরির বাজার প্রায় বন্ধের উপক্রম হয়। উদ্দেশ্যপ্রণোদিত ভাবে স্ট্রবেরিতে সুই ঢুকিয়ে দেওয়ার অভিযোগে ৫০ বছর বয়সী এক নারীকে আটক করে পুলিশ।
কাউসার খান: অভিবাসন আইনজীবী, সিডনি, অস্ট্রেলিয়া। ইমেইল: immiconsultants@gmail.com
|