অবশেষে ক্রিকেট অস্ট্রেলিয়ার সংকটের অবসান বাংলাদেশে যাচ্ছে অস্ট্রেলিয়া
কাউসার খানঃ আজ রৌদ্রজ্জ্বল সকালেই অস্ট্রেলিয়ার ক্রিকেটের দীর্ঘ ও ভ্রান্তিকর বিতর্ক অবশেষে শেষ হয়ে গেছে ‘শান্তি চুক্তি’র মাধ্যমে। মধ্যস্থতায় এসেছেন ক্রিকেট অস্ট্রেলিয়া ও খেলোয়াড়রা। অস্ট্রেলিয়ান ক্রিকেটার্স অ্যাসোসিয়েশন (ACA) ও ক্রিকেট অস্ট্রেলিয়ার (CA) মধ্যকার বনিবনা নিয়ে মনমালিন্যের জেরে গত পহেলা জুলাই থেকেই বেকার হয়ে পড়েছিলেন অস্ট্রেলিয়ার ২৩০ জনেরও বেশি ক্রিকেটার। সেই সাথে কয়েকটি আন্তর্জাতিক ম্যাচ বাতিলসহ দেশটির ক্রিকেট দলের বাংলাদেশ সফরও সংশয়ে পরে। তবে দ্বন্দ্ব মিটিয়ে অস্ট্রেলিয়ার ক্রিকেট আবারও আলোর পথে যাত্রা শুরু করেছে। সেই সাথে অস্ট্রেলিয়ার ক্রিকেট দলের বাংলাদেশ সফরও আশার আলো দেখছে।
বিগত কয়েক মাস ধরেই আর্থিক দাবি নিয়ে ‘যুদ্ধ’ চলছিল অস্ট্রেলিয়ার ক্রিকেট অঙ্গনে। ক্রিকেট অস্ট্রেলিয়ার প্রধান নির্বাহী জেমস সাদারল্যান্ড গত সপ্তাহে দাবি মেনে না নিলে মামলা করার হুমকি দেওয়ার পর ৪০ বছরের ইতিহাসের প্রথম ‘ক্রিকেট শিল্প সংকট’ এর অবসান ঘটে। তবে কয়েকদিন আগেই CA ও ACA এর মৌখিক আলোচনার পর সুখবর আসবে বলে জানায় ACA। সপ্তাহ শেষের আগেই আজ বৃহস্পতিবার মুখোমুখি আলোচনার চূড়ান্ত ধাপে দু’পক্ষের মত এক চুক্তিতে এসে ঠেকেছে।
বেতন-ভাতার কাঠামো পরিবর্তনের দাবি-দাওয়া মনমালিন্য শুরু হয় CA ও ACA এর মধ্যে। পুরনো নীতিমালা অনুযায়ী বোর্ডের রাজস্ব আয়ের একটা অংশ ভাগ করে দেওয়া হতো অস্ট্রেলিয়ার কেন্দ্রীয় চুক্তিতে থাকা ক্রিকেটারদের ও প্রথম শ্রেণির ক্রিকেটারদের। এবার সেটিতে খানিকটা বদল আনতে চেয়েছিল ক্রিকেট অস্ট্রেলিয়া। জাতীয় ক্রিকেটারদের লভ্যাংশ বাড়িয়ে ঘরোয়া ক্রিকেটারদের এর বাইরে রাখার প্রস্তাব করা হয়েছিল। সে অর্থ বোর্ড খরচ করতে চেয়েছিল দেশের ক্রিকেটাঙ্গনের অন্যান্য খাতে। কিন্তু ঘরোয়া ক্রিকেটারদের স্বার্থ রক্ষায় এর বিরোধিতা করে এগিয়ে আসেন জাতীয় দলের ক্রিকেটাররা। দুই পক্ষের অনড় মনোভাবের ফলে বেকার দিন যাপন শুরু হয় ওয়ার্নার-স্মিথ সহ দেশটির ২৩০ জন শীর্ষ ক্রিকেটারের। ‘বৈঠক পে বৈঠক’ দিয়েও কোনো সমাধানে আসতে পারেন নি CA ও ACA। তবে অবশেষে সমাধানে এসেছে দুই পক্ষ। সেই সুবাদে স্বস্তি এসেছে বাংলাদেশ ক্রিকেটাঙ্গনেও। দুই টেস্টের সিরিজ খেলতে আগামী ১৮ আগস্ট স্টিভেন স্মিথের দল আসবে বাংলাদেশ সফরে। এছাড়া আসন্ন গ্রীষ্মকালীন অ্যাশেজ সিরিজটিও এগিয়ে যাবে বলে আশা করা হচ্ছে। তাছাড়া আগামী অক্টোবরে ভারত সফরের কথাও রয়েছে দলটির।
যেভাবে অবসান ঘটল অস্ট্রেলিয়ার ক্রিকেট বিতর্কেরঃ
ইতি ঘটল চলমান ক্রিকেট অস্ট্রেলিয়া ও অস্ট্রেলিয়ান ক্রিকেটার্স অ্যাসোসিয়েশনের বেতন-ভাতা সংক্রান্ত বিতর্কের। বৃহস্পতিবার সকালে দুই পক্ষ একটি সমঝোতায় পৌঁছেছে। এর গত সপ্তাহে শেষবারের মতো ACA এর মুখোমুখি হবে বলে ক্রিকেট অস্ট্রেলিয়ার প্রধান নির্বাহী জেমস সাদারল্যান্ড বলেন, সমাধানে না এলে এরপর ACA এর সাথে আদালতে দেখা হবে। গত মঙ্গলবার বৈঠকে বসে দুই পক্ষ। আলোচনায় মূল বিষয়গুলোর বেশিরভাগেরই সমাধান হলেও কোনো সিদ্ধান্তে আসা নিয়ে কোনো ঘোষণা দেয়নি কেউই। তবে ২৪-৪৮ ঘণ্টার মধ্যেই সমাধান আসতে পারে বলে জানিয়েছিলেন অস্ট্রেলিয়ার জাতীয় ক্রিকেট দলের সহ-অধিনায়ক ডেভিড ওয়ার্নার। হলোও ঠিক তাই, মুখোমুখি আলোচনার চূড়ান্ত ধাপে বৃহস্পতিবার সকালে দুপক্ষের মৌলিক দিকগুলোয় একমত হয়ে দুই পক্ষই চুক্তিতে সই করেছে। সকালে অস্ট্রেলিয়ান ক্রিকেটার্স অ্যাসোসিয়েশনের প্রধান নির্বাহী অ্যালিস্টার নিকোলসনের সঙ্গে মিলে ক্রিকেট অস্ট্রেলিয়ার প্রধান নির্বাহী জেমস সাদারল্যান্ড দুই পক্ষের সমঝোতার বিষয়টি ঘোষণা দেবেন বলে জানানো হয়। এরপর স্থানীয় সময় সাড়ে চারটায় মেলবোর্ন ক্রিকেট গ্রাউন্ড (MCC) এ এক সংবাদ সম্মেলনে আনুষ্ঠানিকভাবে এ ঘোষণা দেয়া হয় সমঝোতার। নতুন চুক্তিতে বেশ নতুনত্ব থাকলেও আগের বেতন কাঠামোই অপরিবর্তিত রয়েছে।
জিতে গিয়েও পরাজয়ঃ
বৃহস্পতিবার মুখোমুখি আলোচনার চূড়ান্ত ধাপে দুপক্ষের মত এক চুক্তিতে এসে ঠেকেছে। তবে এই চুক্তিতে দুই পক্ষের জয় হলেও পরাজয় হয়েছে অস্ট্রেলিয়ার ক্রিকেটের বলে ভাবছেন অনেকেই।
অস্ট্রেলিয়ার ক্রিকেটে আজ সকাল থেকে চূড়ান্ত সুবাস বাতাস বইতে শুরু করলেও এর প্রভাব নিয়ে দ্য সিডনি মর্নিং হেরাল্ডের ক্রীড়া সম্পাদক গ্রেগ বাম তাঁর পত্রিকায় এক প্রতিবেদন লেখেন। প্রতিবেদনে ক্রিকেটের কতটুকু ক্ষতি হল বিশ্লেষণ করে বলেন, প্রথম থেকেই এই সমস্যার মূলে ছিল শুধু রাজস্বের অংশ ভাগাভাগি করার বিষয়টি। সমস্যার সমাধানে দুই পক্ষই ভাবছে তারা জিতেছে। ACA আগের বেতন কাঠামোই অপরিবর্তিত থাকায় খুশি আর CA খুশি নতুনত্ব থাকছে বলে। কিন্তু সত্য এটাই যে দুই পক্ষই ‘পরাজয়ী’, বলে উল্লেখ করেন বাম। তিনি বলেন, দুই পক্ষই বলে তারা একে অপরকে সম্মান করে, সেই সাথে দুই পক্ষকেই পরস্পরকে অবমাননা করতে দেখা যায়।
বাম আরও বলেন, বনিবনার মাঝখানে পিষেছে শুধু অস্ট্রেলিয়ার ক্রিকেট শিল্প। নিজেদের অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্বের জের ধরে পহেলা জুলাই থেকে বেকার ছিলেন দেশটির ২৩০ জন শীর্ষ ক্রিকেটার। বাতিল করা হয়েছিল সাউথ আফ্রিকা সফরসহ বেশ কয়েকটি আন্তর্জাতিক ম্যাচ। এছাড়া বিশ্বের ক্রিকেট অঙ্গনে নেতিবাচক প্রভাবও ফেলেছে অস্ট্রেলিয়ার এই ক্রিকেট সংকট। ক্রিকেট ইতিহাস বোর্ডের সাথে খেলোয়াড়দের দ্বন্দ্বের এমন ঘটনা নতুন নয়। অতীতে জিম্বাবুইয়ান ও ওয়েস্ট ইন্ডিয়ান ক্রিকেট বোর্ডের সংগে জাতীয় দলের খেলোয়াড়দের বিভিন্ন ইস্যুতে মনমালিন্যের ঘটনা ঘটেছে। ফলশ্রুতিতে দেশগুলোর অভ্যন্তরীণ ক্রিকেট অঙ্গনে বৈরি প্রভাব বিস্তার হয়েছিল। যার ফলে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটেও তাদের মান নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে বিভিন্ন সময়ে। অস্ট্রেলিয়ার ক্রিকেটে সাম্প্রতিক সময়ের এমন সংকট, ভবিষ্যতেও তাদের অভ্যন্তরীণ ও আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে কী কোনো প্রভাব ফেলবে না? এমনটা প্রশ্ন থেকেই যাচ্ছে। তবে এই সংকট সম্পূর্ণ নিরসনের মাধ্যমে অস্ট্রেলিয়ার ক্রিকেট আলোর পথেই এগিয়ে যাবে বলে আশাবাদী অস্ট্রেলিয়া ও বিশ্বব্যাপী ক্রিকেট অনুরাগীরা।
কাউসার খান, সিডনি থেকে
|