কাউসার খানের প্রতিবেদন কে হচ্ছেন প্রধানমন্ত্রী
শেষ সময়ের অপেক্ষায় দিন গুনছে অস্ট্রেলিয়ার জাতীয় অঙ্গন। ১৮ মে অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে দেশটির ৪৬তম জাতীয় পার্লামেন্ট নির্বাচন। নানা রাজনৈতিক নাটকীয়তার অবসান ঘটবে দিনটিতে। জনগণের ভোটে গঠিত হবে তিন বছর মেয়াদের নতুন সরকার। অস্ট্রেলিয়া পাবে দেশটির ৩১তম প্রধানমন্ত্রী।
অস্ট্রেলিয়ার প্রধান দুই রাজনৈতিক দলের মধ্যে লড়াই এখন তুঙ্গে। লিবারেল ও ন্যাশনাল পার্টির জোট সরকার গত দুই মেয়াদে ক্ষমতায় আছে। অন্যদিকে নির্বাচন–পূর্ববর্তী জরিপে সমর্থকের দিক থেকে এগিয়ে রয়েছে প্রধান বিরোধী দল লেবার পার্টি। দলীয় কোন্দলের জের ধরে লিবারেলের নেতা স্কট মরিসন দেশটির বর্তমান প্রধানমন্ত্রী। অন্যদিকে দীর্ঘদিন ধরে কোন্দল ছাড়াই লেবারের প্রধান বিল শর্টেন।
১৯৮৩ থেকে ১৯৯৬ সালের টানা পাঁচবারের লেবার শাসনের উদাহরণ ছাড়া অস্ট্রেলিয়ার রাজনৈতিক ইতিহাস বলছে, এক দল টানা তৃতীয় মেয়াদে নির্বাচন জেতেনি। যদিও কোয়ালিশন সরকার প্রধান হিসেবে একজন অনেকদিন প্রধানমন্ত্রী পদে থেকেছেন। এদিক থেকে নতুন সরকার গঠনে লেবার পার্টির সম্ভাবনা প্রবল। অন্যদিকে, গত কয়েক মাসের বিভিন্ন রাজনৈতিক ঘটনা, ইতিহাস পাল্টে দেওয়ার পক্ষে। হঠাৎই আগের তুলনায় জনপ্রিয়তা বেড়েছে লিবারেল পার্টির। দুই দলের নির্বাচনী ইশতেহারের দিকে আলোকপাত করলে বিষয়টি বোঝা যায়। সরকার দল লিবারেল পার্টির কর নীতি জনগণকে দারুণভাবে প্রভাবিত করেছে। সাধারণ মানুষের কাছে কর লাঘবের লিবারেল পরিকল্পনা উত্তম বলে মনে হচ্ছে।
অন্যদিকে লেবার পার্টির প্রতি জনগণের সমর্থন বেশি। ১০ থেকে ১২ মে পর্যন্ত মতামত জরিপে ৫২ শতাংশ ভোট পেয়ে এগিয়ে যায় লেবার পার্টি। আবার অন্য প্রভাবশালী নির্বাচনী পোলে এগিয়ে আছে জোট সরকারের দল লিবারেল পার্টি। ৩৮ দশমিক ৫ শতাংশ মতামত আসে লিবারেলের পক্ষে। লেবারের পক্ষে আসে ৩৫ দশমিক ৫ শতাংশ মতামত। আগের চিত্র যা-ই থাক, বর্তমানে দুই দলের শক্ত-পোক্ত, সমানে সমান অবস্থান কঠিন করে তুলেছে নির্বাচন ফলাফলের আভাস। কে হতে চলেছেন অস্ট্রেলিয়ার আগামী প্রধানমন্ত্রী, এমন প্রশ্নের জবাব অনুমান করা এখন অনেকটা-ই কঠিন।
অস্ট্রেলিয়ার জাতীয় নির্বাচনের আগে জনগণের কর প্রদানের নীতিমালা একটি বড় বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। কে কত কর সুবিধা দেবে তার ওপর ভিত্তি করে বদলে যেতে পারে কোন দল সরকার গঠন করবে। প্রধান রাজনৈতিক দলগুলো “ফ্র্যাঙ্কিং ক্রেডিট, নেগেটিভ গিয়ারিং ও কর লাঘব” বিষয়গুলো নিয়ে বিবাদে জড়িয়ে পড়েছে। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি শোনা যাচ্ছে অবসর গ্রহণকারীদের ট্যাক্স প্রসঙ্গে। অবসরপ্রাপ্ত অনেক অস্ট্রেলিয়ার নাগরিক বিভিন্ন ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের শেয়ার হোল্ডার হিসেবে ডিভিডেন্ড পান। মুনাফার ওপরে ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের প্রদানকৃত ৩০% কর তাদের নিজস্ব আয়করে ক্রেডিট হিসেবে পান শেয়ার হোল্ডাররা, যাকে বলে ফ্র্যাঙ্কিং ক্রেডিট। বিরোধী দল লেবার পার্টি এই নীতি বাতিল করতে চায়। আর সরকার দল সম্পূর্ণ লেবারের বিরুদ্ধে।
এরপর আসে নেগেটিভ গিয়ারিং। এটি মূলত যাঁরা বসতবাড়ি ছাড়া ২য় বাড়ি বা এপার্টমেন্টে বিনিয়োগ তাঁদের জন্য। এই বিনিয়োগে যদি লোকসান হয়, তবে তা বিনিয়োগকারী আয় থেকে বাদ দিয়ে আয়কর প্রদান করা যায়। যেমন কেউ যদি বেতন থেকে পায় ৫০ হাজার টাকা, ভাড়া দেয়া বাড়িতে লোকসান হয় ৫ হাজার টাকা, তবে তাকে কর দিতে হবে ৪৫ হাজার টাকার ওপরে। লেবার পার্টি এই নেগেটিভ গিয়ারিং কর পদ্ধতি তুলে দিতে চায় বলে একটি প্রচার রয়েছে। আর লেবারের প্রচারিত এই নীতিমালার বিপক্ষ নিয়েছে লিবারেল পার্টি । পরবর্তী কর হ্রাসের বিষয়েও লেবারের পরিকল্পনায় নাখোশ বেশির ভাগ অস্ট্রেলিয়ান। ২৫ হাজার অস্ট্রেলীয় ডলারের আয়ের জন্য লিবারেল কর পরিকল্পনা ২৫৫ ডলার। অন্যদিকে, একই আয়ের জন্য লেবার সরকারকে কর দিতে হবে ৩৫০ ডলার। ৮০ হাজার ডলার থেকে ওপরের সকল আয়ের জন্য লিবারেল ও লেবারের পরিকল্পনা একই। তবে লিবারেল দাবি করছে আগামী ৪ বছরের মধ্যে এই পরিকল্পনা পরিবর্তন করা হবে, যেখানে এই নীতিতে অটল থাকার কথা জানিয়েছে। বিভিন্ন জরিপে দেখা গেছে, সব মিলিয়ে জনগণের মনে সাম্প্রতিক দিনে লিবারেলের প্রতি সমর্থন বাড়ছে। লেবার ক্ষমতায় এলে বেশি কর প্রদান করতে হতে পারে—এমন শঙ্কা অনেকের ভাবনায়। তবে শঙ্কাটি অমূলক কিনা সেটি লেবার পার্টি গাণিতিক কিংবা যৌক্তিক কোনোভাবে পরিষ্কার করতে পারেনি।
১৯০১ সাল থেকে গঠিত অস্ট্রেলিয়ার জাতীয় সংসদের ইতিহাসে ১৯৮৩ সাল পর্যন্ত কোয়ালিশন ছাড়া কোনো দল টানা দু’বারের বেশি নির্বাচনে জয়লাভ করেনি। ব্যতিক্রম ১৯৮৩ সাল থেকে ১৯৯৬ সাল। এই ১৩ বছর টানা ক্ষমতায় ছিল লেবার পার্টি। এর মধ্যে প্রথম চার বার প্রধানমন্ত্রী ছিলেন অতি জনপ্রিয় বব হক। তিনিই অস্ট্রেলিয়ার সবচেয়ে বেশি মেয়াদে থাকা লেবার পার্টির প্রধানমন্ত্রী। এরপর ১৯৯১ সালে পল কিটিং এর নেতৃত্বে লেবার পার্টি ক্ষমতায় থাকে ১৯৯৬ সাল পর্যন্ত। জনপ্রিয়তার দিক থেকে বর্তমান লেবার প্রধান বিল শর্টেন এগিয়ে আছেন বর্তমান প্রধানমন্ত্রী ও লিবারেল প্রধান স্কট মরিসনের চেয়ে।
একটি দেশের সামগ্রিক অর্থনীতির দিকে নজর দিলে দেখা যায়, লিবারেল কর নীতি সাময়িক সুবিধা প্রদান করলেও দীর্ঘ মেয়াদে দেশের অর্থনীতিকে ক্ষতিগ্রস্ত করতে পারে বলে অনেক বিশেষজ্ঞ মত দিয়েছেন। লিবারেলের কর নীতিতে আগামী ১০ বছরে সরকারের খরচা হবে প্রায় ১৫৮ বিলিয়ন ডলার। অন্যদিকে, লেবারের কর নীতি সরকারের একই সময়ে ১৫৪ বিলিয়ন ডলার বাঁচিয়ে দেবে। এ ছাড়া লেবারের নির্বাচনী ইশতেহারে চিকিৎসা, শিক্ষা, বিদ্যুৎ, বসতবাড়ি, শিল্পকারখানা, শিশু বিকাশ, সাংবিধানিক নতুনত্বসহ বেশির ভাগ ক্ষেত্রে নানা উন্নয়নের দিকে জোড় দেওয়া হয়েছে।
অস্ট্রেলিয়ার রাজনৈতিক দলগুলোর নির্বাচনী ইশতেহার গুরুত্ব সহকারে গ্রহণ করে জনগণ। কেননা, নির্বাচনের আগে করা প্রতিজ্ঞা পালনে ব্যর্থ সরকারকে পরবর্তী নির্বাচনে কখনোই ভোট দিতে চায় না জনগণ। ফলে, দেশটির রাজনৈতিক দলগুলো নির্বাচনী ইশতেহার প্রকাশের আগে খুবই সতর্ক এবং সচেষ্ট থাকে। এ ছাড়া অভিবাসন খ্যাত দেশ অস্ট্রেলিয়ায় লেবার দলের একটা সুনাম রয়েছে অভিবাসন-বান্ধব হিসেবে। বলা হয়, লেবারের আমলে অভিবাসীদের জন্য সুযোগ-সুবিধা বৃদ্ধি পায়। আর লিবারেল সরকারের সময়ে যেখানে দেশটিতে অভিবাসনের সবচেয়ে জনপ্রিয় কর্ম ভিসা ৪৫৭ বাতিল করে নতুন ভিসা চালু করা হয় এবং নাগরিকত্ব গ্রহণের শর্ত হিসেবে লিবারেল পার্টি বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ের ইংরেজি দক্ষতা থাকার বাধ্যবাধকতা চালু করার চেষ্টা করেছিল।
সবদিক মিলিয়ে অস্ট্রেলিয়ার জাতীয় অঙ্গনে অনেক দলের মাঝে প্রধান দুই দলের কোন দল জয়ী হবে, তা নিয়ে পরিষ্কার কোনো ধারণায় দেওয়া যাচ্ছে না নির্বাচনের মাত্র দু’দিন আগেও। দুই দলের কট্টর সমর্থক ছাড়া অন্যান্য নাগরিকের মধ্যেও রয়েছে “কোন দলে ভোট দেব” সংশয়। তবে রাজনৈতিক বিশ্লেষকেরা বলছেন, নির্বাচনের আগে বাকি এই দুদিনের মধ্যেই প্রায় বেশির ভাগ ভোটাররাই সিদ্ধান্ত নিয়ে নেবেন। যদিও জয়লাভে লেবার পার্টির সম্ভাবনা অনেকাংশে বেশি তবুও নির্বাচনের আগ পর্যন্ত এই দু’দিনে ফলাফলের মোড় ঘুরে যেতে পারে বিভিন্ন নাটকীয়তায়। তাই আপাতত কোন দল আসবে ক্ষমতায়, নতুন প্রধানমন্ত্রী কে হবেন, তা জানতে অপেক্ষা করতে হবে ১৮ মে পর্যন্ত।
কাউসার খান: অভিবাসন আইনজীবী, সিডনি, অস্ট্রেলিয়া। ইমেইল: immiconsultants@gmail.com
|