অ্যালেন খানঃ ওয়েডিং ফটোগ্রাফি'র যাদুকর কাউসার খান
শুধুমাত্র তাঁর হাতে ছবি তোলার জন্য কেউ কেউ বিয়ে পিছিয়ে দেন বছর দু’য়েক কিংবা আরো বেশি। তাঁর যাদুমাখা হাতের ছবি ছাড়া যেন বিয়েই হবে না এমনটি পোষণ করেন অস্ট্রেলিয়ার সিডনির উচ্চবিত্ত তরুণ-তরুণীরা। শুধু সিডনি কেন, মেলবোর্ন-ব্রিজবেন-পার্থ থেকে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে এখন তাঁর নামডাক। ‘ওই তো সেদিন লেবাননের বৈরুতে এক রাজকীয় বিয়ের ফটোগ্রাফি করে আসলাম আবার যাচ্ছি নিউ ইয়র্কে’ এই হচ্ছে তাঁর কাজের ব্যস্ততা। কাজের মাঝেই পৃথিবী চষে বেড়ান বাংলাদেশে জন্ম নেয়া অস্ট্রেলিয়ান এই প্রথিতযশা ওয়েডিং ফটোগ্রাফার অ্যালেন খান।
অ্যালেন খানের তোলা বিয়ের ছবি
তিনি অস্ট্রেলিয়ার সিডনিতে অবস্থিত ওয়েডিং ফটোগ্রাফির বিখ্যাত ‘অ্যালেন খান ওয়েডিং ফটোগ্রাফি অ্যান্ড ভিডিও’ এর কর্ণধার। তাঁর ওয়েডিং ফটোগ্রাফি অ্যান্ড ভিডিও এখন এতই জনপ্রিয় যে বছরের পর বছর পৃথিবীর এ প্রান্ত থেকে ও প্রান্তের তরুণ-তরুণীরা অপেক্ষা করেন তাঁর সিডিউল পেতে। তাঁর এ ফটোগ্রাফির সুবিধা নিতে বাংলাদেশী টাকায় ১০ থেকে ২০ লক্ষ টাকা খরচ করতেও দ্বিধা করেন না বিভিন্ন দেশের কপোত-কপোতীরা। তাঁর হাতের পরশে বিয়ের ছবিগুলো হয়ে ওঠে জীবন্ত আর চলমান ছবিগুলো গল্প-গাঁথা’র একেকটি চলচ্চিত্র। আর সেই চলচ্চিত্রের মোহময় আবহে নব দম্পতির এই শ্রেষ্ঠ রোমাঞ্চগুলো বেঁচে থাকে যুগ-যুগ ধরে। আর এ করতে করতে ফটোগ্রাফি’র এ যাদুকরও দিনে দিনে হয়ে উঠেছেন পৃথিবীর সেরাদের অন্যতম সেরা ওয়েডিং ফটোগ্রাফার। অস্ট্রেলিয়ান টেলিভিশন ‘এসবিএস’ এক বছর সময় ধরে তাঁর উপর তৈরি করে ‘ব্রাইডস অব খান’ তথ্যচিত্র। সেখানে ওঠে আসে সময়ের এই শ্রেষ্ঠ ওয়েডিং ফটোগ্রাফারের বর্ণাঢ্য জীবন ও কাজ। অস্ট্রেলিয়ান ব্রাইডাল ইন্ডাস্ট্রি একাডেমী ২০০৬ সালে তাঁকে নির্বাচিত করেছে সেরা ফটোগ্রাফার। আলোকচিত্রী হিসেবে পেশাজীবন গড়ে উঠবে বা খ্যাতিমান হয়ে যাবেন, এমনটা আগে ভাবেননি তিনি। ঢাকায় বেড়ে ওঠা অ্যালেন খান রেসিডেনসিয়াল মডেল কলেজ থেকে এইচএসসি পাস করার পর ১৯৭৩ থেকে ’৭৫ সাল পর্যন্ত তৎকালীন ঢাকা ফ্লাইং ক্লাবে শিখেছিলেন বিমান চালনা।
সেই অ্যালেন খান, তাঁর সঙ্গেই কথা হচ্ছিল তাঁর মার্সফিল্ডের নিজ স্টুডিওতে বসে। তিনি বলেন, আমি বাংলাদেশে পাইলট ছিলাম। আমার যোগ্যতা থাকা সত্ত্বেও আমাকে রেখে অন্যদের নিয়োগ দেয় বাংলাদেশ বিমান। আমার ভাই আবু জাফর ওবায়দুল্লাহ খান তখন বাংলাদেশ সরকারের সচিব কিন্তু এসব নিয়ে আমি তাঁর কাছে যেতে চাইনি। একটু অভিমান নিয়ে চলে আসি অস্রেচিলিয়া।
১৯৭৭ সালে প্রবাসে আসার পর সাধারণত যা হয় অন্যদের বেলায়, অ্যালেন খানের ক্ষেত্রেও তাই হয়েছে। ‘প্রথম প্রথম অনেক কষ্ট করেছি তবে যেকোন কাজকেই আমি গুরুত্ব দিতাম তাই ফ্যাক্টরিতে সাধারণ শ্রমিক হিসেবে কাজে লেগে পড়লাম আর পাইলট ছিলাম বলে এখানেও এ কাজটা করতে পারি কিনা দেখছিলাম কিন্তু না, লাইসেন্স পেতে অনেক ঝক্কি-ঝামেলা ছিল। তাই ওদিকে আর যাওয়া হয়নি। এখন অবশ্য দুঃখটা নেই আমার, এ ফটোগ্রাফি কাজটা অনেক আনন্দের’ থেমে থেমে তিনি বলছিলেন অস্ট্রেলিয়ার প্রথম জীবনের এসব কথা।
‘ফটোগ্রাফির আমি কিছুই জানতাম না। গাজী উজ্জ্বল হক বাংলাদেশ থেকে অস্ট্রেলিয়ায় এসেছিলেন আমাদের আগে। প্রফেশনালি ফটোগ্রাফি করতেন এখানে। তিনিই একদিন আমাকে ফটোগ্রাফি করতে নিয়ে যান। সেই থেকে, তারপর এই ৩৪ বছর হাঁটছি এ পথে আর শিখছি ফটোগ্রাফির অন্দর-বাহিরের অনেক কিছু। ফটোগ্রাফিতে আমার প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষাও নেই তবে কাজটা করি আমি হ্রদয় থেকে একাগ্রচিত্তে’।
কাজের মান কিভাবে তৈরি করতে হয় সে ব্যাপারে তিনি বলেন, একদিন এখানকার বিখ্যাত একজন গাড়ী বিক্রেতা তাঁর মেয়ের বিয়ের ফটোগ্রাফি করাবেন বলে তাঁর সেক্রেটারি আসেন কথা বলতে। তিনি এসে বলেন সীমিত সময়ের মাঝে কাজ করতে হবে। টাকা-পয়সা মোটামুটি যা চাই তাই দিবে। কিন্তু আমি দেখছিলাম ওই সময়ের মাঝে মোটেও ভাল কাজ করা যাবে না তাই তাঁদের প্রস্তাব ফিরিয়ে দিলাম। রাতে স্বয়ং গাড়ী বিক্রেতা ওই বিখ্যাত মানুষটি ফোন করে জানতে চান কেন আমি না করলাম। আমি বললাম, যদি কেউ টাকা নিয়ে রাত দুপুরে গাড়ী কিনতে চায় তুমি নিশ্চয় রাত-দুপুরে দোকান খুলে বসবে না। আমিও আমার কাজটা আমার মত বিক্রি করতে চাই। গাড়ী বিক্রেতা আমার কথা বুঝেছিলেন এবং অনেক সময় নিয়েই অনুষ্ঠানটা করতে বললেন। পরবর্তীতে আমি আরো অনেক কাজ পেয়েছিলাম ওখান থেকে। ‘এখন বাংলাদেশী অনেকেই এ পেশায় আসছেন এটা আমাকে আনন্দ দেয়’
কাগজে-কলমে তাঁর নাম হেদায়েতুল্লাহ খান। ফ্লাইং ক্লাবে তাঁর এক বিদেশি প্রশিক্ষক তাঁকে অ্যালেন নামে ডাকতেন। সেই থেকে তিনি অ্যালেন খান নামেই পরিচিত সবার কাছে।
ভাই-বোনদের সাথে অ্যালেন খান
অ্যালেন খান বাংলাদেশের বহুমাত্রিক প্রতিভা সমৃদ্ধ একটি পরিবারের সন্তান। বাবা ছিলেন পাকিস্তানের জাতীয় পরিষদের স্পীকার বিচারপতি আব্দুল জব্বার খান আর মা ফিরোজা বেগম ছিলেন গৃহিণী। তাঁরা ৮ ভাই ও ৫ বোন ছিলেন, এখন ৬ ভাই ও ২ বোন জীবিত আছেন। তাঁর ভাই-বোনদের মাঝে সাদেক খান চিত্রপরিচালক ও কলামিস্ট, আবু জাফর ওবায়দুল্লাহ খান ছিলেন একুশে পদক ও বাংলা একাডেমী পুরস্কার পাওয়া কবি ও বাংলাদেশ সরকারের সচিব ও পরে মন্ত্রী, এনায়েতুল্লাহ খান ছিলেন ইংরেজি দৈনিক ‘দ্যা নিউ এজ’ এর সম্পাদক ও বাংলাদেশ সরকারের মন্ত্রী, রাশেদ খান মেনন রাজনীতিবিদ ও বর্তমান সরকারের মন্ত্রী, বোন সেলিমা রহমান রাজনীতিবিদ ও বিএনপি সরকারের মন্ত্রী ছিলেন, শহীদুল্লাহ খান বাদল ঢাকায় ব্যবসা করেন, সুলতান মাহমুদ খান যুক্তরাষ্ট্র প্রবাসী স্থপতি, আমানউল্লাহ খান অস্ট্রেলিয়া সরকারের উচ্চপদে চাকুরী করেন আর বোন শিরিন খান লন্ডন প্রবাসী।
বর্তমানে স্ত্রী সাফিনা হেদায়েত ও ছেলে সাদ খানসহ সিডনিতে বসবাস করেন নিজ বাড়ীতে। এছাড়া, মেয়ে সাবরীনা খান, সামরীন খান ও ইসমা খান বিয়ে করে সিডনিতেই থাকেন।
অ্যালেন খান এর সাক্ষাৎকার নিচ্ছেন লেখক
kawsark@gmail.com
|