স্বপ্নের অস্ট্রেলিয়া, অনিশ্চয়তার হাতছানি কাউসার খান
পরিবর্তনটা এসেছে অস্ট্রেলিয়ায় সবচেয়ে জনপ্রিয় কর্ম ভিসা ৪৫৭ সাবক্লাসে
পৃথিবীর শীর্ষ শান্তিপূর্ণ দেশগুলোর তালিকায় অস্ট্রেলিয়া অন্যতম। সমৃদ্ধ অর্থনীতি এবং সামগ্রিক নিরাপত্তা, অনুকূল আবহাওয়া ও প্রাকৃতিক সৌন্দর্য সব মিলিয়ে বসবাসের জন্য চমৎকার একটি দেশ অস্ট্রেলিয়া। বৈধ নিয়মে দেশটিতে প্রবেশ, কর্মসংস্থান ও বসবাসের অনুমতি পাওয়ার জটিলতাও খুব বেশি নয়। এ জন্য দেশটিতে স্থায়ীভাবে বসবাসের ‘সোনার হরিণ’ এর পিছু নিচ্ছে বিশ্বের অসংখ্য বর্ণ-জাতি-ধর্মের মানুষ। আর এ কারণে দিন দিন দেশটিতে অভিবাসীদের সংখ্যা বেড়েই চলছিল। কিন্তু সম্প্রতি অস্ট্রেলিয়া সরকার অভিবাসন আইন এবং নিয়মে এনেছে বেশ বড়সড় একটা পরিবর্তন। আর এই পরিবর্তনটা এসেছে অস্ট্রেলিয়ায় সবচেয়ে জনপ্রিয় কর্ম ভিসা ৪৫৭ সাবক্লাসে। অস্ট্রেলিয়ান অভিবাসন কর্তৃপক্ষ ‘ডিপার্টমেন্ট অব ইমিগ্রেশন এ্যন্ড বর্ডার প্রটেকশন' প্রকাশিত এক প্রতিবেদন অনুযায়ী বর্তমানে অস্ট্রেলিয়ায় প্রায় ৯৫ হাজারেরও বেশি মানুষ কাজ করছেন এ ভিসায়। জনপ্রিয় ৪৫৭ কর্ম ভিসাটি আগামী ২০১৮ সালের মার্চ মাস নাগাদ পুরোপুরি বিলোপ করে দেওয়ার ঘোষণা দিয়েছেন দেশটির বর্তমান সরকার। অস্ট্রেলিয়ায় কয়েক প্রজন্ম আগে অভিবাসী হওয়া মানুষজনের কাছে কতটুকু প্রংশসিত হয়েছে এ ঘোষণা এটা বেশি না জানা গেলও সচেতন অস্ট্রেলীয় ও বুদ্ধিজীবী মহলে সরকারের হঠাৎ এ অপ্রত্যাশিত সিদ্ধান্ত ব্যাপক সমালোচনা মুখে পড়েছে। তাঁদের মতে, ২০১৮ সালে আগত অস্ট্রেলিয়া জাতীয় নির্বাচনকে ঘিরেই এমন সব কঠোর সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছে এ সরকার। যদিও অস্ট্রেলিয়ার প্রধানমন্ত্রী ম্যালকম টার্নবুল তার সরাসরি জবাবে বলেছেন, এটা রাজনীতিগত নয়, নীতিগত। অন্যদিকে ৪৫৭ ভিসা বিলোপের ধাক্কা সামলানোর মানসিক প্রস্তুতি নিতে না নিতেই অস্ট্রেলিয়ার নাগরিকত্ব প্রাপ্তির কঠোর প্রক্রিয়া নিয়ে আবার নতুন ঘোষণা দিয়ে বসেছে অস্ট্রেলিয়ার এ সরকার। তবে তা বহুল সমালোচিত ৪৫৭ ভিসার উচ্ছেদ ও পরিবর্তন এবং অস্ট্রেলিয়ার নাগরিকত্ব প্রাপ্তির কঠোর আইন কতদিন বহাল থাকবে কিংবা আবার সহজতর নতুন প্রক্রিয়া ঘোষণা হবে কিনা তা সময়ই বলে দিবে, এর জন্য অপেক্ষা করা ছাড়া আপাতত কোন উপায় নেই। তবে পরিবর্তন যখন হয়েছে, অস্ট্রেলীয় কর্তৃপক্ষ তা অক্ষরে অক্ষরেই পালন করবে তা নিশ্চিত। তাই নতুন নিয়মে নিজেদের খাপ খাওয়াতে প্রস্তুত হওয়াই ভালো বলে বিশেষজ্ঞগণ মতামত দিয়েছেন। তবে এরপরও আশার কথা হচ্ছে নাগরিকত্বে পরিবর্তনের ঘোষণা বাস্তবায়ন করতে সরকারকে আরও কয়েক ধাপ পেরুতে হবে বলে আইনজ্ঞরা জানিয়েছেন। যদি ওই কয়েক ধাপ উত্তীর্ণ না হতে পারে তাহলে নাগরিকত্ব আইনের পরিবর্তনের ঘোষণা অকার্যকর হবে।
যা ছিল ৪৫৭ ভিসায়
অন্যান্য ভিসার পাশাপাশি স্থায়ীভাবে অস্ট্রেলিয়ায় বসবাসের জন্য ২০১০-২০১১ সালের পরে যারা অস্ট্রেলিয়ায় পাড়ি জমিয়েছেন তাদের সিংহভাগই ‘এমপ্লয়ার নমিনেশন স্কিম’ ও ‘টেম্পোরারি স্কিল্ড ওয়ার্ক ৪৫৭ ভিসায়’ অস্ট্রেলিয়া প্রবেশ করেছেন। ব্যবসা বা এর মালিক মনোনীত চাকুরিপ্রার্থী কোনো একটি কাজের দক্ষতার উপর ভিত্তি করে একটি প্রতিষ্ঠানের অথবা মালিকের নিয়ন্ত্রণে চাকুরি নিয়ে অস্থায়ী ভিসায় অস্ট্রেলিয়া প্রবেশ করতেন এবং পরে দু’বছর ওই প্রতিষ্ঠানে কাজ করার পর অনেক সহজ শর্তে স্থায়ীভাবে বসবাসের জন্য আবেদন করতে পারতেন। তখন এ ৪৫৭ ভিসার আওতায় ৬ শতাধিক পেশা ছিল যে গুলোতে সহজেই আবেদন করে ভিসা পাওয়া যেত।
যা পরিবর্তন হলো
কিন্তু গত ১৮ই এপ্রিল অস্ট্রেলিয়ার প্রধানমন্ত্রী ম্যালকম টার্নবুল আকস্মিকভাবে জনপ্রিয় ৪৫৭ ভিসা বিলুপ্ততা সংক্রান্ত একটি ঘোষণা দেন। তিনি ৪৫৭ ভিসাটির পরিবর্তে নতুন দুটি ভিসা চালুর কথা জানান। ‘মিডিয়াম ও লং-টার্ম স্ট্রাটেজিক স্কিলস লিস্ট’ এবং ‘শর্ট-টার্ম স্কিল্ড অকুপেশন লিস্ট’ উপর ভিত্তি করে নতুন দুটি ভিসার আওতায় পূর্বের সাড়ে ৬ শতাধিক পেশার তালিকা থেকে ২ শতাধিকেরও বেশি পেশা বাতিল করে দেন। তবে অপরিবর্তিত থাকা পেশাগুলোর সাথেও জুড়ে দেয়া হয়েছে বাড়তি কিছু যোগ্যতার শর্ত। এছাড়া নতুন স্বল্পমেয়াদী ভিসার মেয়াদ থাকবে দু’ বছর এবং চাইলে সবোর্চ্চ অতিরিক্ত আরও দু’ বছরের মেয়াদ বাড়ানো যাবে কিন্তু স্থায়ীভাবে বসবাসের জন্য আবেদন করা যাবে না। তবে নতুন মাঝারি ও দীর্ঘমেয়াদি ভিসার মেয়াদ থাকবে চার বছর এবং তিন বছর কাজ করার পর স্থায়ীভাবে বসবাসের জন্য আবেদন করা যাবে। এ ভিসার আওতায় থাকা পেশার তালিকাটি এমনি খুব সীমিত এবং সেই তালিকার মাঝে স্থায়ীভাবে বসবাসের জন্য আবেদনযোগ্য পেশার সাথে আরও অনেক শর্ত জুড়ে দেয়া হয়েছে। নুন্যতম দুই বছরের কর্ম অভিজ্ঞতা ও ইংরেজি ভাষা জ্ঞান হতে হবে আরও বেশি। এছাড়া এই ভিসার নতুন প্রক্রিয়ায় প্রয়োজন পড়বে পূর্বে কোনো অপরাধমূলক ঘটনার সঙ্গে জড়িত না থাকার প্রমাণপত্র। আর স্বাভাবিকভাবেই অনেকই ধারণা করছেন এখন থেকে আবেদনপত্র কড়াকড়ি ভাবে যাচাই করা হবে। নতুন দুটি কর্ম ভিসার মধ্যে ৪ বছরের আবেদন করার ভিসা ফি করা হয়েছে আগের চেয়ে প্রায় দ্বিগুণ।
নাগরিকত্ব গ্রহণেও পরিবর্তন
অন্যদিকে ৪৫৭ ভিসা বিলোপের ধাক্কা সামলানোর মানসিক প্রস্তুতি নিতে না নিতেই নাগরিকত্ব প্রাপ্তির কঠোর প্রক্রিয়া নিয়ে নতুন ঘোষণা দিয়েছে অস্ট্রেলিয়া সরকার। গত ২০শে এপ্রিল এক ঘোষণায় অস্ট্রেলিয়ার প্রধানমন্ত্রী টার্নবুল, শক্তিশালী অস্ট্রেলিয়া ও নাগরিক গড়তে নাগরিকত্ব দেওয়ার প্রক্রিয়া আরও কঠিন করার নির্দেশ দেন। অভিবাসীদের অস্ট্রেলিয়ার নাগরিকত্ব গ্রহণ করতে হলে এক বছরের পরিবর্তে এখন থেকে চার বছর অস্ট্রেলিয়ায় স্থায়ীভাবে বসবাস করতে হবে। এছাড়া ইংরেজি ভাষার দক্ষতা হতে হবে অনেক বেশি যা কিনা আইইএলটিএস এ নুন্যতম ৬ স্কোরের সমমান। এছাড়া, আবেদন করতে অস্ট্রেলিয়ায় চাকরি জীবনের ইতিহাস এবং বিভিন্ন সামাজিক সংগঠনে তার কার্যের প্রমাণও দেখাতে হবে। এছাড়া পূর্বে একজন স্থায়ী অভিবাসী নাগরিকত্বের জন্য জ্ঞান পরীক্ষণ পরীক্ষা যতবার ইচ্ছে দিতে পারতেন কিন্তু এখন থেকে সর্বোচ্চ তিনবার পরীক্ষা দিতে পারবেন এবং এরপরে আবার মধ্যবর্তী কত সময় পেরোনোর পর সে পরীক্ষা দিতে পারবেন তা নিশ্চিত করা যায় নি এখনো।
কেন এই পরিবর্তন?
অস্ট্রেলিয়ার সরকার বরাবরই তাদের নাগরিকদের সর্বোচ্চ সুবিধা দিতে চায়। এর সে চাওয়া থেকেই ৪৫৭ ভিসা বাতিল এবং নাগরিকত্ব প্রাপ্তির নিয়মে এত পরিবর্তন। এছাড়া অস্ট্রেলিয়ার নাগরিকদের কাজের ক্ষেত্রে অগ্রাধিকার দিতেই এমন সিদ্ধান্ত নিয়েছেন বলে জানিয়েছেন সরকার। তবে বিরোধীদল এবং সামাজিক সংগঠন প্রতিবাদে মুখর রয়েছে। সমালোচনা এবং প্রতিবাদের জবাবে অস্ট্রেলিয়ার প্রধানমন্ত্রী টার্নবুল বলেন, চাকরির ক্ষেত্রে অস্ট্রেলিয়ার নাগরিকদের অগ্রাধিকার নিশ্চিত করার জন্য ৪৫৭ ভিসা ব্যবস্থা বিলোপ করা হচ্ছে। তিনি বলেন, নতুন ভিসা ব্যবস্থাটি ‘কঠোরভাবে জাতীয় স্বার্থে’ পরিচালনা করা হবে। শুধু দক্ষ কর্মীরাই এই ভিসা পাবেন বলেও জানান তিনি। তবে বর্তমান ৪৫৭ ভিসাধারীদের কোনো সমস্যা হবে না বলে জানান প্রধানমন্ত্রী। এছাড়া অভিবাসন কর্তৃপক্ষ জানান, অস্ট্রেলিয়ায় ক্রমবর্ধমান বেকারত্বের পরিপ্রেক্ষিতেই মূলত এমন সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। নাগরিকত্ব প্রাপ্তির প্রক্রিয়ায় পরিবর্তন নিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, অস্ট্রেলীয়দের মৌলিক মূল্যবোধের প্রতিফলন নাগরিকত্ব প্রত্যাশীদের মধ্যেও থাকা উচিৎ। এছাড়া অস্ট্রেলীয়দের সাথে মিলেমিশে চলতে পারার যোগ্যতা থাকাটাও প্রয়োজন বলে তিনি মনে করেন।
পরিবর্তনের ধারায় কি করা উচিৎ
কারণ যাই হোক না কেন নতুন আইন মেনেই যে কাউকে অস্ট্রেলিয়ায় প্রবেশ কিংবা বসবাস করতে হবে। তবে নতুন দুটি ভিসা ২০১৮ সালের মার্চ থেকে কার্যকর হবে। এর আগ অবধি ৪৫৭ ভিসা বহাল থাকলেও ভিসা প্রাপ্তির নিয়মে পরিবর্তন এসেছে। তবে এরই মধ্যে অর্থাৎ ১৯শে এপ্রিলের পূর্বেই যারা ভিসার জন্য আবেদন করে ফেলেছেন তাদের অস্ট্রেলিয়ার অভিবাসন ওয়েবসাইট থেকে পেশার তালিকা যাচাই করে নেয়া উচিৎ। বাতিল করা হয়েছে এমন পেশার জন্য আবেদন করে থাকলে তা প্রত্যাহার করার জন্য সরকারের নির্দেশ রয়েছে এবং সেক্ষেত্রে আবেদন ফি ফেরত পাওয়া যাবে। আর আবেদনকৃত পেশাটি যদি নতুন তালিকায় থেকে থাকে সেক্ষেত্রে কিছু করতে হবে না। তবে অভিবাসন বিভাগ যে প্রতিষ্ঠানে চাকরি দিচ্ছে সে প্রতিষ্ঠানের তথ্যাদি ও পদ সংক্রান্ত সত্যতার বাড়তি কাগজপত্র চাইতে পারে। তবে এখন থেকে অস্ট্রেলিয়ায় স্থায়ীভাবে বসবাস ও নাগরিকত্ব গ্রহণের সুযোগটা অনেকাংশেই কমে যাবে এবং জটিলতাও বাড়বে দ্বিগুণ বলে ধারণা করা হচ্ছে। যারা ইতিমধ্যেই অস্ট্রেলিয়ায় স্থায়ীভাবে বসবাস করছে বা অস্থায়ীভাবে বিভিন্ন পেশায় রয়েছে তাদের ইংরেজি দক্ষতা বাড়াতে হবে। বেশি বেশি কাজ করার প্রবণতা ও দক্ষতা বৃদ্ধি করতে হবে, প্রয়োজনে সম্পৃক্ত বিভিন্ন স্কুলে প্রশিক্ষণ নিতে হবে। এছাড়া বিভিন্ন সামাজিক সংগঠনের সাথে যুক্ত হয়ে সামাজিক উন্নয়নমূলক কাজে অংশগ্রহণ করার চেষ্টা করতে হবে। বর্তমানে অস্ট্রেলিয়ায় ৯৫ হাজারেরও বেশি মানুষ এ অস্থায়ী ৪৫৭ কর্ম ভিসা আওতায় বিভিন্ন পেশায় নিয়জিত রয়েছে। সরকারের হঠাৎ এমন সিদ্ধান্ত তাদের কর্মজীবনে অনেক বড় প্রভাব ফেলছে। তবে অস্ট্রেলিয়ার অভিবাসন আইনে বড় ধরনের পরিবর্তন এটাই প্রথমবারের মতো নয়। এর আগেও অন্যান্য ভিসা শ্রেণিতে বড় বড় পরিবর্তন এসেছে। সরকারের নতুন নিয়ম মেনেই হাজারো বাংলাদেশি সফলভাবে অস্ট্রেলিয়ায় বসবাস করছেন। সুতরাং নতুন যে কোনো কিছুই প্রথম প্রথম বুঝতে কিংবা অনুসরণ করাটা কষ্টসাধ্য। তবে ধৈর্য নিয়ে সময়ের সাথে সবকিছু পরিষ্কার হয়ে যাবে বলে মনে করেন বাংলাদেশী বিভিন্ন সামাজিক সংগঠনের ব্যক্তিবর্গগণ ।
কাউসার খান, অস্ট্রেলিয়ান অভিবাসন আইনজীবী email: kawsark@gmail.com
|