সরকার কবিরউদ্দিন এর চারটি অনুগল্প
পেতলের গুলির খোসা
একাত্তরের যুদ্ধের সময়, আমি গৌরীপুর বাজারে একটা গুলির খোসা পেয়েছিলাম। পেতলের। বাজার থেকে নদীর ঘাটে আসবার পথে চাষের জমির যে চক, চকের লাগোয়া একটা বড় মাঠ ছিলো। গুলির খোসাটা পেয়েছিলাম ওই মাঠে। গুলিটা ব্যবহার করা হয়ে গেছে, তবুও খোসাটা আমার কাছে ছিলো বহুদিন, অনেক যত্নে। আমি যত্নের কারণটা বলি। তখন অনেককেই দেখেছি পরিজন-পরিবার নিয়ে ভিটেমাটি ছেড়ে চলে যাচ্ছেন। অননুকূলের যাওয়া। পায়ে হেঁটে, রোদবৃষ্টি মাথায়, কতখানি বিষয়-আশয় সঙ্গে করে আর নেওয়া যায়! প্রায় সবারই পোটলা-পুটলির সাথে পেতলের ঘটিবাটি থাকতো। এই পেতলের ঘটিবাটি আমার ভেতরে ধারণা তৈরি করেছিলো, পেতল দামী একটা ধাতু। আমার পাওয়া গুলিটার মালিকানা কাদের ছিলো জানতাম না। মুক্তিবাহিনীদেরও হতে পারে, আবার নাও হতে পারে। তখন, লোক মুখে শুনতাম, গৌরীপুর বাজারে মাঠে, নদীর পাড়ে, পাকিস্তানী আর্মিরা রাত-বিরাতে মানুষকে গুলি করে, মেরে, নদীতে ভাসিয়ে দিতো।
স্যরি
গল্পটা আমার এক বন্ধু মোজাম্মেলের। কলেজের বন্ধু। শুনে মনে হতে পারে, আমার নিজের বিষয়টা মোজাম্মেলের ওপর চাপিয়ে দিচ্ছি। এমনটা মনে হলে, ঠিক আছে, কিছু করার নেই। মোজাম্মেলের কলেজ জীবনে ওর ক্লাসমেট ছিলো হেনা। প্রণয়-ট্রনয় হয়েছিলো ওদের। সাধারণত যা হয়, কলেজের প্রণয় সংসারের মুখ দেখে না, সচরাচর গল্পের মেয়েটির বিয়ে হয়ে যায় অনেক আগেই। হেনারও বিয়ে হয়ে গিয়েছিলো। তো হয়েছিলো কী, কলেজ জীবনের ১৯ বছর পর মোজাম্মেল কলোরাডো থেকে ঢাকাতে গেছে। হেনার সঙ্গে দেখা করতে চেয়েছে। দুজনে হাতিরপুলে একটা কফি-সপে বসেছে। যা হয়, অপরিণত প্রণয়ের ব্যথা দুজনকে চারপাশ থেকে অবশ করে রেখেছিলো। মোজাম্মেল সোজাসাপ্টা মানুষ, হেনাকে এক পর্যায়ে বললো, হেনা, আমি স্যরি। কয়েকটা মুহূর্ত চুপ থেকে হেনা বলেছে, তোমার স্যরি আমি চেয়েছি?
গেছো-ক্যাঙ্গারু
আমি যে বাড়িটাতে থাকি, তার সীমানার ভেতরে চারটা বড়বড় ঝাউগাছ রয়েছে। তার মাঝে একটা তিনতলার সমান উঁচু, অন্য তিনটাও প্রায় সমান উঁচু। তো, ওই একটা গাছ, যার কথা বললাম, সেই গাছটাতে একটা ‘পসাম’ (Possum) থাকে। ‘পসাম’ মানে, গেছো-ক্যাঙ্গারু। ওরা আলোতে চোখে দেখে না। নিশাচর (Nocturnal)। খাবার খুঁজতে বের হয় রাতে। অনেক আগের কথা, আমি যখন রাত করে বাড়ি ফিরতাম, প্রায় প্রায়ই ‘পসাম’টির সঙ্গে দেখা হয়ে যেতো। আমাকে চিনতো না বিধায় ভয় পেয়ে, ফিরে, গাছে উঠে যেতো। বেশ সময় পরে, যখন ওর সাথে একটু জানাশোনা হয়েছে, আমার পায়ের শব্দ ও চিনে ফেলেছে, আমার কণ্ঠস্বর ও বুঝে ফেলেছে; আমি ওর নাম রেখেছি। স্কিপি। আমার সাথে দেখা হয়ে গেলে, ফিরে, গাছে উঠে যায় না তখন। ফেন্সের ওপর বসে, আমার দিকে তাকিয়ে থাকে। আমি স্কিপিকে ‘স্কিপি’ বলে ডাকি, আমার মনে হয়, ও খেয়াল করে। রাস্তার টিমটিমে লাইট-পোস্টের ছোট আলোতে আমি স্কিপির চোখ দেখি। কেমন মায়া মায়া...
লেডিবার্ড
আমার তিনটে বাড়ি পরে এক অন্তর্মুখী মানুষ থাকেন। জর্জ। আমার প্রিয় প্রতিবেশীদের একজন। আশির কাছাকাছি বয়স। বাইরে যাচ্ছিলো। জিজ্ঞেস করলাম, কই যাও? জর্জ বললো, সেমেট্রিতে যাচ্ছি। আমার স্ত্রীর কবরে আগাছা হয়েছে। পরিষ্কার করতে যাবো। তুমি যাবে আমার সাথে? আমারও কোন কাজ ছিলো না। বললাম, চলো। যাবো। সেমেট্রি থেকে ফিরবার পথে একজন বাবার সাথে দেখা হয়েছে, চারবছরের মেয়েকে নিয়ে এসেছে। বাবাটির বামহাতের ছোট আঙ্গুলটা কন্যা দুহাতে ধরে রেখেছে বলে কন্যাটি কিছুটা বাবার দিকে ফিরে আছে। মেয়েটির চোখগুলো ছলছল, বাবার সোয়েটারের হাতের আড়ালে আধো লুকানো। ওর একটি গাঢ় লাল লেডিবার্ড ছিলো, কালোছিটি দেয়া। পোকাটা গতকাল রাতে মরে গেছে। বোঝা যাচ্ছে কন্যাটির মন খুব পীড়িত। খুবই। আর, বাবাটির ডানহাতে একটা মাটিমাখা স্টেইনলেস স্টিলের চায়ের চামচ। ক্রস করে যাবার সময় চামচটির ওপর চোখ পড়েছে। আমার কারণ জানতে চাওয়া চোখ ভদ্রলোকের চোখে পড়ে যাওয়ায় তিনি লেডিবার্ডটির মৃত্যুসংবাদ বললেন। চামচ দিয়ে কবর খুঁড়ে পোকাটিকে সমাধিস্থ করার কথা বললেন, ভদ্রলোকের নিজের বাবার কবরের সীমানার ভেতর। এরপর একটু নিচু স্বরে বললেন, এই সুবাদে আমারও বাবার কাছে আসা হয়ে গেছে।
সরকার কবিরউদ্দিন, সিডনি, অস্ট্রেলিয়া
|