হুমায়ুন আহমেদের গল্পের টানে কোলকাতা বইমেলা জয়শ্রী মুখার্জী
পাবলিশার্স এন্ড বুক সেলার্স গিল্ড আয়োজিত ২০১৭ সালের আন্তর্জাতিক কোলকাতা বইমেলা শুরু হয়েছিল ২৫শে জানুয়ারি। চলে ৫ই ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত। ২২ দিনের এই বইমেলায় প্রতিদিনই হাজার হাজার মানুষ বইয়ের টানে হাজির হন কোলকাতা "সায়েন্স সিটি" র উল্টোদিকে মিলনমেলা প্রাঙ্গণে।
- আচ্ছা, দাদা হুমায়ুন আহমেদের উপন্যাস সমগ্রের ১৪ নং খণ্ডটা কি বেরুলো?
- না দাদা, এবারে পাবেন না-তবে মাস দুয়েকের মধ্যে এসে যাবে -
এই কথোপকথনের মধ্যেই ৪১তম কোলকাতা বইমেলার ‘বাংলাদেশ’ মণ্ডপের ‘‘অবসর প্রকাশনা সংস্থা‘র স্টলের মধ্যে আমার নাকটি গলিয়ে দিলাম। সুঘ্রাণ এল - নতুন বই, পুরনো দামী লেখক হুমায়ুন আহমেদকে নতুন করে পাবার গন্ধ। কথায় কথায় বাঙ্গালীর হৃদয়ের শব্দ, বাঙ্গালীর বাংলা গল্পের বা উপন্যাসের টান ধরা পড়ল আমার মনের সূক্ষ্ম গভীর করিডোরে। ‘হিমু’ আজও সমান জনপ্রিয়তা নিয়ে বেঁচে আছে। দুই মেয়ে কলেজ পড়ুয়ার হাতে তখন চকচকে মলাটের হিমু - ‘‘সেরা সাত হিমু’’। নতুন প্রজন্ম আজকাল আর বই পড়েনা-শুধু ই-বুকেই তাদের আশ্রয়-এ হেন কথাবার্তা কানে আসে, প্রমাণও মেলে। কিন্তু বই এর গন্ধ নিতে বা বইকে একটু স্পর্শ করতে বই পড়ুয়া বা না-পড়ুয়াদের ভিড়, কিছু কম হয় না কোলকাতা বইমেলায়। আর তারা যখন কোলকাতার শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়, প্রয়াত সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়, নবনীতা দেবসেন বা আরও বিখ্যাত লেখকদের ছাপিয়ে বাংলাদেশের সেই চিরসবুজ হুমায়ুন আহমেদের বই এর সন্ধানে আসেন তখন দুটো দেশের বইয়ের তারের বেড়া ছিঁড়ে যায় এক ‘বাংলার’ টানে।
লেখক হুমায়ুন যেমনটি ছিলেন তেমনটিই আছেন। আমার মেয়েবেলায় তিনি ‘‘লোকটি’’ গল্পের মত এক ঝটিকা যা পাল্টে দিতে পারে এক মানুষের মূল্যবোধ, এক সমাজের জং ধরা আবেগ। আর আজ আমার বড়বেলার অনুভূতিতেও ধরা পড়ল তাঁর সেই অনন্য উপস্থিতি। বইগুলো দেখাতে দেখাতে স্টলের বিক্রেতা জানালেন ‘‘এখন বাংলাদেশের প্রকাশনার যা বই বিক্রি হয় ধরে রাখতে পারেন অন্তত: ৫০ শতাংশ হুমায়ুন আহমেদের’’। আর তাই নতুন চকচকে মলাট। উপন্যাস সমগ্র প্রকাশিত হচ্ছে একের পর এক। এছাড়াও ছোট উপন্যাস আলাদা আলাদা করেও প্রকাশিত হচ্ছে। এ স্টলে বাংলাদেশের আরও অনেক বইও রয়েছে যেমন বাংলাদেশের পুরনো শহর, স্থাপত্য ইত্যাদি। কিছু রয়েছে আরো গবেষণা সংক্রান্ত নথি যা অনেক শিক্ষার্থী গবেষকদের জন্য খুবই প্রয়োজনীয়। বিক্রি বাটাও ভালোই চলে। হুমায়ুন আহমেদের উপন্যাস সমগ্র, সেরা সাত হিমু, সেরা সাত সায়েন্স ফিকশন, মিসির আলি অমনিবাস, তিন ভিনদেশি কিংবা আত্মজৈবনিক রচনাসমগ্রগুলি খুব যত্ন করে নামিয়ে বিক্রেতা আমাকে দেখিয়ে দিলেন।
২০১৭র কোলকাতা বইমেলার ‘বাংলাদেশ’ মণ্ডপটি সাজানো বলুন বা তৈরিই বলুন - হয়েছে অসাধারণ। বাংলাদেশের দিনাজপুরে ১৮ শতকে নির্মিত ধর্মীয় বৈশিষ্ট্য-সমৃদ্ধ একটি চমকপ্রদ স্থাপত্যকর্ম কান্তজীর মন্দিরের অনুকরণে এটা তৈরি হয়েছে। আর অবাক হবার মত ঢেপা নদীর তীরের কান্তজী মন্দিরের গায়ে আছে ২২ হাজার পোড়ামাটির ফলক। এতে গ্রামবাংলার প্রাত্যহিক জীবন ও পালকি নামে খ্যাত অভিজাত নৌকাভ্রমণসহ অন্যান্য উৎসমুখর আয়োজনকে ফুটিয়ে তোলা হয়েছিল পোড়ামাটির ওপর। কোলকাতার বইমেলার বাংলাদেশ মণ্ডপটি যেন সত্যই সেইসব চিত্র-শৈলী নিয়ে আহবান করছিল কলকাতা তথা সমগ্র বাংলাকে।
ফিরতি পথে এবারের বইমেলার থিম ‘কোস্টারিকা’ কে ছাড়িয়ে, বাউলের অঙ্গন, মুক্তমঞ্চ আর অসংখ্য বই এর স্টল এর রূপ রস গন্ধ টানতে লাগল বটে, তবুও রাত হয়েছে।
জয়শ্রী মুখার্জী, শিক্ষিকা ও চিত্রপরিচালক, কোলকাতা
|