টেনিস সেন্টারে বৈশাখী মেলা হ্যাপি রহমান প্রকৃতির নিয়মে বাংলার ঋতুচক্রের পালাবদলে উষ্ণতা নিয়ে আসে গ্রীষ্মকাল। কালবৈশাখী ঝড়ের আনাগোনা থাকুক বা না থাকুক, বৈচিত্রময় বৈশাখের প্রথম প্রহর প্রকৃতি প্রেমিক বাঙ্গালির জন্য গেঁথে চলে হৃদয় কম্পনের নিবিড় গল্প। নববর্ষ উদযাপনই হচ্ছে বাঙ্গালির সবচেয়ে বড় অসম্প্রাদায়িক ও সার্বজনীন উৎসব। ফলে, এ উৎসবের জৌলুস ও ঔজ্জ্বল্য আমাদের জাতিগত মর্যাদারই প্রতীক।
হাজার মাইল দূরত্বকে ছাপিয়ে অস্ট্রেলিয়ার ব্যস্ত জীবনে প্রবাসী বাংলাদেশিরাও একত্রিত হয় বৈশাখী মেলায়। দুই দশকেরও বেশি সময়ের ধারাবাহিকতায় এবারও বাংলা নববর্ষকে বরন করে নিতে সিডনিতে আয়োজন করা হয়েছিল বৈশাখী মেলার। সংখ্যায় ছোট কমিউনিটির উৎসবকে কেন্দ্র করে স্থানীয় সরকার ঘোষিত কোন ছুটি থাকেনা এখানে। তাই প্রতিবছর এপ্রিলের কোনো এক সাপ্তাহিক ছুটির দিনে এ মেলা বসে।
বঙ্গবন্ধু কাউন্সিল অস্ট্রেলিয়া গত ২২ বছর ধরে অস্ট্রেলিয়ার বৃহত্তর জনগোষ্ঠীকে সম্পৃক্ত করে এই মেলার আয়োজন করে আসছেন। বঙ্গবন্ধু কাউন্সিল অস্ট্রেলিয়া নিজস্ব উদ্যোগে ১৯৯৩ সালে সিডনীর বারউড গার্লস হাই স্কুলে প্রথম বৈশাখী মেলার আয়োজন করেন। অস্ট্রেলিয়ার আদিবাসী সংস্কৃতিসহ এ দেশের মূলধারার জনগোষ্ঠী এবং বিভিন্ন ভাষাভাষীর ও সাংস্কৃতিক সম্প্রদায় এ আয়োজনে যুক্ত। ১৮ই এপ্রিল ২০১৫, শনিবার সিডনি শহরের অলিম্পিক পার্কের টেনিস সেন্টারে সকাল থেকে রাত অব্দি এ মেলার আয়োজন করা হয়েছিল। দিনের শুরুতে সিডনির নীল আকাশে ঝকঝকে রোদ ছিল। দুপুরের দিকে দর্শক সমাগম কিছুটা কম হলেও সন্ধ্যা নামার সাথে সাথে বেড়ে চলে মেলায় আগত দর্শনার্থীদের আনাগোনা।
অস্ট্রেলিয়াতে নিযুক্ত বাংলাদেশের হাইকমিশনার কাজী ইমতিয়াজ হোসেন, বঙ্গবন্ধু কাউন্সিলের অস্ট্রেলিয়ার প্রেসিডেন্ট শেখ শামীমুল হক, সংঘটনটির অন্যান্য ব্যক্তিবর্গের পাশাপাশি অস্ট্রেলিয়ার প্রধানমন্ত্রীর বিশেষ প্রতিনিধি, বিরোধীদলীয় প্রধান, রাজ্য সরকার, স্থানীয় প্রশাসনিক কর্তাব্যক্তি, দেশি-বিদেশি বিভিন্ন মিডিয়া ব্যক্তিত্বসহ অন্যান্য মহলের অনেকেই এ মেলায় যোগদান করেছেন।
নির্ধারিত সময়ে বেলুন উড়িয়ে অনুষ্ঠানের শুভ সূচনা হয়। এবং নববর্ষকে স্বাগত জানিয়ে সম্মানিত অতিথিবৃন্দের শুভেচ্ছা বক্তব্যের পরে স্থানীয় শিল্পীরা কবিতা, নাচ-গান পরিবেশন করেন। সংঘটনটির সভাপতি জানান, বাংলাদেশ ও অস্ট্রেলিয়াতে সামাজিক কর্মকাণ্ডে অবদান রাখার জন্য বিভিন্ন বিষয়ে কৃতি ও গুণীজনদের মাঝে "বঙ্গবন্ধু অ্যাওয়ার্ড" দিয়ে আসছেন গত ১৩ বছর যাবৎ। এবারের এ্যাওয়ার্ডটি দেয়া হয় "শেয়ার কেয়ার" নামে একটি স্বেচ্ছাসেবী প্রতিষ্ঠানকে। যারা শিশু ও প্রতিবন্ধীদের নিয়ে কাজ করে থাকে। তিনি আরো জানান, টিকিট বিক্রির টাকা দিয়ে সবধরনের খরচ ছাড়াও বাংলাদেশ-অস্ট্রেলিয়া প্রাকৃতিক দুর্যোগ ব্যবস্থাপনাসহ বিভিন্ন দাতব্য প্রতিষ্ঠানে অনুদান করে থাকেন। উল্লেখ্য, সংঘটনটি প্রথম অ্যাওয়ার্ড প্রদান করেন সিডনি বঙ্গবন্ধু কাউন্সিলের প্রথম প্রেসিডেন্ট প্রয়াত গাজী রুহুল হক উজ্জ্বলকে। পরবর্তীতে শিক্ষায় প্রফেসর আজাদ, সিডনি অলিম্পিক পার্ক অথোরিটি, ভারতীয় বাঙ্গালি চিকিৎসক বিশ্বনাথ, অস্ট্রেলিয়াস্থ আন্তর্জাতিক স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা চিলড্রেন ফার্স্ট ফাউন্ডেশনসহ উল্লেখযোগ্য কৃতি ব্যক্তিত্ব ও প্রতিষ্ঠানকে।
ভারতীয় বাঙ্গালি চিকিৎসক বিশ্বনাথ ১৯৭১সালে ভারতীয় সেনাবাহিনীতে কর্মরত থাকাবস্থায় রক্তক্ষয়ী মহান মুক্তিযুদ্ধে আহত ও অসুস্থ মুক্তিযোদ্ধাদের সেবা শুশ্রূষা করেছেন। তার কিছুদিন পরে তিনি অভিবাসী ভিসায় অস্ট্রেলিয়ার সিডনিতে চলে আসেন এবং পরবর্তীতে বাংলাদেশি কমিউনিটিতেও চিকিৎসা সেবার মাধ্যমে উনি সক্রিয় ছিলেন।
আন্তর্জাতিক স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা চিলড্রেন ফার্স্ট ফাউন্ডেশন বাংলাদেশের বেশ কিছু দাতব্য প্রতিষ্ঠানকে বিভিন্ন সাহায্য-সহযোগিতার পাশাপাশি বাংলাদেশে জন্মগ্রহণ করা মাথা জোড়া লাগানো শিশু কৃষ্ণা ও তৃষ্ণার চিকিৎসার ব্যয়ভার নিয়েছিলো।
বর্ষবরণের নিয়মিত অনুষ্ঠানমালার বিশেষ আকর্ষণ ছিল বাংলাদেশ থেকে আসা সঙ্গীত শিল্পী আঁখি আলমগীরের গান। কিন্তু বেরসিক বৃষ্টি বাধ সাধে তাদের আয়োজনে। এসময় হতাশা, ক্ষোভ আর কষ্টের উপাখ্যান হয়ে উঠে পুরো গ্যালারী। কেউ কেউ নতুন ভেনু নিয়ে বলছেন বিড়ম্বনার কথা। টিকেট কাটার দীর্ঘ সারিতে দাঁড়িয়ে অনেককেই ক্ষোভ প্রকাশ করতে দেখা যায়। সকাল সন্ধ্যা উদয়াস্ত পরিশ্রম আর আনন্দ বিষাদের প্রবাসী জীবনে স্বদেশীয় প্রশান্তি পেতে সিডনি ছাড়াও ক্যানবেরা, মেলবোর্ন, ব্রিসবেন, পার্থ, অ্যাডিলেইড সহ প্রতিবেশী রাষ্ট্র নিউজিল্যান্ড থেকেও প্রবাসী বাংলাদেশিরা সমবেত হন বর্ষবরণের এই উৎসবে। তাদের দাবী, দীর্ঘ লাইনে দাঁড়িয়ে টিকেট কাটার ভোগান্তি থেকে মুক্তি পেতে অনলাইন ভিত্তিক টিকেট চালু হউক। এসময় তারা বর্তমান টিকেট ও পার্কিং মূল্য বেশি বলে অভিযোগ তোলেন। দর্শনার্থীরা মেলা প্রাঙ্গণে লোকজ উৎসবের ছোঁয়া খোঁজে পায়নি বলেও মন্তব্য করছিলো। অতীতের স্মৃতিচারণ করে আগত দর্শনার্থীরা বলছিলেন, মেলা হউক উন্মুক্ত। যেখানে বন্ধুবান্ধব, পরিবার-পরিজন সবাই মিলে পাটি বিছিয়ে গল্প আড্ডায় মেতে উঠবো। আমাদের ছোট ছেলেমেয়েরা ছুটে বেড়াবে মেলার এপ্রান্ত থেকে ওপ্রান্ত পর্যন্ত। এবিষয়ে মেলার আয়োজক কমিটির দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলে সংঘটনটির সভাপতি জানান, সিডনি বঙ্গবন্ধু কাউন্সিল একটি অলাভজনক সংঘটন। আমাদের বাংলাদেশি কমিউনিটিতে চায়না, ভারত ও অন্যান্য কমিউনিটির মত মিলিয়নিয়ার ব্যবসায়ী নেই। অথবা বাংলাদেশে থাকলেও উনারা টাকার প্রভাব প্রতিপত্তি দিয়ে একসময় রাজনৈতিক দলে ভীরে যান। বিভিন্ন দেশে বিনিয়োগ করেন, কিন্তু নিজ কমিউনিটির ব্যাপারে অনাগ্রহ দেখান। তবে ভবিষ্যতে যদি কেউ স্পন্সর বা বিনিয়োগ করতে আগ্রহী হন, তবে টিকেট এর ব্যাপারটি অবশ্যই বিবেচনা করবেন।
বেলা বাড়ার সাথে সাথে মেলায় ভিড় বাড়তে থাকে। আধখোলা গাঁঠ থেকেই ক্রেতারা জিনিসপত্র দেখছিলেন। মেলায় দোকানিদের হাঁক-ডাক সেইসাথে দরদাম-কেনাকাটা সব মিলেই যেন ক্রেতা বিক্রেতার মাঝে চলছিলো বিরক্তিহীন মধুর সম্পর্ক। শাড়ি, সেলোয়ার-কামিজ, জুয়েলারি, কসমেটিক্স, বই, সিডি, ক্রোকারিজ এবং বাংলাদেশি বিভিন্ন খাবার, পিঠার দোকান ছিল। মেয়েদের শাড়ি, সেলোয়ার-কামিজ, জুয়েলারি, কসমেটিক্স এর দোকানগুলোতে ছিল উপচে পরা ভিড়। পাশাপাশি খাবারের দোকানগুলোতেও।
অস্ট্রেলিয়ার বাঙ্গালি কমিউনিটির বৃহত্তম উৎসবের আয়োজক হিসেবে দেশীয় সংস্কৃতির যথার্থ পৃষ্ঠপোষকতার প্রতি কর্তৃপক্ষ আরও যত্নবান হবেন বলে আশাবাদী কমিউনিটির অভিজ্ঞ মহল।
মেলায় স্টল মালিকদের কেউ কেউ বলেন, এখানে বেড়ে উঠা প্রথম ও দ্বিতীয় প্রজন্ম যেখানে বাসায় ইংরেজিতে কথা বললেও বাংলাভাষা, সংস্কৃতির টানে পায়জামা-পাঞ্জাবি, সেলোয়ার-কামিজ, শাড়ি-চুড়ি পড়ে দেশীয় সাজে মেলায় আসছে। এবং তারা তাদের বন্ধুদের বলছে নিজের সংস্কৃতি, ঐতিহ্য নিয়ে। তখন সহজেই অনুমেয় হয় যে, এটি শুধু বাঙ্গালির মিলন মেলা বা এক টুকরো বাংলাদেশে পরিণত হওয়া নয়। এধরনের উদ্যোগ নিঃসন্দেহে নানান সংস্কৃতির আবহে স্বদেশীয় সংস্কৃতির মেলবন্ধন। আমাদের দেশে উৎপাদিত বিভিন্ন জিনিস, যেমন-তাঁত ও জামদানিতে তৈরি পোশাক, জুয়েলারি, বাঁশ-বেতের তৈরি আসবাব-পত্র, চামড়া ও পাটের তৈরি গৃহসজ্জার নানান উপকরণ দিয়ে তৈরি জিনিসপত্রের সাথে অন্য কমিউনিটির লোকদের পরিচয় করিয়ে দেয়া। এটা আমাদের দেশে উদযাপিত বাণিজ্যিক মেলার আদলে হতে পারে। এতে বৈশাখী মেলার জৌলুস ঔজ্জ্বল্য ক্রমশ বৃদ্ধি পাবে এবং সংস্কৃতির আদান-প্রদানের সাথে সাথে নিজ দেশে উৎপাদিত পণ্য ক্রয়-বিক্রয়ের মাধ্যমে আন্তর্জাতিক সুনাম অর্জনেরও সুযোগ সৃষ্টি হতে পারে।
লোক-সমাবেশ এবং আয়োজনের ব্যাপকতায় বাংলাদেশের বাইরে অনুষ্ঠিত সবচেয়ে বড় মেলা বলে দাবি করছেন আয়োজকরা। বিগত দিনের ধারাবাহিকতায় তারা অনুমান করছেন প্রবাসী বাংলাদেশিরা সহ স্থানীয় অন্যান্য কমিউনিটির প্রায় ২০ হাজার লোকের সমাবেশ ঘটেছিল সিডনির এই মেলায়। মেলার পরিসর দিন দিন বাড়তে থাকায় স্থান সংকুলানের অভাব, পর্যাপ্ত গাড়ি পার্কিংসহ অন্যান্য সুযোগ সুবিধা নিয়ে গত ২/৩ বছর যাবৎ অলিম্পিক পার্কের কর্তৃপক্ষ মেলার আয়োজকদের সাথে কথা বলে আসছিলেন। এব্যাপারে মেলার সভাপতি শেখ শামীমুল হক জানান বর্ষবরণের নিয়মিত অনুষ্ঠানমালার পাশাপাশি এবারের আয়োজনে বঙ্গবন্ধু কাউন্সিল আয়োজিত সিডনি বৈশাখী মেলার ২৩তম বর্ষপূর্তি পালিত হয়েছে। তাই সর্বসম্মতিক্রমে, ২০০০সালের সিডনি অলিম্পিক গেমসের এই সম্মানজনক ভেন্যুতে এবারের মেলার আয়োজন করা হয়। মেলার আগের স্থানের চেয়ে পরিসরে অপেক্ষাকৃত বড় এবং অন্যান্য সুযোগ-সুবিধার কথা বিবেচনা করে এবছর থেকে বৈশাখী মেলার স্থান সিডনি অলিম্পিক পার্কের টেনিস সেন্টারকে নির্বাচন করা হয়েছে। বঙ্গবন্ধু কাউন্সিল অস্ট্রেলিয়ার সভাপতি শেখ শামীমুল হক তাঁর শুভেচ্ছা বাণীতে বলেছেন, ‘এ উৎসবের উদ্যোক্তা ও আয়োজক হিসেবে এটা আমাদের সংগঠনের জন্য অনেক গর্বের বিষয়।
সমাজ সংস্কৃতি কেন্দ্রিক ঐতিহ্যময় এই বৈশাখ হাজার তারার বাতি জ্বালিয়ে দেয় আমাদের বাঙ্গালিপনায়। এ উৎসবকে ঘিরে ও একে কাজে লাগিয়ে দেশের অর্থনীতিতেও বর্ধিত মাত্রার কার্যকর অবদান যুক্ত করা সম্ভব। তাদের এধরনের আয়োজনের মধ্য দিয়ে উৎসব ও অর্থনীতি একই সঙ্গে সমান পৃষ্ঠপোষকতা পেতে পারে। এর জন্য দরকার ব্যাপক প্রচার।
পয়লা বৈশাখ শুধু একটি উৎসবই না। এটি বাঙ্গালির প্রাণের নির্যাস আনন্দ-মুখর উৎসব। ধর্ম বর্ণ নির্বিশেষে সকলের এক মোহনায় দাঁড়ানোর উৎসব। যুগ যুগ ধরে এমন উদ্যোগ হয়ে উঠুক আপন আলোয় উদ্ভাসিত বাতিঘর।
হ্যাপি রহমান, সিডনি
|