bangla-sydney
bangla-sydney.com
News and views of Bangladeshi community in Australia












অবিস্মরণীয় অভিজ্ঞতা- হজ্ব ২০২৪
ড. ফেরদৌসী জাহান



লাব্বায়েক আল্লাহহুম্মা লাব্বায়েক।
লাব্বায়েক লা শারিকা লাব্বায়েক।
ইন্নাল হামদা, ওয়া নিয়া’মাতা
লা শারিকা লাক।

৮ই জিলহাজ ১৪ই জুন, শুক্রবার, সকাল ৭ টা। বাসের সবাই এই তালবিয়া পড়ছে। আমিও পড়ছি। গতকাল থেকে ভীষণ উত্তেজনায় সময় যাচ্ছে, নার্ভাস এবং ভয়ও লাগছে। বিশ্বাস হচ্ছে না, সত্যি কি মহান আল্লাহ আমাকে হজ্ব করার তৌফিক দিলেন। বাসে তালবিয়া পড়ার সময় বার বার আমার চোখ দিয়ে পানি পড়ছিল। সত্যি কি আমি মহান আল্লাহর দেখা পাব, মহান আল্লাহর কাছাকাছি যেতে পারবো! আমি কি শেষ করতে পারবো পবিত্র হজ্বের সব কাজগুলো।

পবিত্র কা’বা শরীফ তাওয়াফ করার সময়
আমাদের হিলটন হোটেল থেকে বাসে উঠলাম মিনার উদ্দেশ্যে। চারিদিকে শুনতে পারছি এই তালবিয়া/দোওয়া, সবাই পড়ছে, বাসে এবং রাস্তায়, যারা হেটে যাচ্ছে। সবার পরনে সাদা কাপড়ের এহরাম। কী যে অপূর্ব একটা দৃশ্য। তিনদিন আগে মক্কায় আসার পর, এই প্রথম আমি হোটেল এবং কাবা শরিফ ছেড়ে বাহিরে রাস্তায় এলাম। মক্কা শহরের উঁচু বড় বড় পাহাড়ের ধার ঘেঁসে ভিন্ন রকমের আর্কিটেকচারের বড় বড় বিল্ডিং। চওড়া সব রাস্তাগুলো, দু’ধার দিয়ে ফুটপাথ এবং ঘাসও আছে। কিছু কিছু খেজুর গাছ। মাঝে মাঝে টানেল। মক্কা থেকে মিনার দূরত্ব ১২ কিলোমিটার। রাস্তায় প্রচুর গাড়ী থাকার জন্য বাস ধীর গতিতে এগোচ্ছে।

মনে পড়ে সেই ৭-৮ মাস আগে থেকে এই হজ্বের প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। কত আলোচনা কত অনিশ্চয়তা, জল্পনাকল্পনা দিনের পর দিন, রাতের পর রাত। নুসুক ওয়েব পোর্টাল এর মাধ্যমে এখন হজ্বের সবকিছু হবে এবং এটা অস্ট্রেলিয়া, আমেরিকা এবং ইউরোপ এর দেশগুলোর জন্য। নভেম্বর মাসে আমরা প্রথম রেজিস্টার করি ‘নুসুক’ ওয়েব পোর্টালে। সেটাও করতে সময় লেগেছিল কয়েক সপ্তাহ। গত বছর যারা এখান থেকে হজ্বে গিয়েছিল, তাদের কাছে শুনে আরও ভয় বা দ্বিধা ছিল, হবে কি হবে না। আসলে এটা লটারির মতোই মনে হয়, যদিও এটা লটারি নয়। তবে ভাগ্য বলা চলে। সঠিক ভাবে রেজিস্ট্রেশন করা হলেও জানুয়ারিতে আমাদের বাংলাদেশে যাবার কথা ছিল। নুসুক ওয়েব পেজে কোন ইনফরমেশন নাই কবে ওরা প্যাকেজ খুলে দেবে। আর এটাও জানা যে যখন প্যাকেজ ছাড়বে, তখন সংগে সংগে সেটা ধরতে হবে। সেই থেকে আর এক ভাবনা শুরু হল, কারণ যদি তখন বাংলাদেশে থাকি, তাহলে এতগুলো টাকা ঠিক ভাবে পাঠানো যাবে কিনা। আমাদের দুইটা ব্যাংকে যেয়ে আলাপ করে সবকিছু ব্যবস্থা করে গিয়েছিলাম। তবে ভাগ্য ভাল, এখানে আসার পর মার্চে প্যাকেজ প্রথম খুলেছিল। তখন থেকে শুরু হলো, অফিস থেকে এসেই কম্পিউটারে বসা এবং প্যাকেজগুলো বিস্তারিত দেখা। কোন প্যাকেজে কোন হোটেল দিবে, সেই হোটেল থেকে কা’বা শরীফ কতদূর হবে, কোন তাঁবু থেকে জামারাত কাছে হবে ইত্যাদি অনেক কিছু ক্যালকুলেশন করে ৪-৫ টা প্যাকেজ লিস্ট করে রাখলাম। টাকার ব্যাপার তো আছেই, কিন্তু শুধু দুজনের শেয়ার করার মত রুম পেতে আরও দাম বেড়ে যায়। আমরা সব জায়গায় শুধু দুজনের শেয়ার রুম নিয়েছিলাম এবং সেইভাবে নুসুক পোর্টালে ই-ওয়ালেট এ পর্যাপ্ত পরিমাণে টাকা জমা দিয়ে রেখেছিলাম। হজ্বে যারা রেজিস্ট্রেশন করেছে সবার জন্য ‘টেলিগ্রাম’ এবং হোয়াটস এ্যাপ গ্রুপ ছিল, এবং সেখানে সবকিছু আপডেট হতো। সব সময় সেগুলোতে চোখ রাখতে হতো। অবশেষে জানা গেল ১৪ই মার্চ, সিডনি সময় রাত দুইটায় প্যাকেজ খোলা হবে। রাত দুইটায় কম্পিউটার অন করে ওয়েবসাইট এ ঢোকার চেষ্টা চলল, কিন্তু না ঢুকতেই পারা যাচ্ছে না। সারাটা সময় চোখ কম্পিউটারের স্ক্রিনে। ওই ভাবেই আমরা সেহেরীর সময় সেহেরী খেয়ে নিলাম। তারপর যখন ফজরের নামাজ পড়তে যাব, প্রায় ৬টা বাজে ঘড়িতে, তখন হেদায়েত ঢুকতে পারলো এবং আমাদের প্রথম পছন্দের প্যাকেজটা পেয়ে গেলাম তখনি। কী যে একটা শান্তি পেলাম আর মহান আল্লাহর কাছে শুকরিয়া আদায় করলাম, যখন কনফার্মেশন পেলাম। তারপর থেকে শুরু হলো হজ্বের প্রস্তুতি। ‘আল-বাইট’ গ্রুপে আমরা ছিলাম। আমাদের ওয়ার্কশপ হত, ওয়েবনার সেমিনার হত সপ্তাহে দুইবার। ধীরে ধীরে নিজেদেরকে তৈরি করছিলাম মানসিক, বাহ্যিক ও ধর্মীয় ভাবে।

আমাদের এই যাত্রা শুরু হয়েছিল ৮ই জুন, সিডনি থকে কুয়ালালামপুর গেলাম। ওখানে একরাত ‘মুভেনপিক’ হোটেলে ছিলাম, সেটা ছিল মালয়েশিয়ান সরকারের হজ্ব ক্যাম্প। বিশাল এলাকা জুড়ে অনেক বড় সেই হোটেল। তারপর ৯ই জুন, রাতে জেদ্দার উদ্দেশ্যে যাত্রা করি। রওনা হবার আগে সবাই এহরাম পরে নেয়। ১০ই জুন, সোমবার, সকাল ৭টার দিকে জেদ্দায় নামলাম। এয়ারপোর্টে ফর্মালিটি শেষ করে আমাদের জন্য নির্দিষ্ট বাসে উঠি, এবং সকাল ১১:৩০ টার দিকে আমরা হোটেল হিলটন এ পৌঁছেছিলাম। প্রথমে গ্রাউন্ড ফ্লোরে খেজুর এবং পানীয় দিয়ে আপ্যায়ন করেছিল। হোটেল হিলটন বলে কথা, অনেক বসার জায়গা এবং সুন্দর করে সাজানো। জানা গেল রুম পেতে দেরি হবে। একে একে আরও অন্যান্য
১০ই জুন প্রথম ‘সাঈ’ করার সময়
দেশ থেকে হজ্বের লোকজন আসতে লাগলো। আমাদের গাইড দুপুরে ২টার সময় ওমরাহ হজ্বে নিয়ে যাবে বললো। আমি ঠিক তৈরি ছিলাম না, এত দূর জার্নি করে ফ্রেশ না হয়ে প্রথম পবিত্র কাবা শরীফে যাব। তাই আমরা রাতে যাব ঠিক করলাম। কিন্তু তখন জানতাম না যে রুম পেতে এত দেরি হবে। যেখানে ৩-৪ টার মধ্যে রুম পাবার কথা, সেখানে ৬ টার সময় ‘আল-বাইট’ আমাদের সবাইকে ফর্মালি অভ্যর্থনা জানালো ফুল এবং খেজুর দিয়ে। তারপর রুমের চাবি দিল। আমরা হিলটন সুইট নিয়েছিলাম। সেইদিনই আমরা দুজনে দুটো ‘সিম কার্ড’ নিয়ে নিলাম, এবং যেহেতু আমি চেয়ারে নামাজ পড়ি, হোটেলের নীচে ‘বিন-দাউদ’ র দোকান থেকে আমার জন্য ছোট চেয়ার কিনে নিলাম। স্মৃতি হিসাবে সেই চেয়ারটা কষ্ট করে সাথে নিয়েও এসেছি। রাতে ডিনারের পর ১০টার দিকে আমরা প্রথম ওমরাহ করার জন্য বের হলাম। সাথে আমাদের গ্রুপের আরও কিছু মানুষ ছিল এবং আমাদের আর এক গাইড ভাই তারেক সাথে ছিল। পাশের কনরাড হোটেলের শেখ আবু বকরসহ আরও কতজন আমাদের সাথে গেল। প্রথম কাবা দেখার সেই অনুভূতি ভাষায় প্রকাশ করার মত না। আমার তো পায়ের হাঁটুতে ব্যথা, যাবার ১০ দিন আগে করটিজন ইনজেকশন নিয়ে গেছি। আমার গাইড তাই মানা করেছিল রিস্ক না নিতে। কিন্তু আমার মন মানেনি। যে কাবা’র দিকে ফিরে আমরা পৃথিবীর সবাই নামাজ পরি, আর টিভিতে কত দেখেছি হজ্বের সময় কিভাবে কত মানুষ কাবা’র চারিদিকে তাওয়াফ করে। আমি একবার অন্তত সেটা অনুভব করতে চাই। আল্লাহর রহমে ঠিক ভাবেই তাওয়াফ সম্পন্ন করতে পেরেছিলাম। তবে সাঈ করার সময় হুইল চেয়ার নিতে হয়েছিল। সেদিন হোটেলে ফিরলাম রাত তখন ২:৩০ টা।

১১ই জুন, আমরা আসরের নামাজের সময় কা’বা শরীফে গিয়েছিলাম। কা’বা এখন অনেক বড় করেছে, এখন একসঙ্গে প্রায় তিন মিলিয়ন লোক নামাজ পড়তে পারে। সেদিন আমরা যেটা এক্সটেনশন করেছে, সেখানে নামাজ পড়েছি, কোরান পাঠ করেছি। ১২ই জুন, আমরা তাহাজ্জুদ পরার জন্য রাত ২:৩০ টায় কাবা’য় যাই। সেদিনও ফজরের নামাজ শেষে আবার আমরা তাওয়াফ করি। আল্লাহর কাছে লাখ শুকরিয়া আদায় করলাম দুইদিন নিজে পবিত্র কা’বা তাওয়াফ করতে পারায়। তখন অনেক গরম, তাপমাত্রা ৪৫ থেকে ৫০ ডিগ্রী পর্যন্ত উঠেছে। তাই দুপুরে আমরা হোটেলের নামাজের রুমে নামাজ পরতাম। কাবা’র ইমামের সাথে জামাতে নামাজ পড়া হত। মাগরিব এবং এশার নামাজ নীচে যেয়ে, কাবা’র চত্বরে পড়তাম। বিশাল সেই প্রাঙ্গণ ভরে যেত সব সময়। সেখানেও জায়গা পাওয়া মুশকিল হত। আমি অবাক হয়ে মানুষের ঢল দেখতাম আর ভাবতাম এই কাবাকে ঘিরে সারা পৃথিবীর মানুষের ভালবাসার কথা। এই তীব্র গরমে কেউ পিছপা হচ্ছে না। সবাই এই প্রখর রৌদ্রের মাঝেই ছুটে চলেছে পবিত্র কাবার দিকে। কিসের টানে, ছোট বড়, ধনী গরীব, পৃথিবীর নানা দেশ থেকে সবাই এসেছে এবং একই সাথে হেটে চলেছে একই পথ দিয়ে। কোন ভেদাভেদ নেই। আমার কথা বলতে গেলে আমিও কিভাবে অভিভূত হয়ে গিয়েছিলাম। যখন হোটেলের রুমে শুয়ে থাকতাম, অথবা রাতে ঘুম ভেঙ্গে গেলে মনে হত কা’বা আমাকে ডাকছে।

১৩ই জুন থেকে ভীষণ উত্তেজনা, নার্ভাস ও এক ধরনের ভীতিও কাজ করছিল। আগামীকাল থেকে হজ্ব শুরু। রাতে সব কিছু গুছিয়ে নিলাম মিনায় যাবার জন্য। সকাল ৭ টায় ব্রেকফাস্ট করে সবাই বাসে উঠলাম। এই প্রথম বের হওয়া মক্কার পথে। দুই/আড়াই ঘণ্টা লেগেছিল মিনায় পৌছাতে। সে এক অপূর্ব দৃশ্য, হাজার হাজার সাদা তাঁবু চারিদিকে, বিশাল জায়গা নিয়ে। এমনকি আমাদের ড্রাইভারকে বেগ পেতে হল, আমাদের জন্য নির্ধারিত “আল-কাবাশ” তাঁবু খুঁজতেই আধা ঘণ্টা চলে গেল। যাহোক, আমাদের ক্যাম্পের খুব সুন্দর ব্যবস্থা ছিল। সারি সারি বিরাট একেকটা তাঁবু। আমাদের বড় একটা তাঁবুর মাঝে পার্টিশন দিয়ে, দুই পাশে ২৫ জন করে মহিলা ছিলাম, তার মধ্যে আমরা তিনজন বাংলাদেশী ছিলাম। তাঁবুগুলো শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত এবং পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন, প্রত্যেকের জন্য ছিল সোফা বেড। বিশাল ডাইনিং এরিয়া আর একটা তাঁবুতে। প্রচুর খাবার, বুফে সিস্টেম, নানা ধরনের পানীয়, ফল-মুল এবং বিভিন্ন জাতীয় খাবার ছিল। যাবার আগে বাথরুম নিয়ে অনেক কিছু শুনেছিলাম, তাই একটা ভয় ছিল। কিন্তু আমাদের ক্যাম্পে বাথরুম নিয়ে সমস্যা ছিল না। অনেক বেশী লাইনও ধরতে হয়নি, শুধু কিছু কিছু সময় ছাড়া। ২৪ ঘণ্টা ক্লিনার থাকত এবং প্রয়োজনমত পরিষ্কার করে দিত। একটা অসুবিধা একবার নিজের তাঁবু থেকে বের হলে ঠিকভাবে ফিরে আসা। কারণ সব গুলো একি রকম দেখতে, তাই দরজার উপরের নাম্বারটা ফটো তুলে রেখেছিলাম মনে রাখার জন্য। তবুও অনেক সময় ঘোরাঘুরি করে নিজের ক্যাম্প বের করতে হয়েছে। তাঁবু ছাড়া বাকী খোলা জায়গাগুলোতে কৃত্রিম ঘাস লাগানো ছিল। গরমের জন্য উপর থেকে পানির বাষ্প ছাড়া হতো। অনেকে খাবার নিয়ে সুন্দর সবুজ সেই ঘাসের উপর বসে খেত।

পরের দিন, অর্থাৎ ১৫ই জুন, ৯ই জিলহাজ, ফজরের নামাজ পরে, আরাফাত এবং মুজদালিফা’র জন্য ছোট ব্যাগ গুছিয়ে নিলাম। সকাল ৭;৩০ মিনিটে হাই স্পীড ট্রেনে তালবিয়া পরতে পরতে ‘আরাফাত’ রওনা হলাম। হেটে মিনা ষ্টেশন প্রায় ১০ থেকে ১৫ মিনিটের পথ। চারিদিকের জনসমুদ্র দেখে কেমন যে লাগতো, সবার পরনে সাদা পোশাক, এহরাম। আরাফাত ষ্টেশন থেকে আবার ১৫-২০ মিনিটের মত হেটে আরাফাত ক্যাম্পে পৌঁছলাম সাড়ে দশটার দিকে। আরাফাত ক্যাম্পও ঠিক মিনার মত সব সুযোগ সুবিধা ও খাওয়া দাওয়া ছিল। সেদিনও সেই অনেক বেশী তাপমাত্রা ৪৫ ডিগ্রী। সবাই বেশীর ভাগ সময় তাঁবুতে কাটিয়েছে। আমার খুব ইচ্ছা করছিলো সেই আরাফাত পাহাড়ের কাছে দেখতে যাওয়া, কিন্তু সম্ভব ছিল না। পরে খবরে শুনেছি ওখানেই সারাদিনে অতিরিক্ত গরমে মানুষ মারা গিয়েছে। বিকেলের দিকে আমি তাঁবুর বাহিরে এসে মাঠে দাঁড়িয়ে আল্লাহর কাছে দোওয়া করেছি। আরও অনেক মানুষ বাহিরে এসে পরম করুণাময় আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করেছে। সেইদিন আমি মোনাজাত শেষে, বাহির থেকে যখন ফিরবো আমাদের তাঁবুতে, তখন খুঁজে পাচ্ছিলাম না। এদিকে তখন দিনের...



৯ই জিলহাজ সুযার্স্তের সময় আরাফাত ষ্টেশনে, মুজদালিফার ট্রেন ধরার অপেক্ষায়

শেষে আরাফাত থেকে আমাদের চলে যাবার কথা। হেদায়েত আমার ফোনে আমাকে পাচ্ছে না, কারণ সেই সময়েই আমি ফোনটা ভুলে রেখে এসেছিলাম। কী যে একটা টেনশন গেছে। শেষে কয়েকজনকে জিজ্ঞাসা করার পরে পেলাম আমাদের তাবু। তখন সবাই বের হয়ে গেছে, হেদায়েত আমার ব্যাগ নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। এত বেশী টায়ার্ড হয়েছিলাম যে তখন আর হেঁটে ষ্টেশনে যেতে পারিনি, হুইল চেয়ারে যেতে হয়েছে, হেদায়তকে ঠেলতে হয়েছিল। যাহোক আমরা সূর্যাস্তের আগেই ষ্টেশনে পৌঁছলাম। সূর্য-মামা তখন বিদায় বেলায় পুরা আকাশ রাঙ্গিয়ে দিয়েছে। মুজদালিফা পৌঁছে আবার ১০-১৫ মিনিট হেঁটে আমরা আমাদের জন্য বরাদ্দকৃত জায়গায় এলাম।

এই সেই মুজদালিফা’র উন্মুক্ত মাঠ, খোলা আকাশের নীচে রাত্রি যাপন। আগে অনেক জল্পনা-কল্পনা ছিল এটা নিয়ে, কেমন লাগবে, কিভাবে থাকবো রাতটা। আমেরিকা ইউরোপ এবং অস্ট্রেলিয়ার হাজীদের একই জায়গায় রাখা হয়েছিল। কার্পেট পাতা ছিল পুরা জায়গায়। পাশেই পার্টিশন দিয়ে পুরুষদের থাকার ব্যবস্থা। নিয়ম অনুযায়ী আমরা এসেই মাগরিব এবং এশার নামাজ একসাথে পরে নিলাম। তখন হয়তো রাত ৯ টা হবে। আমাদের একটা করে গিফট ব্যাগ দিয়েছিল। ঘুমাবার জন্য ম্যাট, চোখের মাস্ক, ছোট্ট পাথরের ব্যাগসহ আরও টুকটাক জিনিষ। আমরা নিজেরাও ম্যাট কিনেছিলাম। আমরা বাঙ্গালী চারজন পাশাপাশি একটা জায়গা নিয়ে নিলাম। আমাদের সাথে কিছু স্ন্যাক ছিল, সেগুলো খেয়ে শুয়ে পরলাম খোলা আকাশের নীচে। আমরা যখন আসি তখন মাত্র অল্প কিছু গ্রুপ এসেছিল, পরে রাত বারটা-একটা পর্যন্ত অনবরত অন্যান্য গ্রুপের হাজীরা এসে পুরা জায়গা ভরে গিয়েছিল। অনেকে নামাজ পড়ছে, অনেকে আবার ঘুমিয়ে গেল। আমি ঘুমাতে পারিনি। নীচ থেকে মাটির গরম উঠে আসছিল কার্পেট ভেদ করে। তাই বেশীরভাগ সময় হুইলচেয়ারে বসে ছিলাম। মাত্র ৩-৪ ঘণ্টা সময়। তারপর তো উঠে বাথরুমে ফ্রেশ হয়ে, অজু করে তাহাজ্জুদ এবং ফজরের নামাজ পরে আবার ষ্টেশনের দিকে রওনা হলাম। তখন প্রায় ৪ টা বাজে। আমাদের গাইডকে অনুসরণ করে ভিড়ের মধ্যে হাঁটা কষ্টকর ছিল। মুজদালিফা ষ্টেশনে পৌঁছলাম ৫ টার পরপর। আবারও সেই হাই-স্পীড ইলেকট্রিক ট্রেনে জামারাত ষ্টেশনে নামলাম। ট্রেনে লাগলো ১৫-২০ মিনিট সময়। আবার একই দৃশ্য, হাজার হাজার মানুষ একই দিকে অগ্রসর হচ্ছে, জামারাতে শয়তানকে পাথর মারার জন্য, সাদা কাপড় পরিহিত সবাই। অনেকে হেঁটে আসে মুজদালিফা থেকে জামারাত, প্রায় ৬-৭ কিলোমিটার পথ। আমরা বড় শয়তানকে ৭টি করে পাথর মেরে বাহিরে চলে এলাম। এখন জামারাতে যাওয়া এবং আসার পথ আলাদা করে দিয়েছে, তাই আগের মত আর ঝামেলা হয় না, ঠেলাঠেলি একটু কম হয়। আমরা ভালভাবে আবার মিনায় হেঁটে চলে আসলাম, শুধু ১০ মিনিটের মত হাঁটা। আর একটা ব্যাপার খেয়াল করলাম, সৌদি সরকার পরিষ্কার পরিচ্ছন্নের দিকে নজর দিয়েছে। সব রাস্তায় চোখে পড়ল পরিচ্ছন্ন কর্মীরা বড় বড় ব্যাগ নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে এবং ময়লা-আবর্জনা পরিষ্কার করছে।


১০ই জিলহাজ ভোরে ষ্টেশন থেকে হেটে জামারাতে শয়তানকে পাথর মারতে যাওয়ার দৃশ্য

মিনায় ফিরে এত টায়ার্ড লাগছিল যে ভাবলাম আজ মক্কায় ফিরে না যেয়ে কাল যাব। কেবল একটু বিশ্রাম করছিলাম, ইতিমধ্যে হেদায়েত ফোন করে বললো এখনি বাসে করে আমাদেরকে নিয়ে যাবে মক্কায়। যেহেতু আমাদের হোটেল হিলটনে রুম রিজার্ভ করাই ছিল এবং সব জিনিষ পত্র, কাপর চোপড় ওখানে ছিল, তাই আবার তাড়াতাড়ি তৈরি হয়ে রওনা হলাম মক্কার উদ্দেশ্যে। সেদিনও বাস দাঁড়িয়ে ছিল দূরে, হেটে যাবার মত শক্তি ছিল না। আল্লাহর অশেষ রহমতে, ক্যাম্পের একজন কর্মীকে পেয়ে গেলাম যে কিনা হুইল চেয়ার ঠেলে নিতে রাজী হল। হোটেলে ফিরে নিয়ম অনুযায়ী হেদায়ত মাথা ও দাঁড়ি শেভ করতে গেল। তারপর আমরা ফ্রেশ হয়ে খাওয়া সেরে যোহরের নামাজ পড়ে কা’বায় গেলাম হজ্বের তাওয়াফ করার উদ্দেশ্যে। এত বেশী টায়ার্ড ছিলাম, সেদিন আমাকে ‘তাওয়াফ’ এবং ‘সাঈ’ হুইলচেয়ারে করতে হয়েছে। যাকে ঠিক করেছিলাম বেশ ভাল লোক ছিল। রাত ৮টায় আমাদের বাস নিয়ে যাবে মিনায়। কিন্তু প্রচণ্ড ভিড়ের কারণে কা’বার গেটগুলো একেক সময় একেকটা বন্ধ করে দেয়। তাই যখন আমরা কা’বা থেকে বের হলাম প্রায় ৮টা বাজে তখন। আমি সরাসরি হোটেলে এসে বাসে উঠলাম, হেদায়েত রুমে যেয়ে ব্যাগ নিয়ে এল। মিনায় এসে বাস আমাদেরকে একটু দূরে নামিয়ে দিল, রাস্তা বন্ধের কারণে। শরীর যেন আর চলছিল না। সেই রাতে প্রায় ২০-২৫ মিনিট হাটতে হল ক্যাম্পে আসতে। আসার সময় দেখতে পেলাম কত মানুষ ক্যাম্পের বাহিরে রাস্তায় শুয়ে আছে। আমরা তো এসে শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত তাঁবুতে ঢুকলাম, আর ওরা এত গরমে রাস্তায় কাপড় বিছিয়ে শুয়ে আছে কেমন করে! হয়তোবা তাদের নাই তেমন থাকার জায়গা! শুনেছি আশপাশের দেশগুলো থেকে অনেকে এভাবে আসে, টাকাপয়সা না থাকাতে ঠিকভাবে থাকা-খাওয়ার ব্যবস্থা করতে পারে না, তবু তারা হজ্ব করতে আসে।

পরেরদিন, ১৭ই জুন, ১১ই জিলহাজ, পাথর মারতে জামারাতে যেতে হবে। সৌদি সরকার ঘোষণা দিয়েছে, অতিরিক্ত গরমের কারণে, বিকেল ৫টার আগে কেউ যেন বাহিরে না যায়। আল্লাহর রহমত, হঠাৎ করে ৪টার দিকে এক পশলা বৃষ্টি হয়ে গেল। তীব্র দাবদাহ একটু উপশম হলে, আমরা ৬ টার দিকে জামারাতে পাথর মেরে আসলাম। যেহেতু অল্প সময় তাই সেদিন একটু বেশী ভিড় ছিল। পরেরদিন অর্থাৎ ১৮ই জুন, আমরা পাথর মেরে সূর্যাস্তের আগে মক্কায় চলে এলাম বাসে করে। আলহামদুলিল্লাহ সুস্থ থেকে পবিত্র হজের সবকিছু সম্পন্ন করতে পেরেছি, কি যে প্রশান্তি এলো মনে। মহান আল্লাহ আমাদের হজ্ব কবুল করুন, আমিন।

১৯শে জুন আমরা মক্কায় ছিলাম, আশেপাশে ঘুরেছি আর সামান্য কিছু কেনাকাটা করেছি। ২০ জুন সকালে ফজরের পরে ‘বিদায় তাওয়াফ’ করেছিলাম। তখন শরীর অনেক ক্লান্ত, তাই আমি হুইলচেয়ারে তাওয়াফ করবো এমন প্লান ছিল। কিন্তু ব্যবস্থা করতে পারিনি, আর এত বেশী ভিড় ছিল যে, আমরা ভিতরে যখনি যাচ্ছি, এমন ভাবে সব গেট বন্ধ করেছে যে, আমরা একেবারে ছাদ ছাড়া কোথাও ঢুকতে পারিনি। সেদিন খুব কষ্ট হয়েছিল, তবে আল্লাহর অশেষ রহমতে শেষ পর্যন্ত ৭ বার তাওয়াফ করতে পেরেছিলাম এবং সেদিন যে গেট দিয়ে বের হতে হয়েছিল, সেখান থেকে ৫ মিনিটের পরিবর্তে ৩০মিনিট হাঁটতে হয়েছিল আমাদের হোটেল এ পৌঁছাতে। আজ ভাবতেও অবাক লাগে, কি ভাবে পেরেছিলাম সেদিন, কোন অঘটন যে ঘটেনি, আল্লাহর কাছে শুকরিয়া।


২০শে জুন, ছাদে বিদায় তাওয়াফ করার সময়

এরপর সেদিন দুপুরে আমাদের পবিত্র মদিনায় যাত্রা। বাসে করে আমাদের ষ্টেশনে নিয়ে গেল। আমাদের বড় লাগেজগুলো আলাদাভাবে পাঠানো হয়েছিল, তাই আমাদের টানতে হয় নাই। আমরা হাই-স্পীড ট্রেনে মদিনার পথে রওনা হলাম। মদিনাতে পৌঁছে মনটা শান্তিতে ভরে গেল। আমরা হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টাল এ ছিলাম। আমাদের রুমের জানালা দিয়ে ঐতিহাসিক ওহুদ পাহাড়টা দেখা যেত। মাত্র ৫-৭ মিনিটের হাঁটা পথ ছিল আমাদের প্রিয় নবীজীর মসজিদ “মসজিদ-ই-নববী”। এত বিশাল আর এত সুন্দর, সেখানে গেলেই মনটা আবেগে আপ্লুত হয়ে পড়ে। এর ভিতরে শায়িত আছেন দুইজন খলিফা সহ আমাদের প্রিয় নবীজী হযরত মোহাম্মদ (সাঃ)। ভিতরে শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত, কিন্তু বাহিরে সেই একি গরম, তাপমাত্রা ছিল ৪৫-৫০ ডিগ্রী। তবে বাহিরের বিশাল প্রাঙ্গণ ভোর বেলা থেকে বড় বড় ছাতা দিয়ে ঢাকা থাকে, আবার সূর্যাস্তের আগে ছাতাগুলো বন্ধ হয়ে যায়। মদিনাতে ‘কিবলাতিন মসজিদ’ (যেখানে নবীজী প্রথম কিবলা মুখি হয়ে নামাজ পরার আদেশ করেন), কুবা মসজিদ (যেটা ইসলামের ইতিহাসে প্রথম মসজিদ) এবং ওহুদের মসজিদ – সবগুলোতে আল্লাহর রহমে নামাজ আদায় করতে পেরেছিলাম। বিশেষ করে মসজিদ-ই-নববীতে ‘দি রাওদাহ’ (the Garden of Paradise) তে নামাজ আদায় করার সৌভাগ্য হয়েছিল। মদিনা থেকে ২৩ শে জুন বিকেলে ট্রেনে আমরা জেদ্দার উদ্দেশ্যে রওনা হই। হজ্বের প্রতিটি পদক্ষেপে আল্লাহর রহম পেয়েছি, এজন্য আল্লাহর কাছে লাখ শুকরিয়া। আবার যেন এই পবিত্র ভূমিতে আসতে পারি এই দোওয়া আল্লাহর কাছে, আমিন।




ড. ফেরদৌসী জাহান, ক্যাসেল হিল, সিডনি




Share on Facebook               Home Page             Published on: 4-Oct-2024

Coming Events: