চন্দ্র-বিজয়ঃ কিছু স্মৃতি মোহাম্মদ আব্দুর রাযযাক
১৯৬৯ এর ২০ জুলাই, রোববার। আমি তখন ফোর্ড-ফাউন্ডেশনের বৃত্তি নিয়ে ইন্ডিয়ানা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিজনেস স্কুলে এম বি এ ডিগ্রীর জন্য পড়াশুনা করছি। সে বছরই ফেব্রুয়ারি মাসে পড়াশোনা শুরু করেছি; ক’দিন আগেই প্রথম সেমেষ্টার শেষ হয়েছে। এর মধ্যে দেশ থেকে নববিবাহিতা স্ত্রী নাসিম এসে যোগ দিয়েছেন তাই ইচ্ছে করেই সামার স্কুলে যোগ দিই নাই। কদিন পর দু’জন মিলে বিশ্বব্যাংকে কর্মরত চাচা শ্বশুরের বাড়ী ওয়াশিংটন বেড়াতে যাবার কথা। কিন্তু তার আগে একটা কাজ করতে হবে-বন্ধুদের অনুরোধ আমাদের বউ-ভাতের অনুষ্ঠান আয়োজন করতে হবে!
নিশ্চয়ই ব্যাপারটা বুঝতে একটু খটকা লাগছে, তাই না? আসলে হয়েছে কি ৬৯ এর গণঅভ্যুত্থানের ডামাডোলের মাঝখানে ২৩ জানুয়ারি আমাদের বিয়ে হয়েছে ঠিকই, কিন্তু বউ-ভাত আর হতে পারেনি। ক্লাস শুরু হবে বলে আমাকে একাই আমেরিকা চলে আসতে হয়েছে। যেহেতু একই প্রোগ্রামের আওতায় পড়তে আসা বাকী চারজন বন্ধুরা এটা জানতেন, তারা আবার আমাদের আগে পড়তে আসা পুরনো বন্ধুদেরকে ব্যাপারটা জানিয়েছেন। এখন সবাই মিলে বায়না ধরেছেন বউ-ভাত খাবেন।
একই প্রোগ্রামে পড়তে আসা আমার সহপাঠী বন্ধু জনাব খলিলুর রহমান খান (প্রয়াতঃ) খুবই ভালো রাঁধুনি। শিক্ষক এবং দেশী বিদেশী বন্ধু মিলে প্রায় একশত অতিথিকে নিমন্ত্রণ করা হল। খান সাহেব একহাতেই এতজন অতিথির জন্য বিরিয়ানি, রেজালা, সালাদ এবং ফিরনী রান্না করলেন। আমরা ক’জন আগের রাত থেকে বেশ কিছু কাজ আগিয়ে রাখলাম। ২০ জুলাই সকাল আটটার দিকে রান্না শুরু করলেও হাড়ি-কুড়ির স্বল্পতা এবং আনুষঙ্গিক বিভিন্ন কারণে রান্না শেষ হতে একটু দেরী হয়ে গেল। অতিথিরা বারোটার দিকে এসে গেলেও বেলা একটার আগে কোনমতেই খাবার পরিবেশন করা গেল না। আমাদের প্রোগ্রাম কো-অর্ডিনেটর প্রফেসর জোসেফ ওয়াল্ডম্যান তাড়া দিলেন “রাযযাক, জলদী খানা লাগাও, আজকে চারটার দিকে যে এপোলো ১১ চাঁদে নামবে; দেখার জন্য তাড়াতাড়ি বাড়ি যেতে হবে না”?
আরে তাইতো; আমরা তো ব্যাপারটা ভুলেই গিয়েছিলাম। তাড়াহুড়ো করে খাবার লাগানো হলো। আমাদের মেক্সিকান বন্ধু আল্ভারেজ তার গিটারে মোহময়ী সুর তুলে খাবার আনন্দ আরো বাড়িয়ে তুললো। বেলা তিনটের মধ্যে খাওয়া দাওয়া শেষ হলো। আমরা বলা যায় অনেকটা যেনতেন ভাবে হল গুছিয়ে রেখে যখন বাসায় এলাম তখন চারটা বেজে গেছে। টেলিভিশন খুলতেই দেখি এপোলো ১১ মিশন সম্বন্ধে বিভিন্ন তথ্য দেয়া হচ্ছে। প্রায় সোয়া চারটার দিকে নভোচারী নীল আর্মস্ট্রং চাঁদের বুকে পা রাখলেন আর বললেন ‘একজন মানুষের জন্য এটা একটা ছোট্ট পদক্ষেপ, কিন্তু গোটা মানবজাতির জন্য এটা বিরাট একটা লাফ’। এদিক ওদিক থেকে ছাত্রছাত্রীদের সম্মিলিত আনন্দোল্লাস, আর কিছু আতশবাজির শব্দ শোনা গেল। একই সঙ্গে কারা যেন অনেকগুলো গড়ির হর্ণ বাজিয়ে চলে গেল। কি আনন্দ, কি অনির্বচনীয় অনুভূতি! প্রথম মানুষ হিসেবে আর্মস্ট্রং এর চাঁদে পদার্পণ করবার প্রায় ২০ মিনিট পর দ্বিতীয় মানব হিসেবে চাঁদের বুকে নেমে এডউইন বাজ অল্ড্রিন। ৩৫০০০ জনবসতির বিশ্ববিদ্যালয়-শহর ব্লুমিন্টনের এভারম্যান এপার্টমেন্টের ছোট্ট এক কামরার বাসায় বসে তৃতীয় বিশ্বের এক গরীব দেশের দুই তরুণ-তরুণী হাত ধরাধরি করে অবাক, বিস্ফারিত চোখে মানুষের চন্দ্র-বিজয় দেখলাম।
সপ্তম বা অষ্টম শ্রেণীতে পড়ার সময় বাবা আমাকে সাহিত্যিক জুল ভার্নের লেখা “ফ্রম দি আর্থ টু দি মুন” নামে একটি কল্পকাহিনীর বই কিনে দিয়েছিলেন। সেই বইয়ে বলা হয়েছিল কেমন করে একটি নভোযান আমেরিকার ফ্লোরিডা থেকে রওয়ানা হয়ে চাঁদে পৌঁছায় এবং অভিযান শেষে প্রশান্ত মহাসাগরে অবতরণ করে। বাংলা মাধ্যমে লেখাপড়া করা মফঃস্বল শহর নারায়ণগঞ্জের কিশোর আমার জন্য সেই কাহিনী ভালোভাবে বুঝতে পারা সহজ ছিলনা; তবু অত্যন্ত ধৈর্য সহকারে সেই বইটি পড়ে ভেবেছি “এও কি কখনো সম্ভব?” তার দশ/এগারো বছর পর টেলিভিশনের সামনে বসে নীল আর্মস্ট্রং আর বাজ অল্ড্রিনের চাঁদে নামা দেখে মনে হয়েছে “যা দেখছি তা কি আসলেই সত্যি” ।
মোহাম্মদ আব্দুর রাযযাক, সিডনি
|