চন্দ্রে অবতরণ – আমার অনুভূতি মোস্তফা আব্দুল্লাহ
এখন থেকে পঞ্চাশ বৎসর আগে মানুষ যখন প্রথম চন্দ্রে অবতরণ করে সে সময়টাতে আমার বয়স ছিল বাইশ। বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রায় শেষ পর্যায়ে ছিলাম – যদিও ততদিনে বিশ্ববিদ্যালয়ের পাট শেষ হয়ে যাওয়ার কথা, সেশন জটের করনে হয়ত বা আরও বছর খানেক বা দুয়েক বাকি ছিল। কারো অনুমান করতে খুব একটা বেগ পাওয়ার কথা না যে আজ এই বাহাত্তর বৎসর বয়সে - বাইশ বৎসরের এক যুবকের মনে কে কোথায় কবে চাঁদে অবতরণ করেছিল আর তা নিয়ে তার কি অনুভূতি হয়েছিল - মনে করতে পারাটা কতটা দুষ্কর। তার পরেও এটি কারো জীবদ্দশায় ঘটে যাওয়া এমন একটি ঐতিহাসিক ঘটনা যে স্মৃতি হাতরিয়ে অন্তত কিছুটা বের করা যাবে না, তাও বোধ হয় গ্রহণ যোগ্য নয়।
আমার বিশ্বাস চন্দ্র অভিযানের ওই কটা দিন সমগ্র পৃথিবীর প্রায় সমস্ত মানুষই ধর্ম, গোত্র ও বর্ণ নির্বিচারে যে ভাবে তিন নভোচারীর মঙ্গল কামনায় প্রার্থনা করে ছিলেন, তেমন ঘটনার নজির পৃথিবীর ইতিহাসে আর আছে কিনা আমার জানা নাই। শুনেছি যারা সরাসরি সম্প্রচার দেখছিলেন তাদের অনেকেরই নাকি হৃদকম্পন বন্ধ হওয়ার উপক্রম হয়েছিল, যখন মাত্র কয়েক সেকেন্ডের জন্য নভোযানের সাথে Control Centre এর যোগা যোগ বন্ধ হয়ে গিয়েছিল ও আবারও একই পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছিল, যখন চন্দ্র অবতরণের আগ মুহূর্তে অবতরণ-যানের জ্বালানী ফুরিয়ে যাওয়ার উপক্রম হয়েছিল। পরবর্তী জীবনে এই ঘটনাটি Power of Prayer এর ওপর আমার আস্থাকে আরও মজবুত করতে সহায়ক হয়।
চন্দ্র অভিযানের সাফল্য একদিনে আসে নাই । অনেক চড়াই উতরাই, ঘাত প্রতিঘাত ও কিছু নভোচারীর জীবন উৎসর্গের বিনিময়ে এই অর্জন । কেবল মাত্র বর্তমান সময়ের অভিযানকারীদের প্রচেষ্টা ও আত্মত্যাগের কথা বললে সম্ভবত ভুল হবে – কেননা এর শুরু যেদিন থেকে মানুষের মনে পাখির মত আকাশে ওড়ার বাসনা জন্মে ছিল বা তারও আগে থেকেই । আর তাই এ বিজয়কে কোন বিশেষ জাতীর একক বিজয় হিসেবে দেখলে ভুল হবে বলে আমারও বিশ্বাস ।
নিঃসন্দেহে চন্দ্র অভিযানের ফলশ্রুতিতে জ্ঞান বিজ্ঞানের চর্চা বহু গুনে ত্বরান্বিত হয়েছে। মানুষের কল্যাণে যেমন বহু কিছু আবিষ্কার বা উদ্ভাবন করা সম্ভব হয়েছে, তেমনি মানব সভ্যতার সব অর্জনকে ধ্বংস করার উপকরণ সমূহের উদ্ভাবনেও পিছিয়ে নাই। তদানিন্তন পূর্ব পাকিস্তানে টেলিভিশন সম্প্রচার শুরু হয়েছিল ১৯৬৪ সালে। অর্থাৎ চন্দ্র অবতরণের বছর পাঁচেক আগেই। তবে চন্দ্র অবতরণ সরাসরি সম্প্রচার করা হয়েছিল কিনা মনে করতে পারছি না। অবতরণের ছবি সমূহ পরে প্রদর্শিত হয়েছিল সেটা মনে পড়ে। আমার ব্যক্তিগত অনুভূতি আর দশ জনের মতই ছিল – আনন্দিত হয়েছিলাম বিজ্ঞান ও মানুষের এই জয় যাত্রায়, মনে হয়েছিল সৎচেষ্টায় মানুষের অসাধ্য কিছু নাই। তবে বয়স বাড়ার সাথে সাথে এই অনুভূতিরও কিছুটা পরিবর্তন ঘটেছে, সৎচেষ্টার পাশাপাশি কোন এক অদৃষ্ট শক্তির আশীর্বাদেরও প্রয়োজন আছে বলে মনে হয় – আর তা না হলে সব সৎচেষ্টাই সফলতা পায় না কেন?
আগেই বলেছি তখন বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়ন করি, পড়ার বিষয় ছিল পদার্থ বিদ্যা, তাই চন্দ্র অভিযানের বৈজ্ঞানিক খুঁটি-নাটি কিছু না বুঝতে পারলেও ভাব করতে হয়েছে যে, ও কিছু না – চন্দ্র অবতরণ তো আমাদের মত বিজ্ঞানের ছাত্রদের কাছে একটা সাধারণ বিষয় মাত্র! আর মনে মনে এই ভেবে পুলকিত হয়েছি যে এই চন্দ্র অবতরণের ফলশ্রুতিতে বিজ্ঞান বিষয়ক কর্মকাণ্ডের এমন বিপুল প্রসার ঘটবে যে আমার মতন পদার্থবিদ্যার ছাত্র-ছাত্রী দের গবেষণা বৃত্তি নিয়ে যুক্তরাষ্ট্র যাওয়া ঠেকায় কে? বিজ্ঞান বিষয়ক কর্মকাণ্ডের সীমা হীন প্রসার ঠিকি ঘটেছে, তবে আমার কপালে এ দিক থেকে কোন মেওয়া ফলে নাই – সে আরেক কথা।
আরেকটা কথা চুপি চুপি বলে রাখি – জনসমক্ষে বলবেন না কিন্তু। আমিও অনেকের মতই তখন রাতের আকাশের দিকে মাঝে মধ্যে তাকিয়ে খুঁজতে চেষ্টা করেছি চাঁদের গায়ে চন্দ্রযান টিকে অবতরণের করার সময় দেখা যায় কিনা!
Michael Collins | এটা আমার আর একটা ভিন্ন উপলব্ধি, যদিও অনেক পরের। Apollo 11 mission এর অভিযাত্রী ছিলেন তিন জন Commander Neil Armstrong, lunar module pilot Buzz Aldrin ও command module Columbia এর পাইলট Michael Collins. এর মধ্যে প্রথম দুইজন চন্দ্রে অবতরণ করেন আর Michael Collins চন্দ্র প্রদক্ষিণ করতে থাকেন যাতে করে সময় মত অন্য দুইজনকে তুলে নিয়ে পৃথিবীর বুকে ফিরে আসতে পারেন। এদের তিনজনের কারো অবদানই কারো থেকে খাটো নয়। তথাপি পরবর্তীতে Neil Armstrong ও Buzz Aldrin যে পরিমাণ প্রচার ও সুখ্যাতি পেয়েছেন সে তুলনায় Michael Collins এর অর্জন অনেকটাই কম বলে আমার মনে হয়েছে। এটাই বোধ হয় নিয়তি – এক যাত্রায় ভিন্ন ফল।
মোস্তফা আব্দুল্লাহ, সিডনি
|