চাঁদ বিজয়ের ৫০ বছর মাসুদ পারভেজ
ছোট বেলায় ঘুমানোর সময়ে আমরা অনেকেই মায়েদের কাছ থেকে শুনেছি –
আয় আয় চাঁদ মামা টিপ দিয়ে যা চাঁদের কপালে চাঁদ টিপ দিয়ে যা। ধান ভানলে কুঁড়ো দেব মাছ কাটলে মুড়ো দেব কাল গাইয়ের দুধ দেব দুধ খাবার বাটি দেব চাঁদের কপালে চাঁদ টিপ দিয়ে যা।
চাঁদ বিজয়ের ৫০বছর পূর্তিতে, চাঁদ সম্পর্কিত সংগৃহীত কিছু অজানা (হয়তো অনেকের কাছেই) তথ্য নিয়ে আজকের লেখা –
১. চাঁদের সৃষ্টি - আজ থেকে ৪.৫বিলিয়ন বছর আগে সোলার সিস্টেম গঠিত হওয়ার পরে অনেকটা মঙ্গল গ্রহের মত আকৃতির একটি শিলা পৃথিবীর সাথে সজোরে সংঘর্ষ হওয়ার ফলেই চাঁদের সৃষ্টি হয়েছে বলে ধারণা করা হয়।
২. চাঁদ সৌরজগতের পঞ্চম বৃহত্তম উপগ্রহ - আমরা অনেকেই হয়তো ভেবে থাকি, চাঁদ হচ্ছে সৌরজগতের একমাত্র প্রাকৃতিক উপগ্রহ (ন্যাচারাল স্যাটেলাইট)। সৌরজগতের বিভিন্ন গ্রহকে কেন্দ্র করে ১৫০টিরও বেশি উপগ্রহ আবর্তন করছে। এর মধ্যে পৃথিবীর উপগ্রহটি পঞ্চম বৃহত্তম। সৌরজগতের সর্ববৃহৎ উপগ্রহটি হলো গ্যানিমেড যা শনি গ্রহের ৭৯টি উপগ্রহের মধ্যে একটি।
৩. চাঁদের চেহারা - আমরা যখন চাঁদের দিকে তাকাই তখন এর ৫৯শতাংশ দেখতে পাই। পৃথিবী থেকে চাঁদের বাকি ৪১শতাংশ কখনোই দেখা যায় না। পৃথিবী থেকে আমরা সব সময়ই চাঁদের একটা পিঠই দেখে থাকি।
৪. চাঁদের আকার - চাঁদকে আমরা গোল থালার মত দেখলেও চাঁদের উত্তর দক্ষিণ পৃথিবীর মতই সামান্য চাপা। চাঁদের ভরকেন্দ্র গ্রহটির জ্যামিতিক কেন্দ্রে নয় বরং এর অবস্থান চাঁদের কেন্দ্র থেকে ২কিলোমিটার বাইরে।
৫. চাঁদের আলো – চাঁদকে সূর্যের মতো সমান উজ্জ্বলতায় জ্বলতে হলে প্রায় চার লাখ পূর্ণ চাঁদের প্রয়োজন। কক্ষপথের কারণে বছরে একবার আমরা “সুপার-মুন” দেখতে পাই। চাঁদের কক্ষপথ সম্পূর্ণ বৃত্তাকার নয়। পৃথিবীকে প্রদক্ষিণের সময় যখন এটি পৃথিবীর নিকটতম স্থানে আসে তখন চাঁদকে অন্য যেকোনো সময়ের চাইতে ১৪শতাংশ বড় এবং ৩০শতাংশ উজ্জ্বল দেখায়।
৬. চাঁদের নাম – প্রতি মাসের পূর্ণ চাঁদের ভিন্ন ভিন্ন নাম রয়েছে। প্রচণ্ড শীতে ক্ষুধার্ত নেকড়েদের গর্জনের কারণে জানুয়ারি মাসের পূর্ণ চাঁদকে “উলফ-মুন” বলা হয়। জুনে বলা হয় “স্ট্রবেরি-মুন”, সেপ্টেম্বর মাসের পূর্ণ চাঁদকে বলা হয় “হারভেস্ট-মুন” এবং ডিসেম্বরে বলা হয় “কোল্ড-মুন”। ন্যাশনাল জিওগ্রাফি উত্তর আমেরিকায় ব্যবহৃত নামের কৃতিত্ব আমেরিকান আদিবাসীদেরকে দিয়েছে।
৭. চাঁদের কারণে জোয়ার ভাটা – চাঁদের মধ্যাকর্ষণ পৃথিবীর উপর টান সৃষ্টি করে যা সাগরের জোয়ার ও ভাটার জন্য দায়ী। পদার্থবিজ্ঞানী জর্জ ডারউইন (চার্লস ডারউইনের পুত্র) দেখিয়েছেন - যে প্রক্রিয়ায় চাঁদের আকর্ষণ পৃথিবীতে জোয়ার-ভাটার সৃষ্টি করে সেটি পৃথিবীর আবর্তনকে ধীর করছে।
৮. চাঁদে প্রাকৃতিক দুর্যোগ - চাঁদকে আমরা অনেকে স্বপ্নের জগত হিসেবে জেনে থাকলেও এখানকার প্রাকৃতিক অত্যন্ত বিরূপ, মানুষের বসবাসের অনুপযোগী। চাঁদে মাঝে মাঝে ভূমিকম্প হয় যা “মুন-কোয়াক” নামে পরিচিত। লুনার নাইট সিজনে চন্দ্রপৃষ্ঠের তাপমাত্রা মাইনাস ১৮০ডিগ্রী সেলসিয়াস পর্যন্ত নেমে যায়। আবার কখনো চাঁদের আবহাওয়া বেশ উত্তপ্তও হয়ে ওঠে। সাম্প্রতিক গবেষণায় দেখা গেছে, চাঁদের মাটির নিচে ঘনীভূত পানির বরফ রয়েছে।
৯. শুভ বিদায় চাঁদমামা - প্রতিবছর পৃথিবী থেকে কিছুটা রোটেশনাল এনার্জি নিয়ে নেয় চাঁদ। ফলে চাঁদ নিজস্ব কক্ষপথে বছরে ৩.৮ সেন্টিমিটার দূরে চলে যাচ্ছে। গবেষকরা জানিয়েছেন - চাঁদ সৃষ্টিলগ্নে পৃথিবী থেকে ২২,৫৩০ কিলোমিটার দূরে অবস্থান করলেও চাঁদ এখন পৃথিবী থেকে ৪৫০,০০০ কিলোমিটার দূরে চলে গিয়েছে। তাই প্রিয় পাঠক/পাঠিকা - আপনি যে সময় নিয়ে আমার এই লেখাটি পড়েছেন ততক্ষণে পৃথিবী থেকে চাঁদ খানিকটা দূরে সরে গিয়েছে!!!
১৮৮৩ সালে আগ্নেয়গিরি থেকে অগ্নুৎপাতের ফলে সেসময় বায়ুমণ্ডলে অনেক বেশি ধূলা-বালি ও ধোঁয়া ছড়িয়ে পড়ে। তখন পৃথিবী থেকে মানুষের চোখে চাঁদকে দেখতে নীল রঙের মনে হয়েছিল। আর এথেকেই “ব্লু-মুন” শব্দটির জন্ম হয়েছিল বলে ধারণা করা হয়। আমার বিশ্বাস - কোন বিরল ঘটনা বলতে ইংরেজিতে এজন্যেই তৈরি হয়েছে – “ওয়ান্স ইন এ ব্লু মুন”!
আজ থেকে পঞ্চাশ বছর আগে নীল আর্মস্ট্রং ১৯৬৯ সালের ২০ শে জুলাই প্রথম চাঁদে পা রাখার গৌরব অর্জন করেন। তখন তিনি বলেছিলেন – “একজন মানুষের এই ক্ষুদ্র পদক্ষেপ সমগ্র মানব জাতির জন্য এক বিশাল অগ্রগতি”। আগামী পঞ্চাশ বছর পরে আমাদের অনেকেই হয়তো এই পৃথিবীতে থাকবো না। চাঁদ বিজয়ের সুবর্ণ জয়ন্তীতে চাঁদের উজ্জ্বল আলোয় আবিষ্কৃত হোক চাঁদে মানব জাতির বসবাসের কৌশল…এই কামনায়।
মাসুদ পারভেজ, mmparvez@yahoo.com, সিডনী
|