ও চাঁদ! দীলতাজ রহমান
চাঁদ আমাকে ভীষণ টানে। আর লেখালেখির সুবাদে তো চাঁদের প্রসঙ্গ টানার আগেই চাঁদ চলে আসে। বাষট্টি সালে আমার জন্ম হলে ঊনসত্তরের জুলাইয়ে আমার বয়স কত হয়, সাত বছরের মতো বোধহয়। তখন আমরা খুলনার খালিশপুরে থাকতাম। তখন তো সাধারণ এলাকাতে তেমন দালানবাড়ি ছিল না। আর ওই এলাকায় একটি টিনের ঘরও ছিল না। তখন খুলনার সবখানেই ছিল গোলপাতার ঘর। ওটাই মধ্যবিত্ত, নিম্ন মধ্যবিত্ত থেকে বিত্তবানেরাও বেশির ভাগ ওই গোলপাতার ঘরে থাকতেন।
টেলিভিশন বস্তুটি আমি দেখেছি তিয়াত্তর সালের পর। তাও আমার বড়বোনের বিয়ে হলে তাদের বাড়িতে ক’দিন পর ঈদের দিন বেড়াতে গিয়ে রাতটিও কাটিয়ে ছিলাম বলে। সবাই ঘুমিয়ে পড়লে আপার বড় ভাসুরের মেয়ে আকলিমা, যে বয়সে আমার থেকে কিছুটা বড়ই ছিল, তবু আমি তার চাচীর বোন বলে আমি তার খালা। তো সেই আকলিমাই আমাকে রাত নটার মতো হবে, ডেকে বললো, ‘খালা, চলো টেলিভিশন দেখে আসি।
গাজীপুরের টংগী, তখন অবশ্য টংগী ঢাকার অংশ ছিল। তো টংগী জংশনের কাছেই গোপালপুর আপার শ্বশুরবাড়ির সামনেই বিরাট এক সুতার ফ্যাক্টরি ছিল, শতরং নাকি সাতরং নামে। আমরা যে কিভাবে সেখানে ঢুকেছিলাম, তা আজ ভুলে গেছি। শুধু মনে আছে, গুটিগুটি পায়ে সেখানে ঢুকে এগোতে এগোতে দেখি, বাইরে আলোকিত একটা মাঝারি বাক্স ঘিরে শখানেক মানুষ গায়ে গা লাগিয়ে চাতকের মতো চেয়ে আছে। আলোর সে বাক্সের কাছাকাছি গিয়ে দেখলাম, সে বাক্সভরা ছোট ছোট মানুষ কি মজার মজার কথা বলছে। নাচছে। গান-বাজনা করছে। এখন বুঝি সেটা ঈদের অনুষ্ঠান ছিল।
টেলিভিশনের কথা এখানে লিখলাম, কারণ সেই সাত বছর বয়সে গোলপাতার চালের ঘরে বসবাস করা বিপুল মানুষের যেকোনো তথ্য জানা ও বিনোদনের বাহন, ওই কারো ঘরের দুর্লভ কোনো একখানা ট্রানজিস্টারকেই দেখেছি। ওই ক্ষুদ্র যন্ত্রের মাধ্যমেই চাঁদে মানুষ পৌঁছুনো ও ফিরে আসার যে গুঞ্জরণ তখন মানুষের মুখে মুখে শুনেছিলাম, দৃষ্টিতে ঝরতে দেখেছিলাম যে বিস্ময়, তা এখনো প্রবলভাবে আমার প্রাণে গেঁথে আছে। এখনো সে স্মৃতি আমাকে তেমনি আন্দোলিত করে। আনন্দিত করে। সেবস মনে পড়ার প্রতিবারই আমি আমার প্রজাপতির মতো শিশুবেলাটির ছুটে আসা দেখতে পাই!
আর কতবার কতকিছু লিখতে গিয়ে যে আমার কতজনের শরণাপন্ন হতে হয়েছে এই বলে, যে কবে যেন চাঁদে মানুষ গিয়েছিল? ১৯৬৯ সালটা মনে থাকলেও তারিখটা বারবার ভুলে যাই! এই সেদিনই মাত্র সফট ওয়্যার ইঞ্জিনিয়ার আমার কনিষ্ঠ পুত্রকে বললাম, ইউটিউবে চাঁদ সম্পর্কে আরো তথ্য জানতে গিয়ে দেখলাম, বলা হচ্ছে, মানুষ যদি তখন চাঁদে যেতই তাহলে মানুষের যে প্রবণতা, তাতে এতদিন মানুষ চাঁদের সাথে পৃথিবীর সেতু বানিয়ে ফেলত…।’ ছেলেকে বললাম, আসলেই তো। তেমনটি যখন হয়নি, আমারও অবিশ্বাস জমতে শুরু করেছে কিন্তু …। আমার কথা শুনে ছেলে উত্তর দিল, ‘চাঁদে যেতে তো ব্যাপক আয়োজন করতে হয়। খরচ করতে হয়। তাই সেই খরচে নতুন গ্রহ-উপগ্রহে অভিযানের কথা ভাবছেন জ্যোতির্বিদগণ। আর আপাত দৃষ্টিতে দেখা চাঁদে হয়ত মানুষের দরকারও নেই!’ ছেলের কথা আমার মনে ধরলো।
কিন্তু সব বিশ্বাস-অবিশ্বাস ভেদ করে রেডিওতে শোনা তখন এই চাঁদে যাওয়ার খবরটা কেন্দ্র করে মানুষের যে আনন্দ দেখেছিলাম তা মনে আছে। প্রতিটি বাড়ির বাইরে তোলা চুলোতে রান্নার দাউ দাউ আগুন জ্বলছে, আর সন্ধ্যা পার করেও মানুষের চলছে, চাঁদে গিয়ে ফিরে আসার বিস্মিত আলাপ। আমাদের আশপাশের প্রায় সব বাড়িতেই রান্নাঘর ছাড়াও বাইরে চুলো থাকতো। যখন বৃষ্টি-বাদল থাকতো না তখন বাইরে রান্না করা হতো। আর আগে তো বাড়ির গা ঘেঁষে এতসব চায়ের দোকানও ছিল না। তাই জ্বলন্ত চুলো ঘিরেই যেন পরিবারের সব বয়সের মানুষের উৎসব চলতো।
নতুন করে আজকের এই চন্দ্র উৎসবে আমার মনে পড়ছে, এই উৎসব মানে আমার কাছে চাঁদের মতো ফুটফুটে এক বোনেরও জন্মোৎসব। এখন সে বোন গল্প-কবিতা লিখেও বেশ নাম করেছে।
দীলতাজ রহমান, ব্রিসবেন
|