সাদাকালো টিভির ঝিরঝিরে ছবি! আনিসুর রহমান
চাঁদে মানুষ যাচ্ছে এ ব্যাপারটা আমি প্রথম শুনি ১৯৬৮ সালে Appolo 8 উৎক্ষেপণের সময়। আমি তখন ক্লাস সেভেনে পড়ি। এই মিশনের ৩ জন যাত্রী চাঁদ পর্যন্ত গিয়ে চাঁদের চারপাশে ঘুরপাক খেয়ে আবার পৃথিবীতে ফিরে আসে। মনটা খুব খারাপ হয়ে গিয়েছিলো। এতদূর গিয়ে ফিরে এলো! একবার নামলো না! তখন থেকে পেপারে এ্যাপলো মিশনের কোন খবর পেলে মনোযোগ দিয়ে পড়তাম। এর অল্প দিনের মধ্যেই উৎক্ষেপণ করা হয় Appolo 9 এবং Appolo 10. এসব খবর পড়ে পড়ে মাকে শোনাতাম। মা কি বুঝতেন জানিনা কিন্তু আগ্রহ নিয়ে শুনতেন, আমারো উৎসাহ বেড়ে যেত! সে সময় আমাদের দীর্ঘতম ভ্রমণ ছিল নানা বা দাদা বাড়ি যাবার জন্য সারা রাত ধরে ট্রেনে খুলনা থেকে পার্বতিপুর যাওয়া। রাতে খুলনা থেকে ট্রেন ধরার সময় ট্রেনটাকে যত বড় দেখতাম সকালে পার্বতিপুরে পৌছেও ট্রেনটা তত বড়ই থাকতো। কিন্তু চাঁদে যাবার রকেটগুলে কি অদ্ভুত! যখন ছাড়ে তখন থাকে ৩০ তলা বিলডিং এর সমান উঁচু। কিছুদূর যায় আর এর নিচের অংশগুলো টিকটিকির লেজের মত খসে খসে পড়তে থাকে! ফিরে আসে ওপরের দিকের ছোট্ট একটা অংশ। পৃথিবীর কোন যানবাহন তো এমন না। রকেটের এই ব্যাপারগুলো আমার কিশোর মনকে অভিভূত করে রেখেছিল। এর মধ্যে উপস্থিত হলো সেই মাহেন্দ্রক্ষণ ২০ জুলাই ১৯৬৯ সাল।
আমরা তখন খুলনায় থাকি। খুলনা নিউ মার্কেটের খুব কাছে একটা সরকারী ফ্লাটে আমাদের বাস। এ সময়ে খুলনা নিউ মার্কেটের ছাদের ওপর (নিউ মার্কেট তখনো দোতালা হয়নি) একটা উঁচু বাঁশের মাথায় একটা অদ্ভূত জিনিস দেখলাম। একে ওকে জিজ্ঞাসা করি, কেউ বলতে পারে না ওটা কি। পরে জানলাম ওটা টিভি এ্যান্টেনা! মুন ল্যান্ডিং দেখার জন্য খুলনায় টিভি বিক্রী শুরু হয়েছিল কিংবা বিক্রী বেড়ে গিয়েছিল। অনেক উঁচুতে এ্যান্টেনা লাগালে আর দিনটা মেঘলা হলে ঢাকার অনুষ্ঠান ঝিরঝির করে একটু একটু দেখা যেত। তখন খুলনা নিউ মার্কেটে "A B & Co. " নামে একটি মাত্র ইলেক্ট্রনিক্স এর দোকান ছিল। আমরা বন্ধু বান্ধব নিয়ে ২০ শে জুলাই কিংবা তার পরের দিন সন্ধ্যায় ঐ দোকানের সামনে ভিড় করেছিলাম মুন ল্যান্ডিং দেখার জন্য। জানিনা সেটা লাইভ প্রোগ্রাম ছিল নাকি রিপ্লে। কিন্তু "A B & Co. " এর এ্যান্টেনা ১ তলার ছাদে লাগানো, আকাশেও মেঘ নেই। ছবি দেখা যাচ্ছেনা। দোকানের মালিক টিভিটাকে টিউন করার জন্য আপ্রাণ চেষ্টা করলেন কিন্তু লাভ হলো না। কে একজন বললো জোড়াগেটের কাছে একটা ৩ তলা বাড়ির ছাদে টিভি এ্যান্টেনা দেখেছে। জায়গাটা নিউ মার্কেট থেকে বেশী দূরে নয় আমরা ছুটলাম সেদিকে। সেটা এমন একটা সময় ছিল যখন মানুষ কারো বাড়িতে টিভি দেখতে অযাচিত ভাবে হাজির হলেও কেউ কিছু মনে করতো না বরং মনে হয় একটু খুশিই হতো। গিয়ে দেখি সেখানেও মানুষের ভিড়। সৌভাগ্যবানরা সোফায়, ফ্রন্ট-স্টল মাটিতে আর ড্রেস-সার্কেল বা রিয়ার-স্টলে আমরা দাঁড়িয়ে। সাদাকালো টিভিতে কিছু একটা দেখা যাচ্ছে। ছবির চেয়ে ঝিরঝির বেশী। এই আমার মুন ল্যান্ডিং দেখার গল্প। আজ ৫০ বছর পরে সেদিনের স্মৃতিও অনেক ঝিরঝিরে হয়ে গেছে!
মানুষ একদিন মঙ্গল গ্রহের মাটিতে পা রাখবে। সে দিনটা কেমন হবে? ভাবলে আবার নতুন করে জীবন শুরু করতে ইচ্ছা করে কিন্তু জীবন তো একটাই!
 আনিসুর রহমান, সিডনি
|