বন্ধুবর আব্দুর রাজ্জাকের স্মৃতি গোলাম মুরশিদ
ড. আব্দুর রাজ্জাক | রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগ দিয়েছিলাম ১৯৬৮ সালের পয়লা এপ্রিল। তার অল্পদিন পরেই রাজ্জাক সাহেবকে দেখি, যদ্দুর মনে পড়ে শিক্ষক-কর্মচারীদের ক্লাবে। অত্যন্ত সুদর্শন এবং স্মার্ট। আমার থেকে বছর পাঁচেকের ছোটো। সাইকোলজি ডিপার্টমেন্টের অধ্যাপক। মনে হলো, পাশ করার আগে উনি সম্ভবত ছাত্রনেতা ছিলেন। একটু উচ্চকণ্ঠ। একটু বেপরোয়া - কাউকেই তোয়াক্কা না-করার ভাবভঙ্গি। তখনই কেউ ওঁর সঙ্গে আমাকে পরিচয় করিয়ে দেয়নি। আর আমারও নিজের থেকে কারও সঙ্গে গায়ে পড়ে আলাপ করার অভ্যাস নেই। কাজেই তখনই ওঁর সঙ্গে পরিচয় হয়নি। কখন হয়েছিলো, এখন আর মনে করতে পারছি না। কিন্তু প্রথম দিকে সম্পর্কটা খুব বন্ধুত্বের ছিলো না। পরের বছর দৈবক্রমে আমরা কাছাকাছি আসি। আমি থাকার জন্যে যে-ফ্ল্যাটটি পাই বিশ্ববিদ্যালয়ের কাছ থেকে, তার ঠিক উপর তলার ফ্ল্যাটটি পান উনি।
নতুন ফ্ল্যাটে উঠেছি সবেমাত্র, এমন সময়ে একদিন রাজ্জাক সাহেব আমাকে একটু অ্যাগ্রেসিভ কণ্ঠে, বাঁকাভাবে বললেন, ‘কী মুরশিদ সাহেব, আপনি নাকি ইসরাত আনসারী নামে একটি বিহারী ছাত্রীর সঙ্গে প্রেম করে বেড়াচ্ছেন?’ মনে হলো, ওঁর ইচ্ছে অনেকটা গায়ে পড়ে ঝগড়া বাঁধানোর। আমি বললাম, ‘আপনি ঠিক শোনেননি, মেয়েটির নাম ইসমত আনোয়ারী। আর, ওর সঙ্গে আগামী মাসের পঁচিশ তারিখে আমার বিয়ে।’ শুনে রাজ্জাক সাহেব একদম চুপ করে গেলেন।
ওঁর সঙ্গে এভাবে আমার পরিচয় হয়েছিলো একটু তিক্ততার মধ্য দিয়ে। কিন্তু তারপর আমরা ঘনিষ্ঠ বন্ধুতে পরিণত হয়েছিলাম। ঘরে, বাইরে - উভয় ক্ষেত্রেই আমরা বন্ধুতে পরিণত হয়েছিলাম। বিশ্ববিদ্যালয়ের রাজনীতি এবং উভয়ের বাড়িতে আমরা বন্ধু ছিলাম। সেই বন্ধুত্বকে আরও জোরদার করেছিলো রাজ্জাক সাহেবের স্ত্রী - রুনু। রুনু ছিলো আমার ছোটো বোন লিলির সহপাঠী। লিলি আমাকে দাদা ডাকতো, রুনুও সেই সূত্রে আমাকে দাদা ডাকতো। জোর গলায় দাদা ডাকতো - এটুকু বললে কিছুই বলা হয় না। রুনু আমাকে খুব শ্রদ্ধা করতো আর ভালোবাসতো।
আমাদের যোগাযোগ আরও বৃদ্ধি পায় কয়েক বছরের মধ্যে যখন আমাদের ছেলেমেয়ে হলো। রাজ্জাক সাহেবদের ছেলে রাতুল আর মেয়ে ছোটন প্রায় সারাক্ষণই আমাদের বাড়িতে আসতো আমাদের মেয়ে অমিতা আর ছেলে অন্তুর সঙ্গে খেলতে। আবার অমিতা-অন্তু কখনো কখনো যেতো রাতুলদের বাড়িতে। অমিতা আর অন্তু আমাকে ‘বাবা’ ডাকতো, সেটা দেখে ছোটনও আমাকে ‘বাবা’ ডাকতো।
মুক্তিযুদ্ধ শুরু হবার আগের দিনগুলোতে আমরা দুজন শিক্ষকদের মিছিলে যোগ দিতাম। কখনো সভায় যোগ দিতাম। রাজ্জাক সাহেবের মধ্যে নেতৃত্ব দানের গুণ ছিলো। রাজ্জাক সেসব সভায় আয়োজকের ভূমিকা পালন করতেন, বক্তৃতা করতেন। বক্তৃতা আমিও করতাম। যুদ্ধ শুরু হওয়ার ঠিক আগে এমনি একটি সভা অনুষ্ঠিত হয় জুবেরী-ভবনের শিক্ষক-কর্মচারীদের ক্লাবে। ততদিনে দারুণ উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়েছিলো। একদিকে পুলিশ আর বিডিআর, অন্যদিকে উপশহরে সৈন্যদের ছাউনিতে রীতিমতো যুদ্ধংদেহী পরিবেশ।
সেই সভায় গণিত বিভাগের প্রবীণ অধ্যাপক হবিবুর রহমান বলেন যে, বয়সী শিক্ষকরা চাঁদা দিয়ে এবং তরুণ শিক্ষকরা রক্ত দিয়ে সাহায্য করতে পারেন। তাই শুনে রাজ্জাক খুব চটে যান। কেবল তরুণরা রক্ত দেবে এ কথার প্রতিবাদ করেন উত্তেজিত ভাবে। তাই নিয়ে হবিবুর রহমান সাহেবের সঙ্গে প্রায় ঝগড়া বেঁধে গেলো। পরের বছর হবিবুর রহমান সাহেবের কন্যা রুনুর সঙ্গে রাজ্জাক সাহেবের বিয়ে হয়। হবিবুর রহমান সাহেব সেটা অবশ্য দেখে যেতে পারেননি। কারণ যুদ্ধ শুরু হবার পর-পর আমরা সবাই বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস ছেড়ে পালিয়ে গেলেও, হবিবুর রহমান সাহেব সপরিবারে ক্যাম্পাসেই থেকে যান। এদিকে, আওয়ামী লীগের এবং মুক্তিযুদ্ধের সমর্থক হিসেবে হবিবুর রহমান সাহেবের নাম সবাই জানতো। তাই ১৩ই এপ্রিল তারিখে পাকিস্তানের সৈন্যরা ক্যাম্পাস দখল পর-পরই তারা হবিবুর রহমান সাহেবকে জুবেরী-ভবনে ধরে নিয়ে যায়। সেই শেষবার তাঁকে জীবিত অবস্থায় দেখা যায়। তাঁকে অনেকেই ক্যাম্পাস থেকে পালিয়ে যেতে বলেছিলো। কিন্তু তিনি তাতে রাজি হননি। এভাবে জেদ করে নিজের বাসায় থেকে যাওয়ার চরম মূল্য দিয়েছিলেন তিনি।
ওদিকে, আমরা দল বেঁধে কলকাতায় পালিয়ে গিয়েছিলাম। সেখানে যাবার সপ্তাহ খানেক পরেই আমি জায়গা পেয়েছিলাম পার্ক সার্কাসে, জাস্টিস মাসুদের একটি ফ্ল্যাটে। ফ্ল্যাটটা জুটিয়ে দিয়েছিলেন প্রখ্যাত সমাজকর্মী এবং লেখিকা, মৈত্রেয়ী দেবী। তাঁর সঙ্গে আমার আগে থেকে চিঠিপত্রের যোগাযোগ ছিলো। সেই ফ্ল্যাটেই একদিন দরজায় কড়া নাড়ার শব্দ শুনে দরজা খুলেই দেখি সামনে দাঁড়িয়ে রাজ্জাক সাহেব! সঙ্গে আর এক ভদ্রলোক। জানতাম না যে, উনিও পালিয়ে এপারে চলে এসেছিলেন। চা-টা খেয়ে বের হবার সময় রাজ্জাক সাহেব জিজ্ঞেস করলেন, দেবব্রত বিশ্বাসের কাছে যাবেন? অতো বড়ো একজন শিল্পীর সঙ্গে পরিচিত হতে আমি খুবই আগ্রহী ছিলাম। কেবল বড়ো শিল্পী নন, আমার প্রিয় শিল্পীও।
তিনজন মিলে ট্রামে করে গড়িহাটায় গিয়ে নামলাম দেবব্রত বিশ্বাস যে ছোট্ট ফ্ল্যাটে থাকতেন, সেই ফ্ল্যাটের কাছে। তারপর গিয়ে দরজার কড়া নাড়লাম। দরজা খুললেন স্বয়ং দেবব্রত বিশ্বাস গেরুয়া রঙের লুঙ্গি আর ফতুয়া পরা। আমাদের দেখে প্রশ্ন করলেন, আপনেরা কেডা? উনি সব সময়ে কিশোরগঞ্জের ভাষায় কথা বলতেন। তাঁর সঙ্গে আলাপ হলো। সেই আলাপ থেকে আমার সঙ্গে তাঁর ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক গড়ে উঠলো। এর ন বছর পরে তিনি মারা যান, সেই অবধি এই সম্পর্ক কখনো মলিন হয়নি। রাজ্জাক সাহেব গানের অতো উৎসাহী শ্রোতা ছিলেন না। তিনি আর দ্বিতীয়বার দেবব্রত বিশ্বাসের কাছে যাননি। এর পর মুক্তিযুদ্ধ শেষ হওয়া পর্যন্ত যদ্দুর মনে পড়ে রাজ্জাক সাহেবের সঙ্গে আমার আর দেখা হয়নি।
দেখা হয় স্বাধীন বাংলাদেশে - সেই রাজশাহীতে। জানুয়ারি মাসের শেষ দিকে, অথবা ফেব্রুয়ারি মাসের শুরুতে। রাজ্জাক আগেই ক্যাম্পাসে গিয়েছিলেন। গিয়েই দলবল নিয়ে আরম্ভ করেন দালাল শনাক্ত করার কাজ। এই কাজের জন্যে রাজশাহী শহর আর ক্যাম্পাসের সত্যমিথ্যা, গুজব আর খবর দিয়ে একটা চার পৃষ্ঠা, কি আট পৃষ্ঠার ট্যাবলয়েড সাইজের একটি পত্রিকা প্রকাশ করেন। রাজ্জাক সাহেবরা এটাকে সাপ্তাহিক পত্রিকা হিসেবে ঘোষণা করেছিলেন কিনা আমার মনে নেই। তবে আমার নাম দিয়েছিলেন সম্পাদক হিসেবে। আমি এর কথা ঘুণাক্ষরেও জানতাম না। যদ্দুর মনে পড়ে এ ‘পত্রিকা’ দু সংখ্যার বেশি প্রকাশিত হয়নি।
আমরা যারা ভারতে পালিয়ে গিয়েছিলাম এবং মুক্তিযুদ্ধে কমবেশি অংশ নিয়েছিলাম, যারা পালিয়ে যাননি, তাঁরা আমাদের ঠাট্টা করে বলতেন ‘হাজী’। তা আমরা ‘হাজী’ সাহেবদের কেউ কেউ গাঁয়ে-না-মানা মাতবরের মতো কোথাও কোথাও মাতব্বরি করার চেষ্টা করেছিলাম। তারপর ধীরে ধীরে সবকিছু শান্ত হয়ে যায়। যারা নেতৃত্ব দিতে এ সময়ে এগিয়ে যান, তাঁদের মধ্যে রাজ্জাক সাহেবও ছিলেন। উনি বিশ্ববিদ্যালয়ের বহু কমিটির সদস্য ছিলেন। ওঁকে এক বাক্যে সবাই চিনতো। এভাবে চলেছিলো ৭৫-এর অগাস্ট মাস পর্যন্ত।
জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব নিহত হওয়ার পরে বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশ অনেকটাই বদলে যায়। রাজ্জাকের নেতৃত্বের ভূমিকা খানিকটা ম্লান হয়ে গেলো। কিন্তু আমরা মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের লোকেরা সংঘবদ্ধ থাকলাম এবং রাজ্জাক এই দলের মধ্যে তাঁর নেতৃত্বের ভূমিকা বজায় রাখলেন। ১৯৮৩ সালের ডিসেম্বর মাসে আমি লন্ডনে চলে যাই। ফলে রাজ্জাক এবং আমার, এবং আমাদের পরিবারের যোগাযোগ ছিন্ন হলো। তার কিছুদিন পরে, ঠিক কতদিন মনে নেই, একখানা চিঠি পাই রাজ্জাকের কাছ থেকে। চিঠিটার মধ্যে যা অভিনবত্ব ছিলো, তা হলো এটি রাজশাহী থেকে লেখা নয়, এমন কি, বাংলাদেশ থেকেও লেখা নয়। এটা লেখা অ্যামেরিকা থেকে। অ্যামেরিকার মিনিয়াপলিস থেকে। বিস্মিত হলাম। বুঝলাম, রাজশাহীর সঙ্গে রাজ্জাকের সম্পর্ক ছিন্ন হয়েছে। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে সম্পর্কও ছিন্ন হয়েছে। আমাদের বন্ধুত্বের সুতোটাও এভাবে ছিঁড়ে গেলো।
অনেক দিন পরে জানতে পেলাম, ডক্টর রাজ্জাক সপরিবারে সিডনিতে বাসা বেঁধেছে। তারপরও রাজ্জাকের সঙ্গে দেখা হয়েছে ঢাকায়, মেলবোর্নে, এমন কি লন্ডনে। কিন্তু আর দেখা হবে না। আমি তাঁর স্মৃতির প্রতি আমার আন্তরিক শ্রদ্ধা জানাই।
*** প্রয়াত ডঃ আব্দুর রাজ্জাকের অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ সহযোগী, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ও পরবর্তীতে বিবিসি বাংলা বিভাগের প্রাক্তন সংবাদ ও কথিকা পাঠক বাংলা একাডেমী সাহিত্য পুরস্কার প্রাপ্ত ডক্টর গোলাম মুরশিদ এর একটি স্মৃতিচারণমূলক নিবন্ধ। সিডনির রেড রোজ ফাংশন সেন্টারে বঙ্গবন্ধু কাউন্সিল অস্ট্রেলিয়া আয়োজিত ডঃ আব্দুর রাজ্জাকের মৃত্যু পরবর্তী স্মরণ সভায় বঙ্গবন্ধু পরিষদের সভাপতি ডঃ রতন কুণ্ডু এই নিবন্ধটি পাঠ করেন।
|