bangla-sydney
bangla-sydney.com
News and views of Bangladeshi community in Australia













ধ্রুব শিকড় - ৯
ফিরোজ আলী


আগের পর্ব পরের পর্ব

বাবু ছোটবেলা থেকেই শান্ত, মা ঘেঁষা। বাবুর বয়স তখন চার, কিন্তু সে অনেক কিছুই বুঝতে পারে। তার বয়সের বাচ্চারা যখন খেলাধুলা, আনন্দ কোলাহলে বড় হচ্ছে সে বুঝতে পারে তাঁর বাবা জেলে, যাদের বাসায় থাকছে সেখানে তারা আশ্রিত। যার স্বামীকে হয়তোবা ইতিমধ্যে মেরে ফেলা হয়েছে কিংবা নিশ্চিত মৃত্যুদণ্ড দেয়া হবে, পুত্র সহ কে বা তাঁকে অনির্দিষ্ট কালের জন্য আশ্রয় দিবে। বাবুর মনে পড়ে এক বাসায় থাকার সময়ের কথা, ওই বাসার বড় মেয়েটা একদিন হেনাকে বলছে, “রান্না ঘরে একটা চিংড়ি মাছ আছে, ওটা দিয়েই আপনাদের খেয়ে নিতে হবে ”। বাবুর চিংড়ি খুব প্রিয়, কিন্তু সারা জীবন এই কথা তার কানে বাজে অজান্তেই। আরেক বাসার কর্তা একদিন কি কারণে যেন খুব রাগ হয়ে জোর করে বাবুকে বসিয়ে দিয়ে আসে সামনের স্কুলে বড় বাচ্চাদের ক্লাসে। কি যে অসহায় অবস্থা তখন। (বাবু চির কৃতজ্ঞ তাঁদের প্রতি যারা সে সময়ে আশ্রয় দিয়ে ছিলেন)।

জুন মাসের ১৬/১৭ তারিখ হেনা জানতে পারে “রাষ্ট্র বনাম শেখ মুজিব এবং অন্যান্য” এই নামে একটা মামলা শুরু হবে। যারা অভিযুক্তদের সাথে দেখা করতে আগ্রহী তাদের জন্য পাসের ব্যবস্থা করা হয়েছে, ক্যান্টনমেন্ট থেকে পাস সংগ্রহ করতে হবে। হেনা পাস সংগ্রহ করতে পারে না, কোথায় যাবে, কি করবে, কেউ নেই। মামলার কাজ শুরু হবে ১৯শে জুন, ১৮ই জুন হেনার বোনের স্বামী অনেক চেষ্টা করে একটা পাস যোগাড় করে।

১৯ জুন ‘ ৬৮ সকাল, শেখ মুজিব সহ তের জন বন্দী যার যার কারাকক্ষ থেকে বেরিয়ে জড়ো হলো পাঞ্জাব অফিসার্স মেসের কম্পাউন্ডে। কারা ভ্যানের অপেক্ষায় তাঁরা, শেখ মুজিব একে একে সবার সাথে কোলাকুলি করলেন। এই প্রথম শেখ মুজিবের সাথে শওকতের সামনা সামনি দেখা হলো এর আগে দুর থেকে বক্তৃতা শুনেছে কিন্তু এত কাছে যাওয়ার সুযোগ হয় নাই। শেখ মুজিবকে খুব উৎফুল্ল দেখাচ্ছিল - সবার কুশলাদি জিজ্ঞাস করলো।

কিছুক্ষণ পর বাকি ২২ জনকে নিয়ে ইপিআরটিসি‘র একটা বাস পাঞ্জাব ইউনিট লাইনস থেকে পাঞ্জাব অফিসার্স মেসের সামনে এসে থামলো। প্রথম শেখ মুজিব ভ্যানে উঠলো আর তাঁর পিছে পিছে বাকি ১২ জন অফিসার। শেখ মুজিব ভ্যানে উঠতেই বাসে যারা বসে ছিল তারা সবাই জোড়ে হাত তালি দিয়ে উঠলো - শেখ মুজিব সবাইকে জড়িয়ে ধরলেন। সবাইকে অবাক করে দিয়ে তাঁর দরাজ গলায় বললেন “তোমরা কোন চিন্তা করো না, তোমাদের কিছুই হবে না”। হঠাৎ শেখ মুজিব জানতে চান, কেউ দেশাত্মবোধক গান গাইতে পারেন কিনা। ক্যাপ্টেন আলম সাথে সাথে গেয়ে উঠেন ‘ ধনধান্যে পুষ্পে ভরা, আমাদের এই বসুন্ধরা’। শেখ মুজিব সহ আর সকলে কণ্ঠ মিলায় ওই গানের সাথে- এরকম একটা মুহূর্ত, এরকম একটা অনুভূতি - স্বাধীনতা কামী দেশ প্রেমিক বাঙালীর হৃদয় নিংড়ানো আবেগ যেন ঝরে পড়ে এই গানে সেদিন।

তখনকার সিগন্যালস অফিসার্স মেসকে বানানো হয় বিশেষ ট্রাইবুনাল (বর্তমান “বিজয় কেতন”), পাঞ্জাব অফিসার্স মেস থেকে ২০০ মিটার দূরত্ব, গান শেষ হতেই বন্দীদের ভ্যান চলে আসে বিশেষ ট্রাইবুনালের সামনে। মামলার কাজ শুরু হওয়ার কথা সকাল ১১.০০ টায় বন্দীরা Accused Dock এসে দাঁড়ায় ১০.৪৫, মাঝের এই ১৫ মিনিটে অভিযুক্তরা এই প্রথম বারের মত তাঁদের পরিবারের সদস্য দের সাক্ষাৎ পায়। শওকত দেখে কাঠের গ্রিলের ওপাশে খুব কাছে হেনা দাড়িয়ে। হেনা কাঁদছিল, চিৎকার করে কাঁদছিল, এমন সময় শেখ মুজিব এসে হেনার মাথায় রাখলো, চোখের পানি মুছে দিয়ে বললো “তোরা কাঁদবি কেন? আমি তো ওদের ফিরায়ে নিয়ে আসবো”।

শওকত দেখলো দূরে আবদুল্লাহ সাহেব দাঁড়িয়ে আছেন যিনি শওকতের পক্ষে উকিল হয়ে মামলা লড়তে এসেছেন। এই সেই অবসরপ্রাপ্ত ডি আই জি আবদুল্লাহ যিনি শওকতের পাশে এসে দাড়িয়ে ছিলেন অনেক দিন আগে যখন শওকত ঢাকায় আই কম পরীক্ষার বই কিনতে পারছিল না, কলেজের ফি দিতে পারছিল না। আবারও সে এগিয়ে এলেন শওকতের এই মহা বিপদে - শওকতের Friend, Philosopher and Guide. বিলাতে বসবাস রত বাঙালিরা স্যার থমাস উইলিয়ামসকে পাঠালো শেখ মুজিবের আইনজীবী হিসেবে। সিদ্ধান্ত হয় অভিযুক্তরা তাঁদের বিরুদ্ধে আনিত অভিযোগ অস্বীকার করবে এবং নির্দোষ দাবি করবে। আইনজীবীরা যার যার মক্কেলের পক্ষে মামলা পরিচালনা করবে কিন্তু যৌথ ডিফেন্সের কোন ক্ষতি হয় এমন কিছু করবে না।

সরকার পক্ষের প্রধান কৌসুলি মঞ্জুর কাদের বিচার কার্য শুরু করলেন ৩৫ জনের বিরুদ্ধে আনিত অভিযোগ নামা পড়ে। উনি যা বলেছিলেন তার অনেক টাই সত্য, যে ঘটনা গুলোর সাথে শওকত জড়িত ছিল সে গুলো মনে পড়ছিল। যদিও মামলাটার নাম দেয়া হয়েছিল “রাষ্ট্র বনাম শেখ মুজিব এবং অন্যান্য”, কিন্তু অভিযুক্ত দের সাথে ভারতের সংশ্লিষ্টতা প্রচার করার জন্য সরকার আগরতলা মামলা হিসেবেই সরকারি প্রেস বিজ্ঞপ্তি এবং সরকারি প্রচার যন্ত্রে প্রচার করতে থাকে। হেনার সাথে প্রথম দিন কোর্টে যেতে পারে নি বাবু, এরপর অবশ্য অনেক দিন কোর্টে গিয়েছে মার হাত ধরে। কোর্ট কক্ষে বাবার মুখটা এখনও মনে পড়ে তার।

মার হাত ধরে গিয়েছে হাটখোলায় আবদুল্লাহ সাহেবের বাসায়, মনে পড়ে চির কুমার আবদুল্লাহ সাহেবের সাইকেলটা তাঁর রুমেই দেয়ালে হেলান দেয়া থাকতো, তাঁর ওখানে গেলে তিনি নিজে গিয়ে মিষ্টি সন্দেশ নিয়ে আসতেন। আবদুল্লাহ সাহেব শওকতের পক্ষে মামলার যাবতীয় খরচ বহন করেন।

মামলা শুরু হওয়ার পর অভিযুক্তরা যেখানে থাকতেন সেখানে তাঁদের নিজেদের মধ্যে মেলামেশায় বাধা নিষেধ কমে আসে। শওকতকে ডেকে একদিন মুজিব বললেন “কি শওকত এখন তো ধরা পড়ে গেলা, এরপর কি করবা”? শওকত উত্তর দেবার আগেই মুজিব বললো, “এখান থেকে বেরিয়ে আমি একটা নির্বাচন করবো, আমি নির্বাচনে জয় লাভ করবো কিন্তু পাকিস্তানীরা ক্ষমতা দিবে না, তখন মুক্তি যুদ্ধের মাধ্যমে বাংলাদেশকে স্বাধীন করতে হবে। সেই যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত থেকো”। শওকত অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করে আপনি সহ আমাদের সকলের কঠিন শাস্তি হওয়ার কথা, নির্বাচন কি ভাবে করবেন। মুজিব বলে “আমাদের কিছুই হবে না, কিছু ভেবো না”।

পাঞ্জাব অফিসার্স মেসে পরিবারের সদস্যরা ১৫ দিন পর পর দেখা করার অনুমতি পেত, মার হাত ধরে বাবুও গিয়েছে ওখানে বাবাকে দেখতে - এখনও মনে আছে একটা লম্বা রুমে চারটা বেড, এক পাশে রুমে ঢোকার দরজা আর অন্য পাশে বাথরুম, প্রতি রুমের সামনে গার্ড দাঁড়িয়ে। কারও পরিবারের সদস্যরা এলে রুমের অন্য বন্দীরা বেরিয়ে যেত। মামলা চলা কালীন সময়ে হঠাৎ একদিন কর্তব্য রত গার্ডরা দু জন বন্দীকে খুব কাছ থেকে গুলি করে, বেয়নেট চার্জ করে - তাঁদের একজন সার্জেন্ট জহুরুল হক অন্যজন ফ্লাইট সার্জেন্ট ফজলুল হক। ওই ঘটনায় সার্জেন্ট জহুরুল হক মৃত্যু বরণ করেন - এ খবর ঢাকা শহরে পৌঁছালে ব্যাপক গণ আন্দোলন শুরু হয়, মাওলানা ভাসানীও মাঠে নামেন মামলা প্রত্যাহার আর বন্দীদের মুক্তির দাবিতে। অবশেষে চরম আন্দোলনের মুখে ২২ ফেব্রুয়ারি ‘৬৯ সরকার মুক্তি দিতে বাধ্য ওই ৩৫ জন বন্দীকে।

যেদিন শওকত ছাড়া পায়, নিজেই হেটে হেটে চলে আসে ভাসানটেকে হেনার বোনের বাসায় যেখানে তখন হেনা আর বাবু থাকতো। হেনা জানতো না যে তাঁর স্বামী ছাড়া পেয়েছে, সেক্রেটারিয়েটে গিয়েছিল কোন কাজে। খবর শুনে দৌড়ে এসে হেনা দেখে বাবুকে কোলে নিয়ে শওকত বসে আছে। সেদিন দুপুরে শওকত ভাত খাইয়ে দিলো বাবুকে, নিজের ছেলেকে যখনি ভাত খাইয়ে দিতে গেছে বাবু - ওই মুহূর্ত টার কথা সব সময় মনে পড়ে তার।

২৩ ফেব্রুয়ারি ‘৬৯ ঢাকার রেসকোর্স ময়দানে বিশাল এক জনসভায় শেখ মুজিবকে বঙ্গবন্ধু উপাধি দেয়া হয়। এই বিপ্লবীদের পরিকল্পনা ফাঁস হয়ে গেলেও, তাঁরা হয়ে যায় বাংলাদেশের ইতিহাসের অবিচ্ছেদ্য একটা অংশ। শেখ মুজিবের মুক্তি আর আগরতলা মামলা প্রত্যাহারের দাবি প্রচণ্ড গণ বিক্ষোভে রূপান্তরিত হয়ে ১৯৬৯ সালের গণ অভ্যুত্থানে পরিণত হয়।

যে সশস্ত্র পন্থায় এই দেশ প্রেমিক বাঙালিরা বাংলাদেশ স্বাধীন করতে চেয়েছিলেন সেই সশস্ত্র পন্থায় একদিন বাংলাদেশ স্বাধীন হয়। তাঁরা কোন ভুল করেনি।


আগের পর্ব পরের পর্ব





Share on Facebook               Home Page             Published on: 16-Nov-2021

Coming Events: