bangla-sydney
bangla-sydney.com
News and views of Bangladeshi community in Australia













ধ্রুব শিকড় - ৮
ফিরোজ আলী

আগের পর্ব পরের পর্ব

করাচী ক্যান্টনমেন্টে অর্ডন্যান্স স্কুলের ইন্সট্রাক্টর ক্যাপ্টেন শওকত আলী - অফিসারদের ট্রেনিং দিতে, শিখাতে ভালো লাগে তাঁর। স্ত্রী আর এক ছেলেকে নিয়ে সময় ভালই কাটছে। কৌশলগত কারণে পূর্ব পাকিস্তান স্বাধীন করার গোপন পরিকল্পনা আর কার্যকলাপ আপাতত সীমিত। এ সময় ‘৬৭ সালের ৬ই জুন করাচী সিএমএইচে জন্ম হয় হেনা আর শওকতের দ্বিতীয় সন্তান খালেদ শওকত আলীর (অপু)। হেনার বয়স তখন বিশ - এই বিদেশে ভিন পরিবেশে নিজেকে মানিয়ে দুই শিশু সন্তানকে নিয়ে সুখের সংসার করছে, সুন্দর সময় কাটছে।

৬৮ সালের জানুয়ারির ২ তারিখ দৈনিক ডন (DAWN) পত্রিকায় একটা খবর শওকতের নজর এড়ায় না। পত্রিকায় খবরটা এমন ছিল “রাজনীতি এবং সরকারি চাকরিতে কর্মরত কিছু রাষ্ট্রদ্রোহী ব্যক্তিকে সরকার চিহ্নিত করেছে, যারা দেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি বিঘ্ন ঘটানের চেষ্টা করছিল। তাঁদের কার্যকলাপ গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করা হচ্ছিল। এই প্রেক্ষাপটে কিছুসংখ্যক ব্যক্তিকে গ্রেফতার করা হয়েছে। তদন্ত কাজ অব্যাহত রয়েছে।” এই খবর পড়ার পর শওকত বুঝতে পারে তাঁদের পরিকল্পনার কথা ফাঁস হয়ে গেছে, তাঁর সময়ও ঘনিয়ে আসছে।

হেনাকে খবরটা দেখায়, হেনা কুমিল্লা থেকেই জানতো শওকতের বিদ্রোহী কার্যকলাপের কথা। শওকত বুঝতে পারে না কি করবে। তবুও হেনাকে মানসিক ভাবে তৈরি করার জন্য সব কথা খুলে বলে, হেনা স্বভাবতই মানসিক ভাবে ভেঙ্গে পড়ে - শওকত সান্ত্বনা দেয়। শওকতের তখন মনে হয় বাঙালি সন্তান হওয়ার পাশাপাশি সে তো একজন পিতা, একজন স্বামী। প্রতিদিন বিকেলে স্ত্রী আর বাচ্চাদের নিয়ে বেরিয়ে পড়ে, দুই চাকার ভেসপা নিয়ে করাচী শহরে কিছু ভালো সময় কাটায়।

সম্ভাব্য গ্রেফতার আর স্ত্রী পুত্রদের ভবিষ্যৎ ভেবে অস্থির হয়ে পড়ে শওকত। হতাশ হয়ে পড়ে স্বাধীনতার পরিকল্পনা ফাঁস হয়ে যাওয়াতে - নিদ্রাহীন রাত কাটায় শওকত। সে সময় এগিয়ে এলো হেনা - বললো তুমি যা করেছ ঠিক করেছ, দেশের জন্য করেছ, একজন দেশ প্রেমিক হিসেবে করেছ। বাচ্চাদের নিয়ে চিন্তা করতে মানা করলো হেনা - শওকত গর্ব বোধ করে।

এর মধ্যে ৬ই জানুয়ারি রেডিও পাকিস্তানের সন্ধ্যার একটা খবর শুনে স্তম্ভিত হয়ে যায় শওকত আর হেনা - একজন আরেক জনের দিকে তাকাতে পারে না। বিস্তারিত খবরে গ্রেফতারকৃত দের নাম বলা হয় যারা সকলে বিপ্লবী সংস্থার সদস্য।

পরদিন ডন পত্রিকায় মূল শিরোনামে খবরটা ছাপা হয়। দুজনেই বুঝতে পারে কি হতে যাচ্ছে। এখন শুধু অপেক্ষা মাত্র। অবশেষে ৬৮‘র ১০ ই জানুয়ারি সকালে শওকতের কমান্ডিং অফিসার শওকতকে ডেকে পাঠান - বললেন আর্মি হেড কোয়ার্টার থেকে তাঁকে গ্রেফতারের নির্দেশ এসেছে, বন্দী করে যেন ওই দিনই রাওয়াল পিন্ডি পাঠিয়ে দেওয়া হয়। একজন এসকর্ট অফিসার নিযুক্ত করা হলো, সেদিন ১১ টায় আনুষ্ঠানিক ভাবে শওকতকে গ্রেফতার করা হয়।

এসকর্ট অফিসার মেজর জায়েদি বয়স চল্লিশের উপর, দয়াবান মানুষ- শওকতকে বললেন বাসায় যেয়ে অপেক্ষা করতে। শওকত শেষবারের মত তাঁর দু চাকার ভেসপা চালিয়ে কয়েক শ গজ দূরে তাঁর নিজের বাসায় এলো। অসময়ে অফিস থেকে চলে আসায় হেনার বুঝতে অসুবিধা হয় না কি হয়েছে - একজন আরেক জনকে সান্ত্বনা দেয়া ছাড়া আর কিছুই করার নেই তখন। শওকত হেনা কে বললো মন খারাপ করো না, আমাকে ধরার অর্ডার এসেছে, আমাকে আর কিছুক্ষণের মধ্যেই নিয়ে যাবে, ‘তোমার সাথে আর দেখা হবে না, এটাই শেষ দেখা, আর কোনোদিন দেখা হবে না।‘

মেজর জায়েদি এলেন, শওকত কে বন্দী করে নিয়ে গেল করাচী রেলওয়ে স্টেশন, তারপর রাওয়ালপিন্ডি গামী ট্রেন। করাচী থেকে রাওয়ালপিন্ডি অনেকটা পথ, পরদিন বিকেলে সেই ট্রেন এসে পৌঁছায় রাওয়ালপিন্ডি। বন্দী অবস্থায় শওকতের মনটা নিশ্চয়ই কষ্টে ভেঙ্গে যাচ্ছিল, ভেসে উঠছিল প্রিয়তমা স্ত্রীর হাসি মুখ, বাবু আর অপুর ছোট ছোট আঙ্গুলের স্পর্শ।

ওখানে পৌঁছার পর কিছুক্ষণের মধ্যেই নিয়ে যাওয়া হয় ইন্টার সার্ভিস ইন্টেলিজেন্স (আইএসআই) জিজ্ঞাসাবাদ সেলে - চলে অমানুষিক শারীরিক আর মানসিক নির্যাতন। এই অমানুষিক নির্যাতনের পরও নতুন কোন তথ্য প্রশ্নকারীরা বের করতে পারে না। বেশির ভাগ তথ্যই ওরা জানে।
এরকম জিজ্ঞাসাবাদ, শারীরিক আর মানসিক নির্যাতন চলে ৬৮‘র জানুয়ারির শেষ পর্যন্ত।

ফেব্রুয়ারির প্রথম সপ্তাহে PIA ‘ র একটা প্লেনে এসকর্ট করে বন্দী অবস্থায় নিয়ে আসা হয় শওকতকে ঢাকা ক্যান্টনমেন্টে ডিভিশনাল হেড কোয়ার্টার অফিসার্স মেসে। ওই প্লেনে বন্দী অবস্থায় ক্যাপ্টেন আলমকেও নিয়ে আসা হয় রাওয়ালপিন্ডি থেকে ঢাকা, কথা বলতে পারে না একজন আরেকজনের সাথে। একই অফিসার্স মেসে রাখা হয় ক্যাপ্টেন মোতালেব, ক্যাপ্টেন হুদা, ক্যাপ্টেন আলম, নৌ লেফটেন্যান্ট মোজাম্মেলকে। এখানেও চলে জিজ্ঞাসাবাদ আর নির্দয় আচরণ।

ইতিমধ্যে বন্দী অবস্থায় তাঁরা জানতে পারে শেখ মুজিবকেও গ্রেফতার করা হয়েছে। ওই সময় আরও শত শত দেশ প্রেমিক বাঙালী যারা সামরিক কিংবা ইস্ট পাকিস্তান রাইফেলসে কর্মরত ছিলেন তাঁদের বন্দী করা হয়, চাকরি থেকে বরখাস্ত করা হয়। এই গোপন কার্যকলাপে প্রচুর বাঙালি সম্পৃক্ত ছিল, আইয়ুব সরকার বুঝতে পারে এদের সবার বিরুদ্ধে মামলা চালানো অসম্ভব, তাই যাদের গ্রেফতার করা হয়েছিল তার মধ্য থেকে ৩৫ জনের বিরুদ্ধে আনুষ্ঠানিক মামলা দায়ের করা হয়।

জুনের প্রথম দিকে শওকত এবং তাঁর সাথের বন্দীদের নিয়ে যাওয়া হয় পাঞ্জাব অফিসার্স মেসে, ওখানে শেখ মুজিব, লে: মোয়াজ্জেম সহ আরও বন্দীরা আগে থেকেই ছিলেন। পাঞ্জাব অফিসার্স মেসে মোট তের জন কে রাখা হয় (শেখ মুজিব, তিনজন সিএসপি অফিসার, তিনজন নৌ অফিসার আর ছয় জন সেনা অফিসার)। ৩৫ জনের বাকি ২২ জনকে রাখা হয় পাঞ্জাব রেজিমেন্টের ইউনিট লাইনসে।

জানুয়ারিতে শওকতকে ধরে নিয়ে যাওয়ার পর হেনা মহা বিপদে পড়ে। একে তো মানসিক ভাবে বিপর্যস্ত, হাতে কোনো টাকা পয়সাও নেই - কি করবে দুই বাচ্চা সহ বিশ বছরের একটা মেয়ে এই বিদেশ বিভূঁইয়ে যার স্বামীকে ধরে নিয়ে গেছে - যাওয়ার আগে স্বামী বলে গেছে সে আর ফিরবে না। বাচ্চারা কি খাবে, কি হচ্ছে কিছুই বুঝতে পরে না, কোনো বাঙালি পরিবার আসে না খোজ করার জন্য। বাসায় কোন খাবার নেই - কি খাবে ওরা। পূর্ব পাকিস্তানে ফিরে আসার মত হাতে টাকা পয়সাও নেই। সপ্তাহ তিনেক পার হওয়ার পর, একদিন সেই কোয়েটার ক্যাপ্টেন রবের ছোট ভাই লেফটেনেন্ট সাদিকুল (সাদি) এলেন খুব গোপনে। ভাত মাছ আর আড্ডা দেওয়ার জন্যে শওকত পরিবারে তাঁর আসা যাওয়া ছিল। সে এসে খুব মন খারাপ করলো, হেনাকে বললো “শওকত ভাইকে ধরে নিয়ে গেছে, ভাবী আমি কি ভাবে আপনাদের সাহায্য করতে পারি।”
সাদির কথায় হেনা খুব খুশি হয়, একটা কিনারা খুঁজে পায়। শওকতের সেই প্রিয় ভেসপা, বাসার ফ্রিজ, টিভি, ফার্নিচার বিক্রি করার ব্যবস্থা করলো সাদি। ওগুলো বিক্রি করে বাচ্চাদের সহ পূর্ব পাকিস্তান ফেরার টিকেট কিনে দিলো - আর হেনার হাতে দিলো বাকি ৩০০০ টাকা। সাদি নিজে এলো গাড়িতে এয়ারপোর্ট নামিয়ে দিতে।

বাচ্চাদের নিয়ে করাচী থেকে ঢাকা ফিরে আসে হেনা ফেব্রুয়ারি প্রথম সপ্তাহে। অবাক ব্যাপার ওই সপ্তাহেই বন্দী অবস্থায় শওকতকেও রাওয়ালপিন্ডি থেকে ঢাকা আনা হয়েছিলো কিন্তু হেনা জানেনা শওকত কোথায় আছে, কি ভাবে আছে, বেঁচে আছে না মেরে ফেলেছে।

ঢাকা ফিরে অসুস্থ হয়ে পড়ে হেনা - গত এক মাস ঘুম আর খাওয়া দাওয়ার কোনো ঠিক ছিল না। মার কাছে গ্রামে সেই নড়িয়া চলে যায়। কিন্তু গ্রামের মানুষ নানা প্রশ্ন করে, কেন জেলে নিয়েছে, নিশ্চয়ই খারাপ কিছু করেছে নইলে বাড়ির মেয়ের জামাই কেন জেলে গেলো - তারা তো আর রাজনীতি বুঝে না। মাস খানেক মার কাছে বিশ্রাম নিয়ে, ছোট ছেলেকে গ্রামে মার কাছে রেখে বাবুকে নিয়ে ঢাকা চলে আসে হেনা - শওকতের খোজ খবর করার জন্য।

ঢাকায় থাকার কোনো জায়গা নেই, বাবুকে নিয়ে ঢাকায় আত্মীয় অনাত্মীয়ের বাসায় আশ্রয় নেয় হেনা, চেষ্টা করে শওকতের খোজ নিতে। ছয় মাস কোন খবর নেই শওকতের, কি অবস্থায় আছে বেঁচে আছে না কি মেরে ফেলেছে কিছুই জানেনা।


আগের পর্ব পরের পর্ব





Share on Facebook               Home Page             Published on: 16-Nov-2021

Coming Events: