ধ্রুব শিকড় - ৭ ফিরোজ আলী
আগের পর্ব        পরের পর্ব 
১৯৬৫ সালে মৌলিক গণতন্ত্রীদের ভোটের উপর ভিত্তি করে আবারো নির্বাচনের আয়োজন করা হয়। আইয়ুব খানের প্রতিপক্ষ হিসেবে দাঁড়িয়েছিলেন ফাতেমা জিন্নাহ। নির্বাচনে প্রায় সব বিরোধী দল মিলে ফাতেমা জিন্নাহকে সমর্থন দিয়েছিলেন। ফাতেমা জিন্নাহর হয়ে নির্বাচনী প্রচারণা করে ছিলেন শেখ মুজিবুর রহমান।
১৯৬৫ সালের ২ জানুয়ারির প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে জিতে যান আইয়ুব খান। বাঙালী শিক্ষিত আর তরুণ জনতার মধ্যে ক্ষোভ আর আক্রোশ তীব্র হতে থাকে। 'মৌলিক গণতন্ত্র' নামক প্রহসনের মাধ্যমে বিশাল জনগণকে তাদের ভোটাধিকার থেকে বঞ্চিত রাখা হয়। পশ্চিম পাকিস্তানের সাথে পূর্বের বৈষম্য নিয়ে কথা উঠতে থাকে।
ছাত্রদের মধ্যে রাজনৈতিক চিন্তা চেতনার উন্মেষ ঘটতে থাকে। ২রা জানুয়ারির নির্বাচনের পর - সামরিক বাহিনীর বাঙ্গালীদের মধ্যে পূর্ব পাকিস্তান স্বাধীন করার একটা চিন্তা মাথা চাড়া দিয়ে উঠে। শুধু মাত্র সেনাবাহিনী না, নৌ এবং বিমান বাহিনীর বাঙ্গালী সদস্যদের মধ্যেও এরকম একটা চিন্তা ভাবনা বিচ্ছিন্ন ভাবে দানা বাঁধতে শুরু করে। কিন্তু ৬৫ সালের প্রথম দিকে সিন্ধু প্রদেশের সীমান্তে Rann of Kuch এলাকায় সামরিক সংঘর্ষ আর সেপ্টেম্বর মাসে পাকিস্তান ভারত যুদ্ধের কারণে এই চিন্তা ভাবনা কিছুদিন চাপা থাকে।
শওকত এ সময়টায় নিজস্ব পরিকল্পনায় ব্যস্ত থাকে কিভাবে সশস্ত্র পন্থায় পূর্ব পাকিস্তানকে স্বাধীন করা যায়।পরিকল্পনাটা এমন ছিল, একটা নির্দিষ্ট দিনে (D day), একটা নির্দিষ্ট সময়ে (H hour), পূর্ব পাকিস্তানের সব সেনানিবাস এক যোগে কমান্ডো স্টাইলে আক্রমণ করে পশ্চিম পাকিস্তানীদের অস্ত্র কেড়ে নিয়ে, তাদের বন্দী করে শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে স্বাধীনতা ঘোষণা করা।
পাক ভারত যুদ্ধে শওকতের অবস্থান ছিল যুদ্ধের কৌশল গত ঘাঁটি ভৈরব বাজারে Ostrich নামক একটি জাহাজে। মাজেদা (হেনা) আর ফিরোজ (বাবু) তখন ঢাকা ক্যান্টনমেন্টের বাসায়। ১৯৬৬ সালের ফেব্রুয়ারিতে শেখ মুজিব লাহোরে পেশ করেন ছয় দফা, Ostrich জাহাজে থাকা অবস্থায় শওকত জানতে পারে ছয় দফার কথা। শওকতের মনে হয় ছয় দফা বাঙালির মুক্তির সনদ, বাঁচার দাবী।
এরপর ৬৬ সালের ফেব্রুয়ারির শেষে শওকতের পোস্টিং হয় কুমিল্লা ক্যান্টনমেন্টে। হেনা আর বাবুকে নিয়ে কুমিল্লার ময়নামতি ক্যান্টনমেন্টে নুতন সংসার। কুমিল্লা এসে তাঁর চিন্তা ভাবনাকে বাস্তব রূপ দেওয়ার জন্য সম মনা বাঙালি অফিসারদের সাথে যোগাযোগ করতে থাকে শওকত।
এখান থেকে আর কিছুদিন পিছনে ৬১ সালের প্রথম দিকে যাওয়া যাক। পাকিস্তান নৌবাহিনীর লেফটেন্যান্ট মোয়াজ্জেম (সেনাবাহিনীর ক্যাপ্টেন পদমর্যাদার অফিসার) করাচীর কার্সাজ (Karsaz) নৌ ঘাঁটিতে তাঁর কর্মস্থল। লিডিং সিম্যান নূর মোহাম্মদ আর লিডিং সিম্যান সুলতানুদ্দিন আহমেদ - দু জনই বিশেষ ভাবে প্রশিক্ষিত নৌ বাহিনীর সদস্য। এই দু‘ বন্ধু মাঝে মাঝে নিজেরা আলাপ করে পাকিস্তানিদের বৈষম্য নিয়ে - তাঁরাও ভাবেন স্বাধীনতার কথা। তাঁরা দুজন একদিন এলেন বাঙালি সম মনা লে: মোয়াজ্জেমের বাসায় দেখা করতে, আলাপ করেন তাঁর সাথে পূর্ব পাকিস্তানের স্বাধীনতার ব্যাপারে। মোয়াজ্জেম সায় দিলেন, মোয়াজ্জেম বলেন তিনিও এ ব্যাপারে চিন্তা ভাবনা করছেন, বললেন ঠিক আছে ' আমরা শুরু করি '। আরও কয়েক জন জোগাড় করে ফেললেন তাঁরা স্টুয়ার্ড মুজিব, লে: মোজাম্মেল। এই পাঁচজন প্রায়ই বসতেন, আলাপ আলোচনা করতেন কিভাবে তাঁদের পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করা যায়। মূল পরিকল্পনা হলো যে, একটি নির্দিষ্ট দিনে, নির্দিষ্ট সময়ে পূর্ব পাকিস্তানের বিভিন্ন স্থানে টার্গেট করে আক্রমণ করে দখল করে নিবে - স্বাধীনতা ঘোষণা করবে কিন্তু স্বাধীনতা ঘোষণা কে দিবে - জনগণকে সম্পৃক্ত করার জন্য রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বের দরকার। ১৯৬৪ সালের সেপ্টেম্বরে পত্রিকা মারফত তাঁরা জানতে পারে শেখ মুজিব করাচী আসছেন, থাকবেন সোহরাওয়ার্দী সাহেবের মেয়ের বাসায় 'লাখাম হাউজে '। সুলাতানুদ্দিন গেলেন শেখ মুজিবের সাথে দেখা করতে। সুলতানুদ্দিন শেখ মুজিবকে বললেন আমরা নৌ বাহিনীর কিছু লোক আপনার সাথে বসে চা খেতে চাই, আর কিছু কথা বলতে চাই। শেখ মুজিব পরের দিন বসার জন্য সময় দিলেন। শেখ মুজিব পরদিন সময় মত এলেন, সুলতানুদ্দিনের ভগ্নীপতি কামালউদ্দিন যে বাসায় থাকতেন ওই বাসায় তাঁরা বসলেন। ঐ পাঁচজন শেখ মুজিবকে বললেন আপনার সাহায্যের প্রয়োজন। মোয়াজ্জেম সাহেব বিস্তারিত পরিকল্পনা জানালেন, শেখ মুজিব পাঁচজনকে জড়িয়ে ধরে বললেন আমার শেষ রক্ত বিন্দু দিয়ে হলেও আপনদের সাথে থাকবো। আমার যা কিছু দরকার আমি করবো। ৬৫‘র জানুয়ারির রাষ্ট্রপতি নির্বাচনের পর শেখ মুজিব আবারও করাচী আসেন, এবার মোয়াজ্জেমের বাসায় তাঁরা আবার মিলিত হন, এই সভায় আরও নূতন সদস্য দেখা যায়, তাঁদের মধ্যে বিমান বাহিনী, সি এস পি অফিসারও ছিল। শেখ মুজিব ওই সভায় বলেন পশ্চিম পাকিস্তান থেকে আলাদা হওয়ার মাধ্যমেই পূর্ব পাকিস্তান জনগণ সম্মানের সাথে বাঁচতে পারবে, তিনি এই পরিকল্পনাকে পূর্ণ সমর্থন জানান।
মিটিং এর আগে মোয়াজ্জেম তাঁর স্ত্রী মিসেস কোহিনুর কে বলেন বাড়িতে কিছু মেহমান আসবে একটু ভালো চা নাস্তা দিও, মিসেস কোহিনুর কিছুই জানেন না কে আসবে কয়জন আসবে। বিভিন্ন মিটিং আলোচনায় মোয়াজ্জেম ব্যস্ত থাকে, তাঁর স্ত্রী মিসেস কোহিনূর বুঝতে পারে না মোয়াজ্জেম কি নিয়ে এত ব্যস্ত থাকে, আস্তে আস্তে বুঝতে পারেন তাঁর স্বামী পূর্ব পাকিস্তান স্বাধীন করার পরিকল্পনা করছেন। সামরিক বাহিনীর ডাক্তার ক্যাপ্টেন খুরশিদ নৌবাহিনীতে তখন ডেপুটেশনে করাচীতে পোস্টিং, সেও যুক্ত হয় ওই দলে। মাঝে মাঝে মোয়াজ্জেম ছদ্মবেশে করাচী থেকে রাতের ফ্লাইটে ঢাকা এসে রোববার সারাদিন ঢাকায় মিটিং করে আবার সোমবার করাচীতে অফিস করেন। খুরশিদ মোয়াজ্জেমকে মোটর সাইকেলে এয়ারপোর্ট নিয়ে যায় গোপনে। খুরশিদের ঘনিষ্ঠ বন্ধু ক্যাপ্টেন আলম একবার এলেন করাচী বেড়াতে, খুরশিদের ওখানেই একই মেসে উঠলেন। খুরশিদ একদিন আলমকে নিয়ে গেল মোয়াজ্জেমের বাসায়। এক জায়গায় কয়েকজন বসলে যা হয় - বাঙ্গালীদের বৈষম্য, গল্প গুজব - মোয়াজ্জেমের সাথে আলমের পরিচয় হলো। এরপর পাক ভারত যুদ্ধের পর ৬৬‘র প্রথম দিকে আলমের পোস্টিং হয় কুমিল্লায় - কুমিল্লা শহরে তাঁর অফিস, তাই শহরেই তাঁর বাসা। এর মধ্যে মোয়াজ্জেমের পোস্টিং হলো চিটাগাং, খুরশিদ আলমকে চিঠি পাঠালো মোয়াজ্জেম চিটাগাং বদলি হয়ে যাচ্ছে তাঁর সাথে যোগাযোগ করবে। কিছুদিন পর আলম ফোন পেলো মোয়াজ্জেমের কাছ থেকে। একটা কাজের জন্য আলমকে চিটাগাং যেতে হয়েছিল ওই সুযোগে মোয়াজ্জেমের সাথে দেখা করলো। মোয়াজ্জেম বললো আমি খুরশিদের কাছ থেকে শুনেছি আপনি সম মনা, আপনি আমাদের সাহায্য করতে পারবেন। মোয়াজ্জেম বললেন কুমিল্লায় সেনাবাহিনীর ভিতর বিপ্লবী সংস্থা গড়ে তুলতে হবে। পরবর্তী কাজের নির্দেশনা পরে দেওয়া হবে। আলম এক কথায় রাজী হয়ে গেলো।
ফিরে আসা যাক কুমিল্লায়, ৬৬‘র প্রথম দিকে শওকত কুমিল্লায় ইন্ডিপেনডেন্ট আমুনেশন প্লাটুনের কমান্ডিং অফিসার হিসেবে বদলি হয়ে এসেছে আর আলম কুমিল্লায় বদলি হয়ে এলো আর্মি মেডিক্যাল রিক্রুটিং অফিসার হিসেবে। আলমের প্রথম কাজই হলো শওকতকে এই সংগঠনে নিয়ে আসা। শওকতের সাথে আলমের আগেই পরিচয় ছিল, কোয়েটায় এক সাথে পোস্টিং ছিল ওখানেই প্রথম পরিচয়, আলাপ চারিতায় বুঝতে অসুবিধা হয় না শওকতের মনের ইচ্ছা। আলম শওকতকে বললো নৌ বাহিনীর লে মোয়াজ্জেম হোসেনের নেতৃত্বে নৌবাহিনীর বিভিন্ন পদের কয়েক জন বাঙালী মিলে একটা বিপ্লবী সংস্থা গঠন করেছেন, তারা সশস্ত্র পন্থায় পূর্ব পাকিস্তান স্বাধীন করার চিন্তা করছে। তারা চান সেনাবাহিনী এবং বিমান বাহিনীর বাঙালিদের সাথে মিলে এই পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করতে।
আলমের সাথে মিটিং এর এক সপ্তাহ পর আলমের বাসায় শওকতের দেখা হয় মোয়াজ্জেম আর স্টুয়ার্ড মুজিবের সাথে। তাঁদের বিপ্লবী চিন্তা ভাবনা এবং দেশ প্রেম শওকতকে মুগ্ধ করে। পূর্ব পাকিস্তানের সবগুলো সেনানিবাস আচমকা আক্রমণের শওকতের পরিকল্পনার সাথে মোয়াজ্জেম একমত পোষণ করে। আরও বাঙালি অফিসার এবং অন্যান্য পদের সৈনিকদের এই সংস্থার সাথে যুক্ত করার ব্যাপারে আলাপ হয় তাঁদের। কোনো আনুষ্ঠানিকতা ছাড়াই, বাংলাদেশের স্বাধীনতার জন্য তাঁরা সকলে বিপ্লবী সংস্থার সদস্য হন।
শওকত জানতো এবং বুঝতো তাঁরা যে পথে এগুচ্ছে তা প্রচণ্ড ঝুঁকি পূর্ণ, কিন্তু এ কাজ তাঁরা করছে দেশের প্রতি প্রচণ্ড ভালোবাসার তাগিদে। পশ্চিম পাকিস্তানিদের চোখে এ কাজ, এ পরিকল্পনা দেশদ্রোহিতার সামিল - জানাজানি হলে মৃত্যু দণ্ড হতে পারে।
বেলুচ রেজিমেন্টের ক্যাপ্টেন মোতালেব তখন কুমিল্লা ইপিআরে কর্মরত, তিনিও যুক্ত হোন এই দলে। আলম আর মোতালেবের বাসা কুমিল্লা শহরে ওখানেই তাঁরা বসেন প্রায়ই, শওকতের ময়নামতি সেনানিবাসে ভিতরে হওয়ায় ওখানে তাঁরা এই গোপন সভা এড়িয়ে চলেন। এরপর শওকত যোগাযোগ করে ঢাকায় অবস্থানরত ক্যাপ্টেন নাজমুল হুদার (৭ই নভেম্বর ' ৭৫ নিহত ) সাথে, যোগাযোগ করে নিজের কোরের ক্যাপ্টেন আব্দুল আলীমের সাথে। এরা সবাই যুক্ত হোন এই গোপন সংস্থার সাথে।
পরবর্তীতে কয়েক মাস মোয়াজ্জেমের সাথে কয়েকটি গোপন বৈঠক হয় ঢাকায় এবং কুমিল্লায় - আলম, হুদা, মোতালিব, আলিম, শওকত এই গোপন বৈঠকগুলোতে যোগ দিত। হুদা তাঁর বন্ধু চট্টগ্রামে সেনানিবাসে ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টাল সেন্টারে কর্মরত ক্যাপ্টেন নুরুজ্জামানের সাথে যোগাযোগ করেন। নুরুজ্জামানও যুক্ত হোন এই বিপ্লবী কর্মকাণ্ডে। শওকত আরও যোগাযোগ করে তাঁর কোর্সমেট এবং ঘনিষ্ঠ বন্ধু ক্যাপ্টেন মালেকের সাথে। মালেক তখন জয়দেবপুর ক্যান্টনমেন্টে দ্বিতীয় ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টে কর্মরত। তিনিও বললেন বাংলাদেশের স্বাধীনতার কোনও বিকল্প নেই, তিনিও রাজি হলেন বাঙালি অফিসার এবং সৈনিকদের সঙ্ঘবদ্ধ করার কিন্তু এও বললেন আরেকটু ধীরে চলার জন্য, উপযুক্ত সময়ের অপেক্ষার জন্য পরামর্শ দিলেন।
এর মধ্যে একদিন হুদার মাধ্যমে নুরুজ্জামান জানায় যে গোয়েন্দা সংস্থা আই এস আই (ইন্টার সার্ভিসেস ইন্টেলিজেন্স), এই গোপন কর্মকাণ্ডের কথা জানতে পেরেছে এবং তারা নজর রাখছে এই কর্ম কাণ্ডের উপর - নুরুজ্জামান ধীরে চলার পরামর্শ দেন। ৬৬‘র প্রথম দিকে হেনা আর বাবুকে নিয়ে শওকত যখন কুমিল্লায় আসেন এক সাথে বেড়াতে যেত তারা, রোববার ছুটির দিন বাজার করতো শওকত, এক সঙ্গে বাইরে খেতে যেত - আনন্দ আর সুখের সময় কাটছিল। ঢাকা থাকতে একটা ভেসপা কিনেছিল, সেটাতে হেনা আর বাবুকে নিয়ে বেড়াতে যায় এদিক ওদিক। কিন্তু কিছুদিন যেতে হেনা লক্ষ্য করে শওকত অফিস থেকে দেরি করে আসছে, অফিস থেকে এসে খাওয়া দাওয়া করে তাড়াহুড়ো করে চলে যাচ্ছে, বাবুকে নিয়ে বেড়াতে যেত সেটাও বন্ধ হয়ে গেল। হেনা জিজ্ঞাস করলে কিছু বলে না, হেনা খুব মন খারাপ করতো। তারপর একদিন বসিয়ে শওকত বললো, পূর্ব পাকিস্তানকে আলাদা করে আমরা বাংলাদেশ করবো - এমন একটা পরিকল্পনা আমরা করছি। শওকত হেনাকে আরও বললো ‘এ পরিকল্পনা জানাজানি হেয় গেলে যেহেতু আর্মিতে চাকরি করি দেশদ্রোহিতার মামলা হবে, সাজা মৃত্যু দণ্ড হতে পারে'। হেনা খুব কান্নাকাটি করছিল। হেনা অভিমান করে বললো আমার কথা না হয় না ভাবলে, কিন্তু তোমার এক বছরের বাবু আছে, তোমার বাবা, মা, ভাই বোন আছেন - তাঁদের কি হবে। তখন শওকত বলেছিল “তোমার বাবুর মত অনেক বাবুর বাবা থাকে না, তোমার মত অনেক মেয়ে বিধবা থাকে।” এরপর থেকে হেনা বুঝে নিয়েছিল এটাই তাঁর জীবন, এ জীবনকে মেনে নিতে হবে - এ ভাবেই নিজের মনকে বুঝায় হেনা।
ওদিকে মোয়াজ্জেম চাচ্ছে ৬৬ সালের শেষে তাঁদের পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করতে চান, তাঁদের পরিকল্পনা নাম দেয় অপারেশন অকওয়ার্ড মিডনাইট। পরিকল্পনা আরও অগ্রসর হলে ঠিক হয়, ঢাকা ক্যান্টনমেন্ট আঘাত হানবেন মোয়াজ্জেম আর সাথে থাকবেন শওকত, মোতালেব, ইপিআর দখল করবে নুরুজ্জামান, রেডিও স্টেশন সুলতানুদ্দিন, গভর্নমেন্ট হাউস হাবিলদার দলিলুদ্দিন - আরও অনেকে আরও বিস্তারিত একটা পরিকল্পনা।
ও দিকে শওকত এবং আলম লক্ষ্য করে মোয়াজ্জেম এবং নৌবাহিনীর সদস্যরা গোপনীয়তা রক্ষা করছেন না, খুব তাড়াতাড়ি সব কিছু করতে চাচ্ছেন, তাঁদের চলার ফেরা এবং আলোচনায় ধরা পড়ে যাওয়ার সম্ভাবনা আছে এবং কিছুটা শঙ্কার কারণ হয়ে দাড়ায়। এরকম একটা পরিস্থিতিতে হুদা, আলম, শওকত আর আলীম দাউদকান্দি ডাকবাংলোতে একত্রিত হয়। হুদা আলীম আসে ঢাকা থেকে, আলম আর শওকত আসে কুমিল্লা থেকে। তাঁদের স্ত্রীরাও যায় তাঁদের সাথে - যেন ফ্যামিলি ট্যুরে যাচ্ছে। হুদা জানায় পাকিস্তান কর্তৃপক্ষ তাঁদের তৎপরতা জেনে ফেলেছে, আই এস আই নজর রাখছে। মিটিঙে তাঁরা ঠিক করে কিছুদিন কার্যক্রম বন্ধ রাখবে এবং মোয়াজ্জেমকেও তাঁর কার্যক্রম বন্ধ রাখতে বলবে। কিন্তু মূল পরিকল্পনা ঠিক থাকবে, কৌশল গত কারণে কিছু দিন কার্য কলাপ বন্ধ রাখবে।
৬৬‘র শেষে মোয়াজ্জেম কুমিল্লা আসেন, শওকত আর আলমের সাথে বসেন। পরিকল্পনা আর তা বাস্তবায়নের কৌশল নিয়ে কিছুটা মত দ্বৈততা হয় তাঁদের মধ্যে। ১৯৬৭ সালের জানুয়ারিতে শওকতের বদলির আদেশ আসে, এবার করাচীর মালির ক্যান্টনমেন্টে - অর্ডনান্স স্কুলের ইন্সট্রাক্টর। এত ভালো এবং পছন্দের বদলি হয়েও শওকত খুশি হয় না। তাঁর মনে হয় কুমিল্লা থাকলে ভালো হতো - গোপন কার্যক্রম চালিয়ে যাওয়ার জন্য। ৬৭‘ র ফেব্রুয়ারি মাসে শওকত, হেনা আর বাবুকে নিয়ে পাড়ি জমায় করাচী- তাঁদের নূতন ঠিকানা ৫১ হায়দ্রাবাদ রোড, মালির ক্যান্টনমেন্ট।
করাচীতেও নানা মিটিং আলোচনায় ব্যস্ত থাকে শওকত, হেনাকে বলে বিভিন্ন ক্যান্টনমেন্টে যত বাঙালি আছে সবার সাথে যোগাযোগ হচ্ছে - তাঁদের গোপন পরিকল্পনা বাস্তবায়ন হবে নিশ্চয়ই, পূর্ব পাকিস্তান স্বাধীন করে বাংলাদেশ হবে একদিন। এ ভাবেই বাঙালিরা যে যেখানেই ছিল, যে পেশা বা যে পদেই ছিল, ধীরে ধীরে স্বাধীনতার চিন্তায় একত্রিত হয়েছিল।
আগের পর্ব        পরের পর্ব 
|