bangla-sydney
bangla-sydney.com
News and views of Bangladeshi community in Australia













ধ্রুব শিকড় - ৬
ফিরোজ আলী


আগের পর্ব পরের পর্ব

আজ হেনার বিয়ে। ৯ই ডিসেম্বর ‘১৯৬৩। বেপারী বাড়িতে আজ উৎসব। ঢাকা থেকে জেনারেটর আনা হয়েছে, আনা হয়েছে ডেকরেটর। আশ পাশের গ্রামে এমন ধুমধাম বিয়ে দেখা যায় নাই এর আগে।

বেপারীরা চার ভাই। তাঁদের পিতার নাম শমসের আলী বেপারী। বড় ভাই আলহাজ্ব মমিন আলী বেপারী, তাঁর জন্ম ১৯০০ সালে তৎকালীন ফরিদপুর জেলার (বর্তমান শরিয়তপুর) নড়িয়া গ্রামে। মমিন আলী বেপারী এলাকার সকলের শ্রদ্ধেয় একজন রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব, সমাজ সেবক এবং প্রতিষ্ঠিত ব্যবসায়ী, তিনি আওয়ামী লীগের স্থানীয় একজন নেতা। মুলফতগঞ্জ বাজার থেকে নড়িয়া বাজারের দিকে হেঁটে গেলে হাতের ডান দিকে পরবে এই বেপারী বাড়ি। ( পদ্মার করাল গ্রাসে এই বাড়ি এখন পানির নীচে )।

বিশাল সেই বাড়ির চত্বর - লোকজন গমগম করে সব সময় - সে এক এলাহি ব্যাপার। বড় রাস্তা থেকে ঢালু সরু পথ বেয়ে নেমে একটু এগুলেই একটা খাল, বর্ষা কালে পানি থৈথৈ করে, ছই তোলা নৌকাগুলো এসে ভিড় করে বেপারী বাড়ির ঘাটে। শীতকালে শুকনা খাল হেঁটেই পার হওয়া যায়। বাড়ির ঘাটে উঠে প্রথমেই চোখে পড়ে পারিবারিক কবরস্থানের দক্ষিণ পাশের দেয়াল ঘেঁষা চার পাঁচটা বড় বড় আম গাছ। এর মধ্যে একটা কাঁচা মিঠা আম গাছও আছে। ছোট ছেলেমেয়েরা ঢিল ছুড়ে আম পাড়ে, দু একটা ঢিল কবরস্থানের ভিতর যেয়ে পড়ে - মুরুব্বীরা বকা দেয়।

আরেকটু এগিয়ে গেলে একটা মাঠ। মাঠের পশ্চিম পাশে লম্বা কাচারি ঘর, পূব দিকে কবরস্থানের প্রবেশ দ্বার। বিকেল বেলা ছেলে মেয়েদের কলকাকলিতে সরব হয়ে উঠে এই মাঠ। দারিয়া বান্ধা, গোল্লা ছুট খেলে - 'আয়রে আমার টিয়া, আয়রে আমার গোলাপ ফুল' কত কি খেলা।

সন্ধ্যায় গৃহ শিক্ষক মোজাফফর স্যার বাড়ির ছেলে মেয়েদের পড়াতে বসেন কাচারি ঘরে।
আরেকটু উত্তরে এগুলে বাড়ির অন্দর মহল, উঠোনের চার দিকে চার ভাইয়ের টিনের দোতলা বাড়ি। উঠানের দক্ষিণ পশ্চিম কোণে লম্বা রান্না ঘর - একান্নবর্তী এই পরিবারের রান্না-বান্নার আয়োজন এখানেই হয় - সূর্য উঠার আগে মাটির চুলায় আগুন জ্বলে, নিভে অনেক রাতে। আরও সামনে এগুলে চোখে পড়ে বিরাট এক পুকুর “দু‘ধার উঁচু তার ঢালু তার পাড়”। পুকুরের দক্ষিণ দিকে এক বিশাল কদম গাছ, যখন কদম ফুটে গাছের ডাল নুইয়ে পুকুরের পানি ছুঁয়ে ছুঁয়ে যায়, সে এক দৃশ্য- ভোলার না। পুকুরের উত্তর দিকে অবারিত ফসল জমি, সরিষার মৌসুমে মনে হয় হলুদ নদীর প্লাবনে ভেসে গেছে দিগন্ত।

ঢাকা থেকে লঞ্চ এসে ভীরে পদ্মা পাড়ের ওয়াপদা ঘাটে, বর্ষার মৌসুমে লঞ্চ কীর্তিনাশা নদী বেয়ে আরও ভিতরে চলে যায় - কুত ঘরটা বায়ে রেখে নড়িয়া বাজার হয়ে ভোজেশ্বর।

মূল গল্পে ফিরে আসা যাক, বেপারী বাড়ীর সেজো ভাই আব্দুল ওয়াহেদের কন্যা মাজেদা, তাঁর ডাক নাম হেনা। পড়াশুনা শুরু মুলফতগঞ্জ মাদ্রাসার প্রাথমিক বিদ্যালয়ে। অত্র অঞ্চলে মেয়েদের ভাল স্কুল না থাকায় ওয়াহেদ ব্যাপারী মেয়েকে ঢাকা নিয়ে যান বড় ভাই মমিন আলীর পরামর্শে, ভর্তি করেন আরমানিটোলা গার্লস স্কুলে। মামার জিঞ্জিরা বাসায় থেকে পড়াশুনা করে মাজেদা। কিছুদিন পর ট্রান্সফার নিয়ে চলে আসে নাজিমুদ্দিন রোডের মুসলিম গার্লস স্কুলে, ওখানে হোস্টেলেই থাকার ব্যবস্থা। মাজেদার ডাক্তার হওয়ার ইচ্ছা, সাইন্সের সাবজেক্ট গুলো বেছে নেয় সে ক্লাস নাইনের শুরুতে। ম্যাট্রিক পরীক্ষার ছয়টা সাবজেক্টের পরীক্ষা শেষ এরকম একটা সময়ে মুনশি মোবারক আলী আর মালেকা বেগম এলেন বেপারী বাড়িতে, হেনাকে তাঁদের ঘরে তুলে নিবেন তাঁদের পুত্র শওকতের জন্য। মোবারক আলী হেনাকে জিজ্ঞাস করলেন “আচ্ছা মা মনে করো বাড়িতে শুধু ডাল আছে আর কোনও কিছু নাই কিন্তু মেহমান এসে হাজির - ডাল দিয়ে কি কি রাঁধবে ?” মাজেদা ডাল দিয়ে চারটা আইটেমের নাম বলে দিল চটপট। মুনশি মোবারক আলী আলহাজ্ব মমিন আলী বেপারীর দিকে তাকিয়ে অট্টহাসি দিয়ে বললেন আপনার ভাতিজি পাস করেছে। বুদ্ধিমান আর অতীব সুন্দরী মাজেদাকে মালেকা বেগম পছন্দ করেন তাঁর হবু পুত্রবধূ হিসেবে। মাজেদা বিয়েতে রাজি না কিছুতেই, পড়াশুনা শেষ করতে চায় সে - তবুও মুরুব্বিদের চাপে শেষ পর্যন্ত রাজি হতে হয় বিয়েতে।

ইতিমধ্যে শওকতের রাওয়ালপিন্ডি থেকে ঢাকার অর্ডন্যান্স ডিপোতে পোস্টিং হয়েছে ‘৬৩ সালের শেষ দিকে। ৬৩‘র ৯ ই ডিসেম্বর ক্যাপ্টেন শওকত আলী আর মাজেদার বিয়ে হয়। “উহুমনা উহুমনা - পালকিতে চড়ে নববধূ হেনা যায় - স্বপ্ন সুখে তাঁর চোখ দুটি যে উছলায়”। বেপারী বাড়ি থেকে মুনশি বাড়ি, চাকধ, মাইল খানেক দুর - শওকতের ভাইগ্না আলাউদ্দিন আর গ্রামের অনেক ছেলেমেয়ে পটকা আর বাজি ফাটিয়ে আনন্দ করতে করতে পালকির আগে আগে যায়। কি যে আনন্দ সেদিন নড়িয়াতে। মুনশিরা নববধূ হেনাকে বরণ করে নেয়।

কিছুদিন ঢাকা ক্যান্টনমেন্টে এক সাথে কাটিয়ে, ৬৪‘ র মাঝামাঝি শওকত চলে যায় করাচী একটা কোর্স করার জন্য আর মাজেদা চলে আসে তাঁর মায়ের কাছে নড়িয়ায়।

২৮শে ডিসেম্বর শওকত ফিরে আসে নড়িয়া, এরপর '৬৪ সালের ৩১সে ডিসেম্বর নড়িয়ার বেপারী বাড়িতে মাজেদার মা'র হাতে জন্ম হয় শওকত আর মাজেদার প্রথম সন্তান ফিরোজ শওকত আলীর (ডাক নাম বাবু)। ৭৬/২ স্টাফ রোড, ঢাকা ক্যান্টনমেন্টে শিশু ফিরোজকে নিয়ে শওকত আর মাজেদার নূতন সংসার। কি যে রোমান্টিক তাঁদের সেই সম্পর্ক, বাসায় যত বই আছে সব বইয়ের মলাটের নীচে লেখা শকু+হেনু।

শওকতের আবার বই পড়ার খুব শখ, এই শখটা সে পেয়েছে তাঁর বাবার কাছ থেকে। শওকতের মেঝ বোন মতি'র ছেলে আলাউদ্দিনকে খুবই স্নেহ করে শওকত - আদর করে ডাকে “এলান“। এলানকে নিজের কাছে নিয়ে এনে রাখে, আরমানিটোলা স্কুলে ভর্তি করে দেয়।

শওকত আবার বাংলা সিনেমার ভক্ত, মিষ্টি মেয়ে কবরীর প্রথম ছবি “সুতরাং” দেখতে যায় গুলিস্তান সিনেমা হলে। হেনা পছন্দ করে গান - যে কোন গানের প্রথম সুর শুনেই বলে দিতে পারে কোন গান। শওকতের বাবা মোবারক আলী আর মা মালেকা বেগম আসেন ছেলের বাসায় বেড়াতে। এভাবেই কেটে যায় শকু আর হেনুর প্রথম সংসার।


আগের পর্ব পরের পর্ব





Share on Facebook               Home Page             Published on: 16-Nov-2021

Coming Events: