bangla-sydney
bangla-sydney.com
News and views of Bangladeshi community in Australia













ধ্রুব শিকড় - ৫
ফিরোজ আলী


আগের পর্ব পরের পর্ব

বেলুচিস্তানের রাজধানী কোয়েটা (Quetta) শহরে সেদিন ভীষণ ঠাণ্ডা আর মেঘলা আকাশ। ৫৯‘র জানুয়ারির সেই সকালে সদ্য কমিশন প্রাপ্ত সেকেন্ড লেফটেন্যান্ট শওকত আলী জয়েন করে কোয়েটা ক্যান্টনমেন্টে।

অর্ডন্যান্স ইউনিটে বাঙালি সৈনিকদের মধ্যে আনন্দের উল্লাস বয়ে যায় সেদিন - একজন বাঙালি অফিসার তাদের ইউনিটে জয়েন করেছে এ খবর দ্রুত মুষ্টিমেয় বাঙালি সৈনিকদের মাঝে ছড়িয়ে যায়। আনন্দিত হয় তারা বাঙালি একজন অফিসারকে পেয়ে। অর্ডন্যান্স ইউনিটেও তখন পাঞ্জাবীদের আধিপত্য, আর একজন মাত্র বাঙালি অফিসার আছেন - লেফটেন্যান্ট মোসলেউদ্দিন। লেফটেন্যান্ট শওকতের ব্যাটম্যান (অফিসারদের সাহায্যকারী সৈনিক) নিয়োগ পায় বরিশালের এক তরুণ সিপাহী।

প্রথম রাতে নিজের বিছানায় শুয়ে বাবা মা‘ র কথা মনে পড়ে শওকতের, মনে পড়ে ভাই বোনদের কথা - কেমন আছে ওরা। মনে হয় নিজ দেশ থেকে অনেক দূরে, বিদেশ বিভূঁইয়ে চলে এসেছে সে। কোয়েটা ক্যান্টনমেন্টে অল্প কজন বাঙ্গালি অফিসার তখন। অন্যান্য ইউনিটের বাঙালি অফিসারদের সাথে আস্তে আস্তে পরিচিত হয় শওকত।

বিবাহিত বাঙালি অফিসারদের বাসায় ছুটির দিনে আড্ডা বসে, অবিবাহিত অফিসারদের সেই আড্ডায় নিয়মিত আসা যাওয়া। ভাবীদের হাতে রান্না করা ভাত মাছ, গানের আসর আর আড্ডায় শওকতও শরীক হয় ছুটির দিনে।

ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের ক্যাপ্টেন রব আর পারুল ভাবির সাথে শওকতের খুব ঘনিষ্ঠতা। তাঁদের বাসায় ছুটির দিনে বসে কন্ট্রাক্ট ব্রিজের আসর আর অবিরাম আড্ডা। পারুল ভাবি স্নেহ মমতায় ভাত মাছ খাওয়ান আর ব্যস্ত থাকেন আদর আপ্যায়নে। তাঁদের ভালোবাসায় প্রিয়জনদের থেকে দূরে থাকার কষ্ট ভুলে থাকে শওকত। শওকতের মনে হয় এই প্রবাসে তাঁরাই একান্ত আপন জন।

কোয়েটা শহরে বেসামরিক বাঙালি কর্মকর্তাদের সাথেও ঘনিষ্ঠতা হয় শওকতের। এরকম একজন ডাক্তার মহিউদ্দিন, তাঁর স্ত্রী ভাল গান করেন, ওখানেও প্রায়ই জমে ছুটির দিনে কন্ট্রাক্ট ব্রিজ, ভাত মাছ খাওয়া আর গানের আসর। শওকতের মনে হয় অল্প কিছুদিনের জন্য অন্য দেশে এসেছে সে, শিগগিরই নিজ দেশে ফিরে যাবে।

পশ্চিম পাকিস্তানী সহকর্মীদের সাথে কর্ম জীবন, প্রতিদিনের কাজ চলে স্বাভাবিক নিয়মেই।
অফিসার্স মেসে আড্ডা, কন্ট্রাক্ট ব্রিজ, টেবিল টেনিস, বিলিয়ার্ড খেলে আর মাঠে ফুটবল, হকি, ক্রিকেট খেলে শওকতের ব্যাচেলর জীবন কোয়েটা ক্যান্টনমেন্টে আনন্দ উৎফুল্লতায় কাটে। পশ্চিম পাকিস্তানি সহকর্মীদের সাথেও বন্ধুত্ব গড়ে উঠে, ঘনিষ্ঠতাও হয়। তবে বেশির ভাগ সহকর্মীদের মধ্যে ছিল বাঙালিদের প্রতি ঘৃণা, অবজ্ঞা আর করুণা। একই অফিসার্স মেসে থেকে কিংবা একই ইউনিটে কাজ করে, একই সামরিক শৃঙ্খলে থেকেও নিজেকে মনে হয় বিচ্ছিন্ন কেউ -

মনের ভিতর লুকিয়ে থাকা স্বাধীন হওয়ার চিন্তাটা মাথা চাড়া দিয়ে উঠে মাঝে মাঝে। বাঙালি সৈনিকদের মাঝেও পশ্চিম পাকিস্তানীদের আধিপত্য থেকে মুক্তি পাবার ইচ্ছা লক্ষ্য করে শওকত। বাঙালি সৈনিকরা পাকিস্তানিদের মনে করে শত্রু, ওরা পাকিস্তানীদের সাংকেতিক নাম
'পাইয়া' বলে ডাকে যা পাকিস্তান সেনাবাহিনীর বাঙালি সৈনিক দের মধ্যে প্রচলিত হয়ে যায় তখন।

৬০ সালের কোন এক রোববার দুপুরে ক্যাপ্টেন সরফুদ্দিন আহমেদের (এস ডি আহমেদ) বাসায় ব্যাচেলর ডাক্তার ক্যাপ্টেন শফিকুল কাদের আর শওকতের ভাত মাছের দাওয়াত। বৈচিত্র্যময় শিক্ষা, জ্ঞানের অধিকারী এস ডি আহমেদ। দুপুরের খাবার শেষে জমলো তিন জনের আড্ডা। আড্ডার এক পর্যায়ে তাদের আলাপে আসে পাকিস্তানিদের শাসন আর অর্থনৈতিক শোষণের কথা। এস ডি আহমেদ সিনিয়র, তিনিই কথা বলেন বেশি ওই আড্ডায়, তাঁর কথা শুনে মনে হয় পূর্ব পাকিস্তানের স্বাধীনতা সময়ের ব্যাপার মাত্র। তিনি এটাও চিন্তা করে রেখেছেন বন্দী বিনিময় হবে শ্রীলঙ্কার রাজধানী কলম্বোতে নৌপথে। জুনিয়র অফিসার দুজন এস ডি আহমেদের কথায় নিজেদের মনের কথা শুনতে পান। কিন্তু স্বাধীনতা কিভাবে হবে স্পষ্ট কোন পরিকল্পনা তাঁদের কারোরই নেই। তবুও ওই দুপুরে শওকত অনুভব করে সে একা নন - তাঁর মত আরও বাঙালি অফিসার আছেন যারা গোপনে স্বাধীনতার স্বপ্ন লালন করে। শওকত রোমাঞ্চিত হয়। এই আড্ডার পর শওকতের জীবনের লক্ষ্য হয়ে দাড়ায় বাংলাদেশের স্বাধীনতা। স্বাধীনতা অর্জনের আলাপ বিচ্ছিন্ন ভাবে হয় বাঙালি অফিসারদের মধ্যে কিন্তু কোন সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা ছাড়া। তবে বাঙালি অফিসার আর সৈনিকদের মধ্যে পাকিস্তানিদের চেয়ে শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণের এক অলিখিত ইচ্ছা বিরাজ করে সব সময়, আর তাই যখন ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট সামরিক মহড়া, খেলাধুলা, শারীরিক যোগ্যতায় চ্যাম্পিয়ন হয় অন্য ইউনিটের বাঙালিরাও তখন গর্বিত হয়।

ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের ব্রতচারী নৃত্য পাকিস্তান সেনাবাহিনীতে আলোড়ন সৃষ্টি করে, বাঙালি সংস্কৃতি প্রসারিত হয় সেনাবাহিনীতে আর এই কাজটির নেপথ্যে কাজ করেন কর্নেল এম এ জি ওসমানী। তিনি ছিলেন সব বাঙালির অভিভাবক, সেনাবাহিনীর বাঙালি অফিসার আর সৈনিকদের আদরের “চাচা” - সবাই সম্মান করে চাচা বলে ডাকে তাঁকে। সেনাবাহিনীর নিয়ম মেনে তিনি সব সময় সচেষ্ট থাকেন বাঙালির স্বার্থ রক্ষায়, আর সেজন্য তাঁকে প্রচণ্ড মূল্য দিতে হয়, তাঁর মত মেধাবী অফিসারকে কর্নেলের উপরে পদোন্নতি দেয়া হয় না। অবসরের আগে তাঁর শেষ নিয়োগ হয় রাওয়ালপিন্ডিতে আর্মি জেনারেল হেড কোয়াটার্সে, ডেপুটি ডিরেক্টর মিলিটারি অপারেশন। বাঙালি অফিসাররা সময় সুযোগ পেলেই ওসমানীর সাথে দেখা করেন রাওয়ালপিন্ডি ক্লাবের পাঁচ নম্বর রুমে, শওকতও যায় কর্নেল ওসমানীর সাথে দেখা করতে, কথা হয় নানা বিষয়ে, পাকিস্তানীদের অন্যায় বৈষম্যের কথা তাঁদের আলাপে স্বাভাবিক ভাবেই চলে আসে।

১৯৬২ তে ক্যাপ্টেন শওকতের বদলি হয় রাওয়ালপিন্ডি অর্ডিন্যান্স ডিপোতে। একবার জাতিসংঘের তত্ত্বাবধানে সামরিক বাহিনীর এক কন্টিনজেন্ট পাঠানো হবে কঙ্গোর গৃহ যুদ্ধে, শওকতের উপর দায়িত্ব পড়লো অর্ডিন্যান্স কোরের কয়েক জন সিপাহী নির্বাচন করার কিন্তু উপর থেকে চাপিয়ে দেয়া হলো এক তালিকা যাতে বাঙালি সৈনিকের কোন নাম নেই। শওকত এর প্রতিবাদ করে কোনো লাভ হলো না, শরণাপন্ন হলো কর্নেল ওসমানীর কাছে, শেষ পর্যন্ত পাঁচ জন বাঙালি সিপাহী কঙ্গো যেতে পারে।

করাচীর মালির ক্যান্টনমেন্টে যেতে হয় শওকতকে প্রায়ই বিভিন্ন ট্রেনিং এর জন্য। ওখানে অফিসার্স মেসে কন্ট্রাক্ট ব্রিজ প্রতিযোগিতা, শওকতের পার্টনার বাঙালি ডাক্তার মেজর মোহাম্মদ হোসেন। বাঙালি অফিসার যুগল টুর্নামেন্টে চ্যাম্পিয়ন হয়ে যায়, কিন্তু ট্রফি দেয়া হয় না তাঁদের - কারণ হিসাবে বলা হয় বাঙালিরা চ্যাম্পিয়ন হওয়ার যোগ্যতা রাখে না। এ রকম অসংখ্য ঘটনা শওকতকে রাগে ক্ষোভে ক্ষিপ্ত করে তুলে।

সময় যত যেতে থাকে, শেখ মুজিবুর রহমানের ওপর শওকতের আস্থা বাড়তে থাকে, ছাত্র জীবনে পল্টন ময়দানে মুজিবের বক্তৃতার কথা মনে পড়ে। তাঁর সাথে কোন কথা না বলেও শওকতের মনে হয় শেখ মুজিবও চান স্বাধীনতা এবং তিনি দিতে পারবেন দিক নির্দেশনা।


আগের পর্ব পরের পর্ব





Share on Facebook               Home Page             Published on: 16-Nov-2021

Coming Events: