ধ্রুব শিকড় - ৪ ফিরোজ আলী
আগের পর্ব পরের পর্ব
পশ্চিম পাকিস্তানের উত্তর পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশে কোহাট ক্যান্টনমেন্ট, ক্যান্টনমেন্টের ভিতর অফিসার্স ট্রেনিং (OTS) স্কুল। সেখানে কঠোর সামরিক প্রশিক্ষণে ব্যস্ত জেন্টলম্যান ক্যাডেট শওকত আলী।
উত্তর পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশের বর্তমান নাম ‘খাইবার পাখতুণখায়োয়া (Khyber Pakhtunkhwa)’। করাচী থেকে উত্তর উত্তর-পশ্চিমে, বিমানে দুই ঘণ্টার পথ কোহাট শহর। কাকুলে রয়েছে নিয়মিত সামরিক প্রশিক্ষণ কেন্দ্র ‘পাকিস্তান মিলিটারি একাডেমী’, এর পাশাপাশি অফিসার স্বল্পতা মেটানোর জন্য অস্থায়ী ভাবে চালু করা হয় ‘অফিসার্স ট্রেনিং স্কুল (OTS)’।
১৯৫৮ সালের মাঝামাঝি শওকত জয়েন করে সপ্তম ওটিস কোর্সে। সকাল বিকেল লেফট রাইট লেফট রাইট আর কঠোর প্রশিক্ষণের মাঝে, সামরিক দেয়ালের ওই চত্বরে শওকত খেয়াল করে তাঁর ব্যাচের ১০০ জন ক্যাডেটের মধ্যে মাত্র পাঁচজন বাঙালি আর পূর্ববর্তী ষষ্ঠ ব্যাচে মাত্র চার জন বাঙ্গালি - বেশির ভাগ ক্যাডেটই পাঞ্জাব প্রদেশের। ব্রিগেডিয়ার পদবীর কমান্ড্যান্ট সহ অন্যান্য প্রশিক্ষক অফিসার আর স্টাফ সবাই পশ্চিম পাকিস্তানী। নিয়মিত মিলিটারি একাডেমীতেও একই দৃশ্য - একজনও বাঙালি প্রশিক্ষকের দেখা মেলে না।
প্রশিক্ষণের সময় রাইফেল শুটিংয়ে একদিন শওকত বেশি নম্বর পেলে উইপেন্স ট্রেনিং অফিসার পাঠান ক্যাপ্টেন খুব প্রশংসা করলেন, অভিনন্দন জানিয়ে বললেন, “সাবাস এর আগে কোন বাঙালিকে এত ভাল শুটিং করতে দেখি নাই ” - এই প্রশংসার আড়ালে বাঙালি জাতির প্রতি অবজ্ঞা শওকতকে কষ্ট দেয়। আরেকদিন আসিফ নামে পাঞ্জাবী এক ক্যাডেটের সাথে বাঙালি জাতি নিয়ে বচসায় জড়িয়ে পড়ে শওকত, আসিফ এক পর্যায়ে বলে, “তুমি জানো তুমি কোথায় দাড়িয়ে কথা বলছো, এটা আমার দেশ আর তুমি তো বাঙালি”। আশ্চর্য হয়ে লক্ষ্য করে কারণে অকারণে বাঙালি জাতিকে হেও করা ওদের স্বভাবে পরিণত হয়েছে।
এরই মধ্যে চলছে প্রশিক্ষণ, কোর্স চলাকালীন সময়ে হঠাৎ একদিন ৫৮ ‘র অক্টোবরের ৭ তারিখে সেনাবাহিনী প্রধান জেনারেল আইয়ুব খান সামরিক আইন জারি করে বসলেন - তিনি হলেন প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক। অক্টোবরের শেষেই রাষ্ট্রপতি ইস্কান্দর মির্জাকে সরিয়ে জেনারেল আইয়ুব নিজেকে পাকিস্তানের রাষ্ট্রপতি হিসেবে ঘোষণা করলেন। পরদিন চিফ ইন্সট্রাক্টর লে: কর্নেল আব্দুর রহিম এলেন ক্লাস নিতে, তিনি ক্যাডেটদের রাজনীতিবিদদের চরম ব্যর্থতা আর পাকিস্তান রক্ষার জন্য সামরিক আইনের অপরিহার্যতা ব্যাখ্যা করলেন। তিনি আরও বললেন, সামরিক বাহিনী আর জেনারেল আইয়ুব খান সময়োচিত পদক্ষেপ না নিলে পাকিস্তানের জন্য সমূহ বিপদ অপেক্ষা করছিল, পাকিস্তানের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখা মুশকিল হতো।
মওলানা ভাসানী, শেরে বাংলা একে ফজলুল হক এবং হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী'র যুক্তফ্রন্ট সরকারকে ইতিমধ্যে সরিয়ে দেয়া হয়েছে। আইয়ুব খান ক্ষমতা দখল করায় এটা পরিষ্কার হয়ে যায় - পশ্চিম পাকিস্তানীরা বাঙ্গালীদের ক্ষমতায় বসতে দিবে না।
সেদিন ক্যাডেটদের উন্নত মানের ডিনার পরিবেশন করা হলো। সারাদিনের কঠিন পরিশ্রমের পর নৈশভোজ সেরে নিজ রুমে শুয়ে বিক্ষুব্ধ শওকত ভাবে- পাকিস্তান থেকে পূর্ব পাকিস্তানকে বিচ্ছিন্ন করে একটি স্বাধীন রাষ্ট্র বের করার পথ বের করতেই হবে।
আগের পর্ব পরের পর্ব
|