ধ্রুব শিকড় - ৩ ফিরোজ আলী
আগের পর্ব পরের পর্ব
ঢাকা শহরে তখন ট্রাফিকের ব্যস্ততা নেই, রাস্তায় অল্প কিছু রিকশা আর গাড়ির চলাচল, পথচারীদের নেই কোন তাড়াহুড়ো। ধানমন্ডি এলাকায় বসতি শুরু হয়েছে মাত্র, নিউ মার্কেট তখনও ব্যস্ত বিপণী কেন্দ্র হয়ে উঠেনি। ঢাকা স্টেডিয়াম নির্মিত হচ্ছে ক্রিকেট ম্যাচ আয়োজনে, ওয়াইজ ঘাটে ভিড় করে মানুষ বুড়িগঙ্গা তীরের প্রাকৃতিক শোভা উপভোগ করার জন্য। ঢাকা তখন পূর্ববাংলার রাজধানী।
গ্রামের ছেলে শওকত ১৯৫৩‘র মাঝামাঝি ঢাকার জগন্নাথ কলেজে ভর্তি হয় আই এস সি ক্লাসে, উচ্চ শিক্ষার আশায়। ঢাকা এসে শহুরে পরিবেশে খাপ খাওয়াতে খুব কষ্ট হয় তাঁর। ওদিকে বাবা মুনশি মোবারক আলীর স্বাস্থ্য ভেঙ্গে পড়ছিল, সংসারের আয়ও কমে আসে। মোবারক আলীর পক্ষে শওকতের কলেজে পড়ার খরচ, কলেজের হোস্টেল কিংবা মেসে থাকার খরচ জোগানো অসম্ভব হয়ে পড়ে। অগত্যা ঢাকা শহরের শেষ প্রান্তে হাজারীবাগে শওকত একটা লজিং যোগাড় করে। হাজারীবাগ থেকে জগন্নাথ কলেজ অনেক দূর সাত আট কিলোমিটার হবে, প্রতিদিন হেঁটে কলেজে যায় সে। থাকা খাওয়ার ব্যবস্থা তো হলো কিন্তু যাকে পড়ানোর জন্য এই লজিং তাকে বশ মানানো কঠিন, ক্লাস সেভেনের এই অবাধ্য ছেলেকে পড়ানো অসাধ্য হয়ে দাড়ায়। যাক এই কঠিন পরিস্থিতি থেকে পরিত্রাণ পাওয়া যায় যখন জগন্নাথ হলের কাছে এক দূর সম্পর্কের আত্মীয়ের বাসায় থাকা খাওয়ার ব্যবস্থা হয়।
বাড়ির বড় ছেলে সে, বাবা আর সংসারের প্রতি দায়িত্ব বোধ থেকে পড়াশুনার পাশাপাশি চাকরি খুঁজতে লাগলো। পুলিশ ডাইরেক্টরেটে নিম্নমানের সহকারীর চাকরিও পেয়ে গেল একটা। তিন মাসের অস্থায়ী চাকরিটা পেয়ে খুব ভাগ্যবান মনে হলো, ৯০ টাকা বেতনের ৫০ টাকা বাবাকে পাঠাতে লাগলো শওকত। তিন মাস পর চাকরিটা স্থায়ী হয়ে যায়। সকাল দশটা থেকে পাঁচটা অফিস তারপর হেঁটে কলেজ, মাঝে পল্টনে জনসভা থাকলে বক্তৃতা শোনা কিংবা পল্টন ময়দানের পাশেই ফুটবল খেলা দেখা।
ওই সময় মাওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানী মজলুম জননেতা আর শেখ মুজিবুর রহমানকে বিপ্লবী নেতা বলে উল্লেখ করা হতো - দুই নেতার কণ্ঠে বাঙালির কষ্টের কথা উচ্চারিত হতো - তাঁদের মুখে পূর্ব বাংলার স্বায়ত্তশাসনের দাবী শওকতকে উদ্বেলিত করতো। বাবার মুখে এই দুজনের কথা শুনেছে আগে, এখন সামনা সামনি এই দুজনের বক্তৃতা মুগ্ধ হয়ে শুনে।
রাতের বেলা বিজ্ঞান বিভাগে পড়ার কোন সুযোগ ছিল না তাই বাধ্য হয়ে জগন্নাথ কলেজ ছেড়ে কায়েদে আজম কলেজে রাত্রি কালীন আই কম ক্লাসে ভর্তি হতে হলো তাঁকে, এক বছর পিছিয়ে শওকত খুব হতাশ হয়ে পড়লো, মনে হতে লাগলো পড়াশুনা আর হবে না - পরীক্ষার বেশী বাকি নাই এখনও অনেক বই কেনা হয় নাই, কলেজের বেতনও বাকি। আর্থিক এবং মানসিক এই বিষণ্ণ অবস্থায় পরিচয় হলো তৎকালীন পুলিশের উপ মহাপরিদর্শক এম এ আব্দুল্লাহর সাথে। চির কুমার ডি আই জি আব্দুল্লাহর জীবন-প্রণালি ছিল কঠোর। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এম এ পাশ করে উনি ইন্ডিয়ান পুলিশ সার্ভিসে যোগ দেন, চাকরি অবস্থায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এল এল বি পাশ করে উচ্চ শিক্ষার জন্য যুক্তরাজ্যে যান এবং ফিরে এসে ঢাকা হাই কোর্টে আইন ব্যবসা শুরু করেন। তিনি সব সময় বাইসাইকেল চলাচল করতেন - থাকতেন হাটখোলাতে একাকী। তিনি হয়ে উঠেন শওকতের ফ্রেন্ড ফিলোসফার অ্যান্ড গাইড। তিনি শওকতের সমস্যার কথা জানতে পেরে বাকি বইগুলো কিনে দেন, কলেজের পাওনা, পরীক্ষার ফি মিটিয়ে দিলেন। আই কম পরীক্ষায় শওকত প্রথম বিভাগে পাশ করলো, শুধু তাই না ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মেধা তালিকায় তাঁর অবস্থান হলো ২০ তম। সে সময় ইন্টারমিডিয়েট পরীক্ষা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে হতো। আশাতীত ফলাফলে শওকত বিস্মিত হয়েছিল, আবদুল্লাহ সাহেবও খুব খুশি হলেন। তিনি বি কম ক্লাসের ভর্তির টাকা দিলেন, বই কিনে দিলেন - শওকত আবার নিজের উপর আস্থা ফিরে পেলো। এই সময় শওকত সচিবালয়ে কৃষি বিভাগে আরেকটা চাকরির আবেদন করে পেয়ে যায় চাকরিটা - বেতন এবার ১০৫ টাকা।
বি কম ক্লাসের সময় শওকত গোপনে ছাত্র রাজনীতির সাথে যুক্ত হতে থাকে, রাজনৈতিক আলোচনা তাঁর ভাল লাগে - মনে হয় মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য রাজনীতির বিকল্প নেই। বি কম পড়ার সময় পরিচয় হয় তৎকালীন ছাত্র নেতা শাহ মোয়াজ্জেমের সাথে। সেও শওকতের মত দিনে সচিবালয়ে চাকরি আর রাতে ক্লাস করে। শাহ মোয়াজ্জেম শওকতকে ছাত্রলীগের রাজনীতির সাথে পরিচয় করিয়ে দেয়, একদিন কয়েদে আজম কলেজে ছোট একটা সভা করে শওকতকে বানিয়ে দেন ওই কলেজ শাখার ছাত্রলীগের আহ্বায়ক। হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী তখন পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী, পূর্ব পাকিস্তানে আতাউর রহমান খানের নেতৃত্বে মন্ত্রীসভা।
ইতিমধ্যে আবদুল্লাহ সাহেবের পরামর্শে শওকত সেনাবাহিনীর কমিশন পদে আবেদন করে এবং চূড়ান্ত ভাবে নির্বাচিত হয়। কায়েদে আজম কলেজের ছাত্রলীগের আহ্বায়ক শওকত আলী, গ্রামের ছেলে শওকত আলী - এবার ঢাকা থেকে ২০০০ কিলো মিটার দূরে পশ্চিম পাকিস্তানের উত্তর পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশের কোহাট ক্যান্টনমেন্টে প্রশিক্ষণের জন্য পাড়ি জমায়। শওকতের ঢাকা আসা, জীবন সংগ্রাম, আবদুল্লাহ সাহেবের সাথে পরিচয়, সেনাবাহিনীতে যোগদান এ সবই যেন একের পর ঘটতে থাকে কোন এক অমোঘ লক্ষ্যকে উদ্দেশ্য করে!
আগের পর্ব পরের পর্ব
|