ধ্রুব শিকড় - ২ ফিরোজ আলী
আগের পর্ব পরের পর্ব
বাবু মনমোহন বসুর পাঠশালায় শওকত আলীর হাতেখড়ি, সেটা ১৯৪২ সালের কথা। মনমোহন বসুর বাড়ী পার্শ্ববর্তী চাকধ গ্রামে, বাড়ী থেকে প্রায় এক কিলোমিটার দূরে। প্রতিদিন শওকত আলী গ্রামের কাঁচা রাস্তা ধরে হেটে যান সেই পাঠশালায়, বয়োবৃদ্ধ মনমোহন বাবু অতি যত্ন করে শওকত আলীকে পড়ান। আর মৌলভি মোহাম্মাদ সফিউল্লাহ ছিলেন ধর্মীয় শিক্ষক, কোরান শিক্ষা দেন নিয়মিত, নয় বছর বয়সে পবিত্র কোরান খতম করেন তিনি।
শওকত আলীর পড়াশুনার প্রতি উৎসাহ দেখে মনমোহন বাবু একদিন বাবা মোবারক আলীকে ডেকে বলেন ছেলে তো লেখা পড়ায় খুব ভাল করছে, সে ভবিষ্যতে আরও ভাল করবে – সে যেন পড়াশুনার সব ধরনের সুযোগ পায়। মুনশি মোবারক আলী কথা দেন সে তাঁর সাধ্য মত চেষ্টা করবেন।
এ সময় শওকতের সখ্যতা গড়ে উঠে মনমোহন বসুর ছেলে নারায়ণ চন্দ্র বসুর সাথে। নারায়ণ বয়সে কয়েক বছরের বড় হলেও তাঁদের ভাব জমে উঠে। নারায়ণ ছিলেন নাট্যকার – শওকতের নাট্য গুরু, শওকতকে নাটকের অভিনয় শেখান। লোণসিং গ্রাম তখন খেলাধুলা, নাটক, যাত্রা আর বিভিন্ন সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডে মুখরিত। নারায়ণ দা লোণসিং ড্রামাটিক সোসাইটির প্রযোজিত কয়েকটি নাটকে অভিনয় করার সুযোগ করে দেন শওকতকে। নাট্য অভিনয়ে অসম্ভব ঝোঁক শওকতের, মহারাজ নন্দকুমার আর টিপু সুলতান নাটক নিয়মিত মঞ্চস্থ হয় তখন, সেই নাটকে শওকত যথাক্রমে গুরুদাস আর আব্দুল খালেকের ভূমিকায় অভিনয় করেন। সে সময় অভিনেত্রী পাওয়া ছিল দুষ্কর, মায়ের রঙ আর বাবার গড়ন পাওয়া সুদর্শন কিশোর শওকতকে কখনও কখনও নারী চরিত্রেও অংশ নিতে দেখা যায়। আরও বড় হলে মহারাজ নন্দ কুমার আর টিপু সুলতান এর নাম ভূমিকায় অভিনয় করেন শওকত। কাবাডি আর ফুটবল খেলাতেও তাঁর নেশা, সুযোগ পেলেই ছুটে যান মাঠে। হিন্দু,মুসলিম সমবয়সী বন্ধু, পাড়া প্রতিবেশী আর বাবা মার আদরে গ্রামের মুক্ত হাওয়ায় বেড়ে উঠেন শওকত।
বাবু মনমোহনের পাঠশালা পর্ব শেষে শওকত আলী লোনসিং উচ্চবিদ্যালয়ে ভর্তি হন তৃতীয় শ্রেণীতে। সে সময় ভারতবর্ষে সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয় ১৯৪৫ইং সালের ডিসেম্বর মাসে। তখন শওকত আলীকে দেখা যায় চাকধ, মুলফতগঞ্জ এলাকায় স্থানীয় মুসলিম লীগ প্রার্থীর পক্ষে নির্বাচনী প্রচারে, দেখা যায় মিছিলের সর্বাগ্রে। এই নির্বাচনের ফলাফলের উপর ভিত্তি করে মুসলিম লীগের দাবী জোরালো হয় যে তারাই ভারতবর্ষের মুসলিম জনগোষ্ঠীর প্রতিনিধি - পাকিস্তান নামক এক নূতন রাষ্ট্র সৃষ্টির পথ তৈরি হয়। পাকিস্তান রাষ্ট্র সৃষ্টির সম্ভাবনা মুনশি মোবারক আলী সহ মুসলিম জনগোষ্ঠীকে রোমাঞ্চিত করে কিন্তু ঐ এলাকায় কোন সম্প্রদায়ীক দাঙ্গার কথা শোনা যায় না।
৪৭ সালের ভারত বিভক্তির পর শওকত হারাতে থাকে অনেক ঘনিষ্ঠ হিন্দু বন্ধুদের। যে লোনসিং ছিল খেলাধুলা, নাটক, যাত্রা আর সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডে মুখরিত – সেই লোনসিং হয়ে যায় নিস্তব্ধ, নীরব। বাবু মনমোহন বসু আর তাঁর ছেলে নারায়ণ চন্দ্র বসুর ভারত চলে যাওয়া কিশোর শওকতের মনে ভীষণ দাগ কাটে- মেনে নিতে কষ্ট হয় তাঁর। বাবু মনমোহনের সাথে শওকতের আর কোনদিন দেখা হয় না কিন্তু তাঁর আদেশ, উপদেশ, শিক্ষা শওকতকে সামনে এগিয়ে যেতে অনুপ্রাণিত করে আজীবন। বাঙ্গালী মুসলিমদের পাকিস্তান সৃষ্টির এই উল্লাসে ভাটা পরে ১৯৪৮ সালের মার্চ মাসে, যখন জিন্নাহ সাহেব ঘোষণা দেন “কোনো ভুল করবেন না, রাষ্ট্র ভাষা একটিই হবে আর সেটা হবে উর্দু এবং শুধুই উর্দু”।
আগেই বলেছি মোবারক আলীর ব্যবসা ছিল পটুয়াখালীতে, সেখানে তাঁর নিয়মিত যাতায়াত। তাঁর দ্বিতীয় কন্যা মতি, তাঁর স্বামীর কর্মস্থল পটুয়াখালীর খেপুপাড়ায় - ওখানেই মতি’র সংসার। শওকত আলী দশম শ্রেণীতে থাকতে চলে যান খেপুপাড়া বোনের বাসায়। বোন তাঁকে খুবই স্নেহ করেন, মা‘র কাছ থেকে দূরে থাকার কষ্ট অনুভব করতে দেন না। খেপুপাড়া উচ্চ বিদ্যালয় থেকে শওকত ম্যাট্রিক পাশ করেন ১৯৫৩ সালে।
সে সময়,দশম শ্রেণীর ছাত্র শওকতকে আবার দেখা যায় মিছিলে। স্লোগানে মুখরিত হয় খেপুপাড়া শহর ‘ রাষ্ট্র ভাষা বাংলা চাই ‘। ৫২‘ র ২১ শে ফেব্রুয়ারিতে ঢাকায় ছাত্র হত্যার প্রতিবাদে খেপুপাড়া স্কুলের ছাত্ররা মিছিলের আয়োজন করে, সাধারণ জনগণ স্বতঃস্ফূর্ত ভাবে সে মিছিলে যোগ দেয় - প্রতিবাদ জানায় মুসলিম লীগ সরকারের নিষ্ঠুর ছাত্র হত্যার। ১৯৪৮ থেকে যে ভাষা আন্দোলনের শুরু, ১৯৫২ সালের ২১ শে ফেব্রুয়ারিতে এসে বাঙালি জাতি নিজেদের চিনতে পারে, বুঝতে পারে তারা নিজেরাই একটি ঐতিহ্যবাহী সুপ্রাচীন গর্বিত জাতি। শওকত আলী উপলব্ধি করেন যে দ্বিজাতি তত্ত্বের উপর ভিত্তি করে পাকিস্তান রাষ্ট্রের সৃষ্টি হয়েছে তা মূলত একটা সম্প্রদায়ীক অস্ত্র। বিস্ময়ের ব্যাপার, মুনশি মোবারক আলী যিনি একজন ধর্ম প্রাণ মুসলিম, তিনি নিজেও ভাষা আন্দোলনের একজন সমর্থক হয়ে গেলেন। তাঁর মনে হলো বাঙালির এই দাবি ন্যায্য দাবি। তাঁর পুত্র শওকত আলী মুসলিম লীগ বিরোধী মিছিলে অংশ নেওয়ায় তিনি গর্ববোধ করলেন।
বাবা আর ছেলে খেপুপাড়ায় এক সন্ধ্যায় বসে নানা বিষয়ে গল্প করছিলেন, সে গল্পে সমসাময়িক রাজনীতিও স্থান পায়। মুনশি মোবারকের কথায় তৎকালীন মুসলিম লীগ সরকারের প্রতি বিরূপ মনোভাব প্রকাশ পায়, তিনি কঠোর সমালোচনা করেন মুসলিম লীগ সরকারের। তিনি ক্রমশ নব্য গঠিত পূর্ব বাংলা আওয়ামী মুসলিম লীগের সভাপতি মাওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানী আর সাধারণ সম্পাদক শেখ মুজিবের উপর আস্থা খুঁজে পান।
অনেকদিন আগে মোবারক আলী বাবু মনমোহনকে কথা দিয়েছিলেন, শওকত আলীকে পড়াশুনা করার সব ধরনের সুযোগ করে দিবেন, নিজের আর্থিক অবস্থার অবনতি হতে থাকলেও তিনি সাধ্যমত চেষ্টা করেছেন তাঁর কথা রাখতে কিন্তু তাঁর চেয়েও বড় কথা মুনশি মোবারক আলী একটা সুস্থ সুন্দর সাংস্কৃতিক পরিবেশে শওকত আলীকে বড় হওয়ার সুযোগ করে দিয়েছিলেন। যে মুক্ত মন আর অসাম্প্রদায়িক চিন্তা চেতনা নিজে লালন করেছেন - সন্তানকেও সেই শিক্ষাই দিয়েছেন। অন্যায়ের প্রতিবাদ করতে উৎসাহ দিয়েছেন, মানুষের পাশে দাঁড়ানোর কথা বলেছেন – শিখিয়েছেন মাথা উঁচু করে দাঁড়াবার। আর এই মূল্যবোধ আর শিক্ষা থেকেই ভবিষ্যতে একদিন, শওকত আলী সেনানিবাস দখল করার গোপন পরিকল্পনায় সামিল হয়, হাতে তুলে নেয় অস্ত্র - স্বাধীনতার।
আগের পর্ব পরের পর্ব
|