ধ্রুব শিকড় - ১ ফিরোজ আলী
পরের পর্ব
সে এক বিরাট দিঘী, এপার থেকে ডাক দিলে ওপারে শোনা যায় না। বর্ষাতে পানি থই থই করে আর শীতের সময় জমে অতিথি পাখীর ভিড়। দিঘীর নাম “বাহের দিঘী”। দিঘীর চার পাড়ের বসতি নিয়ে একটি সবুজ গ্রাম- গ্রামের নাম “লোনসিং বাহের দিঘির পাড়”। সবুজ গাছ পালার মাঝে গড়ে উঠেছে বসত বাড়ী, সংসার। কাঁচা রাস্তার দু ধারে চিকন খাল চলে সমান্তরাল, বর্ষাতে সাঁকো দিয়ে পাড় হতে হয় খালের এপার ওপার। আর আছে দিগন্ত বিস্তৃত আইল বাধা ফসলের জমি - এই নিয়ে এই গ্রাম।
গ্রামের অধিকাংশ মানুষই মুসলমান। মুনশি আব্দুল করিম এই গাঁয়েরই বাসিন্দা। আব্দুল করিম একজন প্রভাবশালী এবং সম্পদশালী ব্যক্তি। গ্রামের অল্প ক’জন শিক্ষিত মানুষের মধ্যে তিনি একজন। তাঁর বুদ্ধিমত্তা আর শিক্ষার কারণে গ্রামের সবাই তাকে শ্রদ্ধা করেন, মুনশি সাহেব বলে ডাকেন। তাঁর পরিবারের মুনশি উপধাটি এখান থেকেই প্রাপ্তি। মুনশি আব্দুল করিমের বাড়ীর মাঝখানে বিরাট উঠান, উঠানের চার পাশে কাঠের বাড়ী। বাড়ীর মূল আঙ্গিনায় ঢুকতে গিয়ে বাম পাশে আরেকটা লম্বাটে ঘর, যার নাম কাচারি ঘর - যেখানে খুব ভোঁরে ফজর নামাজের পর মসজিদের ইমাম বাচ্চাদের কোরান শিক্ষা দেন। “আলিফ যবর আ আলিফ পেশ উ” – বাচ্চাদের সমস্বরে এই কলতান দূর থেকে শোনা যায়। সন্ধ্যায় গ্রামের লোকজন কাচারি ঘরে বসে মুনশি সাহেবের সাথে আলাপ আলোচনা করেন, বুদ্ধি পরামর্শ নেন। তখন দেশে ইংরেজদের রাজত্ব, ইংরেজরা ইতিমধ্যে একশত বছর ভারতবর্ষ শাসন করে ফেলেছে, ইংরেজ রাজের বিরুদ্ধে মানুষের বিক্ষোভের দানা জোড়াল হচ্ছে। খবর পাওয়া যায় উত্তর প্রদেশে ভারতীয় সেনাবাহিনীর সিপাহীরা বিদ্রোহ করেছে আর তার রেশ ছড়িয়ে পড়ছে চারদিকে। মুনশি আব্দুল করিমের জীবনকাল সে রকম একটা সময়ে। লোনসিং বাহের দিঘীর পাড় বর্তমান শরিয়তপুর জেলার নড়িয়া উপজেলায় অবস্থিত। কীর্তিনাশা নদীর অববাহিকায় গড়ে উঠা এই জনপদে জীবন ভীষণ সহজ সরল, বাঙালী পনার ছাপ সর্বত্র।
ফিরে যাওয়া যাক আমার কাহিনীতে, মুনশি আব্দুল করিমের পুত্র মুনশি নুর মোহাম্মদের জন্ম এই বাড়িতেই। নূর মোহাম্মদ বড় হলে, একদিন করিম সাহেব নূর মোহাম্মদকে ডেকে বললেন – সেই আগের দিন আর নাই - যত দিন যাচ্ছে এই ইংরেজদের রাজত্বে দেশের অবস্থা দিন দিন আরও খারাপ হচ্ছে, আমি আর পারছি না - তুমি ব্যবসা পাতি আর জমিজমা বুঝে নেও। নূর মোহাম্মদ দায়িত্ব বুঝে নিলেন।
মুনশি নূর মোহাম্মদের সন্তান মুনশি মোবারক আলীরও জন্ম তাঁদের এই পৈত্রিক বাড়ীতেই। বাহের দিঘীর পাড় গ্রামটি যদিও মুসলমান অধ্যুষিত ছিল, আশপাশের গ্রামে ছিল প্রচুর হিন্দু পরিবার। মুনশি মোবারক আলী বেড়ে উঠেন এমন এক অসাম্প্রদায়িক পরিবেশে যেখানে ধর্ম কোন বাধ সাজে না তাঁর হিন্দু বন্ধুদের সাথে অবাধ মেলা মেশায়। সেখানে ধর্ম মানুষে মানুষে কোন ব্যবধান তৈরি করে না। ধর্মীয় শিক্ষায় খুব ছোট বেলা থেকে শিক্ষিত হয়েছিলেন মুনশি মোবারক আলী, মসজিদের নিয়মিত ইমামের অনুপস্থিত থাকলে তাকেই ডাকা হতো ইমামতির জন্য। শান্ত, সৌম্য, শ্যাম বর্ণের মোবারক আলী যখন তাঁর শ্বেত শুভ্র টুপিটা মাথায় দেন তাঁর মধ্যে এক মুন্সিয়ানা ফুটে উঠে। ছোট বেলা থেকেই তিনি ছিলেন সকলের শ্রদ্ধেয় আর আস্থাভাজন। মোবারক আলী বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন সুন্দরি মালেকা বেগমের সাথে। মালেকা বেগম ছিলেন উলটো – দুধে আলতায় গায়ের রঙ তাঁর, সদা চঞ্চল, সদা ব্যস্ত। তরুণী মালেকা বেগম সবাইকে ব্যতিব্যস্ত রাখেন তাঁর স্বভাব সুলভ উচ্ছলতায়। মুনশি মোবারক আলী তাঁর পৈত্রিক ব্যবসা আর জমিজমা বুঝে নেন তাঁর বাবা মুনশি নূর মোহাম্মদের কাছ থেকে। বাহের দিঘীর পাড়ের ঐ পৈত্রিক বাড়িতেই তাঁদের সুখের সংসার। গ্রামের অনেকের তুলনায় তাঁদের আর্থিক অবস্থা ভাল হলেও আগের সেই সম্পদ আর তাঁদের নাই। পটুয়াখালীতে মোবারক আলীর ব্যবসা, সেই কারণে সেখানে তাঁর নিয়মিত যাতায়াত। মালেকা বেগম আর মুনশি মোবারক আলীর পাঁচ কন্যা আর দুই পুত্র সন্তান। সে সময় গুটি বসন্ত আর কলেরার খুব প্রকোপ, আরও সন্তান রোগ আক্রান্ত হয়ে খুব ছোট বেলায় মারা যায়। বাবা, মা আদর আর সোহাগ দিয়ে মেয়েদের নাম রাখেন মতি,পান্না, হীরা, মুক্তা, হেনা, পুত্র সন্তানদের নাম শওকত আলী আর আহমেদ আলী সিরাজ। দুই বড় বোন মতি আর পান্নার পরে শওকত আলীর জন্ম। আনুমানিক বাংলা ১৩৪২ সালের চৈত্র মাসে শওকত আলীর জন্ম হয়। সঠিক তারিখটা অজানা থাকলেও, কল্পনা করতে কষ্ট হয় না – ফাগুণের মিষ্টি ঘ্রাণ সে দিনও বয়ে বেড়াচ্ছিল বাতাসে, কাল বৈশাখীর দমকা হাওয়ায় মাঝে মাঝে হেলে পরছিল গাছ গুলো সেদিন। পুত্র সন্তানের আগমনে মোবারক আর মালেকার আনন্দ আর ধরে না, সে আনন্দ ধারা ছড়িয়ে যায় পরিবারে, গ্রামে, কিংবা আরও বহুদূরে। শওকত আলীর জন্মের খবর শুনে মুনশি মোবারক আলী বাড়ির পশ্চিম কোনে দাড়িয়ে আজান দেন – “ আল্লাহু আকবর, আল্লাহু আকবর”, সেই আজানের ধ্বনি সেদিন শোনা যায় এই গ্রাম ছাপিয়ে অন্য গ্রামে কীর্তিনাশার পাড়ে। মাগরিব নামাজের পর, গ্রামের মুরুব্বিরা, শুভাকাঙ্ক্ষীরা আসেন মোবারক আলীকে পুত্র সন্তানের মোবারকবাদ জানাতে, স্থানীয় মিষ্টান্ন “খাজুর” বিতরণ করা হয় অতিথিদের।
সবাই চলে গেলে, মুনশি মোবারক আলী অন্ধকারে বাড়ির উঠোনে এসে দাঁড়ান, শুনতে পান ঝিঝি পোকার শব্দ ভেসে আসছে, জোনাকিরা ঊরে বেড়াচ্ছে এদিক অদিক, পরিষ্কার আকাশের দিকে তাকিয়ে বিস্মিত হন তিনি - আকাশ ভরা তারার মাঝে উত্তর কোনে একটা তারা আজ খুব জ্বল জ্বল করছে – তারার নাম ধ্রুব তারা (Polaris)।
পরের পর্ব
|