৭১ এর স্মৃতি ফিরোজ আলী
জীবনের একটা বিশাল পাওয়া ৭১ এর স্মৃতি। মনে থাকার মত বয়স না তবুও কিছু সময় আর কিছু কিছু ক্ষণ মনে পরে স্পষ্ট। আগরতলা মামলা থেকে মুক্তি পাবার পর আর সব সামরিক সদস্যদের মত আমার বাবাকেও অকাল অবসর দেয়া হয়। কার্পেটিং জুট মিল নয়াপাড়া বাবার নুতন কর্মস্থল। নয়াপাড়া যশোহর খুলনা শহরের মাঝামাঝি একটা উপশহর। মিলের পিছেই ভৈরব নদী। ৬৯ এর জুন মাসে আমরা চলে যাই ওখানে। আমরা বলতে বাবা, মা, আমি আর ছোট ভাই। আমার স্কুল শুরু এখানে থাকতেই – লায়ন স্কুল খুলনা। লাল একটা মাইক্রো বাস করে মিলের সব ছাত্র ছাত্রীরা যেতাম আসতাম স্কুলে।
২৭ শে মার্চ ৭১ - খবর এলো পাকিস্তান আর্মি মিল ঘিরে ফেলেছে । বাবা খাচ্ছিলেন, দেরি না করে গোপনে বেরিয়ে যেতে হলো দ্রুত। নদীর পারে বাধা নৌকাতে অবস্থান নিতে নিতেই আর্মি চলে আসে। এলোপাথাড়ি গুলির মধ্যে নদী পার হলেন ঠিকই কিন্তু আমাদের বাসা ঘিরে ফেললো ওরা, আমরা তখন সব দরজা জানালা বন্ধ করে বাসার ভিতরে। আর্মি দরজা ধাক্কাচ্ছে আর জোরে বুটের বাড়ি। দরজা না খুলতে পেরে জানালা ভেঙ্গে বাসায় ঢুকে পরে ওরা। ঢুকেই ছাদ থেকে নামাতে বলে মানচিত্র খচিত লাল সবুজ পতাকা - যেটা আমরা দু ভাই মিলে উড়িয়ে ছিলাম কিছু দিন আগে । আর্মি মেজর মার বুকে পিস্তল ধরা আর সমর সাজে সজ্জিত পাকিস্তান আর্মির সৈনিক মেশিন গান তাক করা দুই ভাইকে লক্ষ্য করে। মাকে বাবার কথা জিজ্ঞাস করছিল বারবার অফিসার। আর মা বলছিল বাবা ঢাকায়। অনেক কথা-বার্তার পর ওরা চলে গেল কিন্তু বলে গেল যদি বাবাকে পাওয়া যায় ওরা আবার ফিরে আসবে আর তখন আমাদের আর ছাড়বে না। পরিস্থিতি একটু শান্ত হলে, বাবা আমাদের জন্য আবার ফিরে আসে আমাদের নিয়ে যেতে। আমরা চলে আসি নদীর ওপারে এক অপরিচিত বাড়িতে। তারপর সেদিন রাতেই একটা বড় মালবাহী নৌকা করে রওনা হই আমাদের গ্রামের বাড়ি নাড়িয়া'র উদ্দেশ্যে। তিন দিন পর আমরা পৌঁছাই নড়িয়া। আমাদের রেখে বাবা চলে যান যুদ্ধে। পরে আমাদের দুই ভাইকে নিয়ে মা সীমান্ত অতিক্রম করে। যুদ্ধের সময় আমাদের অবস্থান ছিল মেলাঘর ২ নম্বর সেক্টরের কাছেই একটা স্কুল চত্বরে। স্কুল টিচারদের কোয়ার্টারের পাশেই পরে থাকা একটা জমিতে একটা কুড়ে ঘর ছিল আমাদের বাসস্থান। বাঁশের তৈরি মাচা ছিল আমাদের বিছানা। বাবা প্রশিক্ষণে ব্যস্ত ছিলো ২ নম্বর সেক্টরের মুক্তিযোদ্ধাদের। বাবার সাথে কদাচিৎ দেখা হত আমাদের। দুই ভাই মাঝে মাঝেই যেতাম ক্যাম্পে। প্রশিক্ষণ-রত মুক্তিযোদ্ধাদের দেখতাম। মনে পরে রুটি আর মাশ কলাইয়ের ডাল ছিল ওদের খাবার। আমরাও খেতাম মাঝে মাঝে ওদের সাথে। প্রতিদিন রেডিও তে শুনতাম বজ্র কণ্ঠ শিরোনামে বঙ্গবন্ধুর ৭ই মার্চের ভাষণ যা সবাইকে স্বাধীনতার স্বপ্নে উদ্বেলিত করতো। মুক্তিযোদ্ধাদের যে কোন বিজয়ের খবর আমাদের যার পর নাই আনন্দিত করতো আর কোন দুঃসংবাদ আমাদের করতো মর্মাহত। সম্মুখ আর গেরিলা যুদ্ধ ছাড়াও মুক্তি বাহিনীর নৌ এবং বিমান অভিযানের কাহিনী শুনে আমারা পুলকিত হতাম। ৮ জন নাবিকের ফ্রান্স থেকে পালিয়ে মুক্তিযুদ্ধে যোগদান কিংবা অব্যবহৃত পুরনো বিমান দিয়ে শত্রু পক্ষকে আক্রমণের কাহিনী আমাদের বিস্মিত করতো। বাংলাদেশের জন্য জর্জ হ্যারিসন আর রবি শঙ্করের কনসার্ট আমাদের অবাক করে দিয়েছিল। অকুতোভয় মুক্তিযোদ্ধাদের কথা স্মরণ করে স্বাধীনতা দিবসের শুভেচ্ছা জানাই সকলকে।
ফিরোজ আলী, সিডনি
|