স্মৃতির পাতা থেকে - একাত্তরের স্মৃতি ড. ফেরদৌসী জাহান
আবার ফিরে এসেছে মার্চ মাস। আমাদের স্বাধীনতার মাস। সেই সাথে ফিরে আসে সেইসব স্মৃতিগুলো যা ঘটেছিল ৭১ সালের মার্চ মাসে। দীর্ঘ ৪৬ বছর আগের ঘটনা হলেও সব স্মৃতি এখনো জ্বলজ্বল করছে মনে। দুঃখ-আনন্দ সহ অনেক নতুন নতুন অভিজ্ঞতা হয়েছিল সেই ৭১ এর মার্চ মাসে। আমি মাঝে মাঝে আমার মেয়েদের কাছে গল্প করি সেই সব দিনের কথা। ওরা শুনে বলে, আম্মু তুমি লাকী, কত নানান ধরনের অভিজ্ঞতা হয়েছে তোমার।
হ্যাঁ, আমার সেই দিনগুলো সত্যি চির অবিস্মরণীয় হয়ে আছে। আমি তখন রাজশাহীতে পি এন গার্লস স্কুলের ছাত্রী ছিলাম। সেই সময় সেই বয়সে রাজনৈতিক চিন্তাভাবনা কিছু বুঝতাম না তেমন। তবে বাসায় বড় ভাই-বোনদের এবং আব্বার আলোচনা শুনতাম; রেডিওতে খবর শুনতাম। এটা মনে আছে আমরা ভাই-বোনেরা মিলে কাগজের নৌকা বানাতাম; জয় বাংলা লিখে লিখে ঘর সাজাতাম। আমার মেজভাই ঢাকা ইউনিভার্সিটির ছাত্র ছিল। ভার্সিটিতে ক্লাস না হওয়ায় ও রাজশাহীতে চলে এসেছিল। আমার বড়ভাই দিনাজপুরে কলেজে চাকুরীতে ছিলেন। আব্বা ছিলেন সরকারী চাকুরে। তখন তার খুলনায় পোস্টিং। মনে পড়ে সেই ৭ই মার্চের বজ্রকন্ঠে বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ভাষণ সবাই রেডিওতে শুনলাম। তার পরেই মিছিল বের হয়েছিল রাস্তায়। যেহেতু স্কুল কলেজ বন্ধ ছিল তাই আমরা চার ভাই-বোন বেড়াতে গিয়েছিলাম নানাবাড়ি মনে হয় মার্চের ১৮/১৯ তারিখের দিকে। তখন নানাবাড়িতেও একই আলাপ-আলোচনা। আমার মামারা আর মেজভাই সারাদিন কোথায় কোথায় যেত, বলতো মিটিং আছে। আমরা দুই বোন খালাদের সাথে গল্প-গুজবে সময় কাটাতাম। ওদের আলাপ-আলোচনা থেকে বুঝতাম কিছু একটা হতে যাচ্ছে। মনে পড়ে আমাদেরকে বলেছিল পুরানো কাপড় দিয়ে ফিতার মত বানিয়ে দিতে। আমরা প্রচুর বানিয়ে দিতাম। পরে জেনেছি সেগুলো দিয়ে নাকি বোমা বানানো হতো।
এর মাঝে এলো সেই ২৫শে মার্চের কাল রাত। মনে পড়ে রাত প্রায় একটা/দুইটা হবে, পাশের ঘরে নানার ডাকাডাকিতে সবাই উঠে পড়লাম। জানলাম বর্বর পাক-বাহিনীর সেই কুৎসিত হামলার কথা। রেডিওতে নানা মামারা খবর শোনার চেষ্টা করছিলেন। আমরা ভয়ে চুপসে গেলাম। যেহেতু আমার অন্য ভাই-বোন, মা, আব্বা বিভিন্ন জন বিভিন্ন জায়গায় তাই আমরা আরো মুষড়ে পড়লাম। কে কোথায় কেমন আছে কে জানে। প্রায় দুই মাস আমরা আমাদের মা-বাবা এবং অন্য ভাই-বোনদের কোন খবর জানতাম না।
সিরাজগঞ্জে যখন মিলিটারি এলো আমরা সবাই চলে গেলাম গ্রামে খালার বাড়ীতে। শুরু হলো আর এক ধরনের অভিজ্ঞতা। গ্রাম্য জীবনের অভিজ্ঞতা সেই প্রথম। একে একে সব মামারাও চলে এলো গ্রামের বাড়িতে। অনেক লোকজন। ভাবতে অবাক লাগে কিভাবে তখন বাড়ির মহিলারা এতগুলো মানুষের খাবারের ব্যবস্থা করতেন! সেই ছোট বয়সে সেগুলো মনে হতো না কিন্তু এখন ভাবলে সত্যি অবাক লাগে। তার ওপর অনেক মুক্তিযোদ্ধারা আসতো একেক রাতে। তাদের জন্য খাবারের ব্যবস্থা করতে হতো। আমরা ছোটরা অনেক সময় ঘরের ভেতরে দেখতাম হারিকেনের আলোতে ১০/১২ জন বসে খাচ্ছে। সন্ধ্যার পরে সবাই উঠোনে গোল হয়ে বসে মামা, খালু ও বড়রা বসে রেডিওতে ‘বেতার-বাংলা’ শুনতো। আমরা ছোটরাও আশেপাশে ঘুরঘুর করতাম। তখন থেকে মুক্তিযুদ্ধের গানগুলো শুনতে খুব ভাল লাগতো "মোরা একটি ফুলকে বাঁচাবো বলে ….", "জয় বাংলা বাংলার জয়…"
প্রথম দিকে গ্রামে তখনও মিলিটারি যায়নি। তাই আমরা বেশ মজাই করতাম। মনে পড়ে জোছনা রাতে আমরা কজনা গ্রামের এ বাড়ী, ও বাড়ী, পাড়ায় পাড়ায় ঘুরে বেড়াতাম। চাঁদের আলোয় গাছতলায় বসে গল্প করতাম, গান করতাম। খালার বাড়ীর পিছনের আমবাগান পার হলেই এঁকে বেঁকে গেছে একটা খাল। দুপুরে সবাই মিলে সেই খালের পানিতে লাফঝাঁপ আর সাঁতার শেখার প্রচেষ্টা চলতো। ২/১ বার স্রোতের টানে ভেসেও গিয়েছি, অন্যরা উদ্ধার করেছে। পরে চোখ লাল করে পেট ফুলিয়ে পানি খেয়ে বাসায় ফিরে সবার বকুনি শুনতাম। কি যে মধুর সেই কিশোরী বেলার গ্রামের বাড়ীতে কাটানো দিনগুলো।
এক রাতে জানতে পারলাম নানার ঘরে জরুরী মিটিং চলছে। আমরা বাহিরে আড়ি পেতে শোনার চেষ্টা করলাম। জানলাম আমার এক মামা এবং তার কাজিন মুক্তিযুদ্ধে যোগ দিতে ইন্ডিয়া যাবে, তাই নানা-নানীর অনুমতি চাইছেন। কিন্তু ওনারা রাজী হচ্ছেন না। মামার বলা সেই কথা আজও কানে বাজে ‘‘আপনার তো আরও ছেলে আছে, মনে করেন এক ছেলে মারাই গেছে’’। যাহোক রাতে কখন সেই মিটিং কিভাবে শেষ হয়েছিল জানি না। তবে সকালে উঠে দেখলাম বাড়ীতে হৈ চৈ খোঁজাখুঁজি চলছে। তাদেরকে পাওয়া যাচ্ছে না। সবাই বুঝতে পারলাম মামাদের সেই রাতে হারিয়ে যাবার উদ্দেশ্য। রাতের গভীরে মুক্তিযুদ্ধে যোগ দেবার জন্য মামা চলে গিয়েছেন। আর সে কারণে সিরাজগঞ্জ শহরে নানার বাড়ীটা পুরোপুরিভাবে পোড়ানো হয়েছিল। কিছুই অবশিষ্ট ছিল না। যুদ্ধশেষে মামা বিজয়ীর বেশে ফিরে এসেছিলেন। মুক্তিযুদ্ধের অনেক গল্প শুনেছি তখন সেই মামার কাছে।
এদিকে ধীরে ধীরে গ্রামের দিকেও মিলিটারি আসতে লাগল। খালার বাড়ীর পাশের গ্রামটি হিন্দু অধ্যুষিত ছিল। একদিন জানলাম সেই গ্রামটি পুড়িয়ে দেয়া হয়েছে। আমরা দূর থেকে ধোঁয়া দেখতে পেয়েছিলাম। রাতে বন্দুকের গর্জন শোনা যেত। তখন বাড়ীর বড় জোয়ান ছেলেরা সারাক্ষণ বাড়ী পাহারা দিত রাত জেগে। আমরা কিছু কাপড়চোপড় ব্যাগে ভরে মাথার কাছে নিয়ে ঘুমাতাম। সেই বাড়ীর পাশে খালে একটা নৌকা বাঁধা থাকতো। যখনই দূর থেকে কোন সংকেত পাওয়া যেত যে, মিলিটারির গাড়ি আসছে, তখন মেয়েরা সবাই ছোটছোট ব্যাগ নিয়ে দৌড়ে নৌকায় উঠতাম। আমার ভাই, খালাতো ভাই তারা নৌকা চালিয়ে পাশের গ্রামে চলে যেতাম। অনেক রাত এমনি হয়েছে! তখন একটু অবাক হতাম শুধু আমাদেরকে কেন বাইরে পাঠিয়ে দেয় আগে আগে। পরে এগুলো বুঝেছি। একদিন মনে পড়ে দুপুরে তখন খাবারের সময় প্রায়। এমন সময় দৌড়ে এসে কেও খবর দিল মিলিটারি আসছে। আমরা যে যেমন অবস্থায় আছি তখনি দৌড়ে খালের দিকে গেলাম। কিন্তু সেদিন বলা হলো, নৌকা দিয়ে যাওয়া যাবে না, অন্যদিকে যেতে হবে। তাই ক্ষেতের মধ্যে দিয়ে দৌড়াচ্ছি। একটা জায়গায় এসে হাঁটুপানির খাল, সেটাও পার হতে হলো। সেই গ্রামেও গুলির শব্দ, মনে হলো পিঠে লাগল। আমরা সবাই আবার দৌড়াচ্ছি- তারপর আর একটা গ্রামের একটা বাড়ীতে যেয়ে উঠলাম। সেদিন সবাই যখন দৌড়াচ্ছি হঠাৎ আমার মেজভাইয়ের খেয়াল হলো আমার বড়ভাই নাই। সেই সময় আমার বড়ভাই শারীরিক ও মানসিকভাবে অসুস্থ হয়ে পড়েছিলেন, অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে। মেজভাই আবার দৌড়ে যেয়ে বড়ভাইকে পাঁজাকোলা করে নিয়ে এলেন। শুধু আমার বুড়ো নানা বাড়ী ছেড়ে যেতেন না কোথাও।
যখন গ্রামের অবস্থাও খুব নাজুক হয়ে পড়ল, অহরহ মিলিটারির আগমন হতে লাগল, তখন আমরা আবার রাজশাহীতে চলে এলাম জুন মাসের শেষে। ট্রেনে সিরাজগঞ্জ থেকে রাজশাহীতে আসার পথে অনেক মিলিটারিদের সম্মুখীন হতে হয়েছিল। আল্লাহর অশেষ রহমতে কোন দুর্ঘটনা ঘটেনি। আমার মেজবোন তখন রাজশাহী মেডিক্যালের ছাত্রী, বড়বোন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী। কত দুর্যোগ মাথায় নিয়ে আব্বা যে তার পরিবারকে রাজশাহীতে নিয়ে এসেছিলেন, এখনও মনে হলে গা শিউরে ওঠে। তারপর সেই ভয়ভীতি নিয়ে, কারফিউ নিয়ে চলল ক’টা মাস। আমরা স্কুলেও গিয়েছি তখন, যেতে বাধ্য হয়েছি। রাতে হ্যারিকেনের আলোয় বসে পড়তাম চুপিচুপি যেহেতু বার্ষিকী পরীক্ষা হবার কথা ছিল।
তারপর এলো সেই বিজয়ের মুহূর্ত, ১৬ই ডিসেম্বর। ভাসাভাসা মনে পড়ে তার আগের ও পরের দুই রাত কতটা আতংকে যে কেটেছে আমাদের। শোনা যাচ্ছিল মিলিটারি ও বিহারীরা দরজায় নক করে লোক ধরে নিয়ে যাচ্ছে। আমাদের বাসার বড়রা প্রায় জেগেই থাকতেন। বেশীর ভাগ সময় সিঁড়ির ঘরের পিছনে লুকিয়ে থাকতেন বড়ভাই। যেহেতু উনি মানসিকভাবে বেশী বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছিলেন। তারপর যেদিন দেশ স্বাধীন হলো, সেদিন কত যে আনন্দ, আমরা ভাইবোনরা সবাই বেড়িয়ে পড়েছিলাম রাস্তায়। সবাই বিজয়ের উচ্ছ্বাসে মাতোয়ারা। অনেক মুক্তিযোদ্ধারা বিজয়ের বেশে মিছিল করে যাচ্ছে; সবার গলায় ফুলের মালা। দু'পাশে সবাই আমরা স্বাগতম জানাচ্ছি। আমাদের এক পরিচিত রিকশাওয়ালা, যে আমাদেরকে স্কুলে পৌঁছে দিত, তাকেও দেখতে পেলাম গলায় মালা পড়ে বিজয়ী মুক্তিযোদ্ধাদের সাথে হাঁটছে। বিজয়ের সে যে কি আনন্দ, মুক্তির স্বাদ, সব ভয়-ভীতির অবসান। আমরা দু'বোন অনেকক্ষণ রাজশাহীর বিভিন্ন রাস্তায় ঘুরে বেড়িয়েছি মনের আনন্দে!
ড. ফেরদৌসী জাহান, সিডনি
|