bangla-sydney
bangla-sydney.com
News and views of Bangladeshi community in Australia













স্মরণিকা
ড. ফেরদৌসী জাহান




ইসফাকুর রাহমান সিফাত
সিফাত একটি যুবকের নাম।
সিফাত একটি অকালে ঝরে যাওয়া ফুলের নাম।
সিফাত আকাশে জ্বল জ্বল করা একটি নক্ষত্রের নাম।
হ্যাঁ, স্মার্ট, সুন্দর, ভদ্র, অমায়িক, মিশুক, প্রাণচঞ্চল লক্ষী একটি ছেলে ছিল সিফাত।
কিভাবে যে কি হয়ে গেল, কেন আল্লাহ ওকে এভাবে পৃথিবীর বুক থেকে ছিনিয়ে নিলেন। বাবামায়ের একমাত্র বুকের মানিককে কেড়ে নিলেন!

সিফাত আমার দেবরের একটি মাত্র ছেলে, এবং একমাত্র সন্তান, তার ভাল নাম ছিল ইসফাকুর রাহমান। সেই ছোট বেলা থেকে ওর অস্ট্রেলিয়ার প্রতি দুর্বলতা ছিল। যখন সে ৬-৭ বছরের ছোট্ট ছেলে, তখন থেকে সে ক্রিকেটের ভক্ত ছিল। অস্ট্রেলিয়ার সব ক্রিকেটারদের নাম জানা ছিল। আমরা এখান থেকে যখন দেশে বেড়াতে যেতাম, ওর জন্য যেসব খেলনা নিয়ে যেতাম, সিফাত সেগুলো দিয়ে খেলে আবার সযত্নে সাজিয়ে রেখে দিত আলমারিতে। কখনও নষ্ট করতো না। রাজশাহী কলেজিয়েট স্কুলের ছাত্র ছিল সে। ওকে বড় করতে ওর বাবা-মাকে কোন বেগ পেতে হয় নাই। সবসময় আমার দেবর-জা’র কাছে শুনেছি, সিফাতের কোন বড় চাহিদা নাই, কোন জেদ নাই, বাবামা’র কথামতো চলতো। তবে ওর প্রথম থেকেই লক্ষ্য ছিল একটাই, বড় হয়ে ও বিদেশে যাবে। সেই লক্ষ্যে এগিয়েছে একাই।

ঢাকায় আইইউবি (IUB) থেকে ট্রিপল-ই (Electrical and Electronics Engineering) তে গ্রাজুয়েশন শেষ করলো। সেই সাথে শুরু করলো অষ্ট্রেলিয়া আসার প্লান। ইংলিশ কোর্স করা, TOFEL পরীক্ষা দেওয়া, বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগাযোগ করা – এসব নিয়ে ব্যস্ত থাকত। অন্যান্য দেশে যোগাযোগ করলেও, সিফা্তের ইচ্ছা সে অস্ট্রেলিয়াতে আসবে। এই একটা ব্যাপারে সে তার বাবা-মা’র কথা শুনেছিল না। ওকি কখনও জানতো যে এখানেই ওর জীবনের অবসান হবে। জানিনা মানুষ আগে থেকে অবচেতন মনে কিছুটা বুজতে পারে কিনা। তার শেষ বিদায়ের সময়ের কথা শুনে তাই মনে হয়েছে। যেদিন তার ফ্লাইট ছিল তার আগের রাতে সে ঘুমিয়েছিল তার মায়ের সাথে এক বিছানায়, এবং এটা তার প্রস্তাব ছিল, যেটা বড় হবার পরে কখনও ঘটে নি। সারারাত মাকে বুঝিয়েছে, তারা যেন মনখারাপ না করে বেশী, সেতো প্রতি বছর একবার করে দেশে আসবে। ঢাকা এয়ারপোর্টে বিদায়ের আগে সিফাত নাকি তার বাবাকে ধরে কান্না তো করেছেই আর তার বাবা-মা-কে ধরে অজস্র চুমো দিয়েছে। এটাও আগে কখন করে নি সে। সিফাতের মা বিলাপ করে বলে আমার ছেলের সেই শেষ পরশ আমার!

মাত্র আড়াই মাস আগে দেশ থেকে অস্ট্রেলিয়ার ডারউইন শহরে “চার্লস ডারউইন বিশ্ববিদ্যালয়ে” মাস্টার্স ডিগ্রী করতে এসেছিল। শুরুতে আমরা মানা করেছিলাম ডারউইন এ না যেতে,কিন্তু নিয়তির লেখা সে খণ্ডন করবে কি ভাবে! তাই ওর তিনজন ঘনিষ্ঠ ইউনি ফ্রেন্ডস ওখানে ছিল বলে, সেও ওখানে গেল। সিফাতের সাথে প্রায় ফোনে কথা হত আমাদের। প্রথমবার বাংলাদেশ থেকে বিদেশে এসে খুব হ্যাপি ছিল ডারউইনে। দেশে আত্মীয়স্বজনকে ভিডিও ফোন দিয়ে সবকিছু দেখাতো। কেন জানি সব কিছু ওর ঠিকমতো হয়ে যাচ্ছিল। অল্পদিনের মধ্যে কাজ যোগার হয়েছিল। একটা গাড়ীও কিনেছিল। পড়াশুনাতেও সুন্দর এগোচ্ছিল। প্রতিদিন দুবার করে সে ফোনে মা’র সাথে কথা বলতো। তারপর একদিন হঠাৎ করে সব আশা, সব স্বপ্ন, চূর্ণ-বিচূর্ণ হয়ে গেল। ৫ই মে, ২০২৩ সাল, সেদিনও রাতে কাজ শেষ করে মায়ের সাথে কথা বলেছে। তারপর নিজের বিছানায় ঘুমাতে গেছে। সেই ঘুম যে ওর শেষ ঘুম হবে কে জানতো। একটা ড্রাগ-এডিক্টেড মানুষের চরম নির্মম নিষ্ঠুরতায় একটা সম্ভাবনাময় জীবনের পরিসমাপ্তি ঘটলো। হ্যাঁ, একজন চোর (intruder) সে রাতে সিফাতের ঘরে ঢুকেছিল, কি ভাবে কি হয়েছিল জানিনা, ওর মাথায় প্রচণ্ড আঘাত করেছিল। সিফাতের বন্ধুদের সহায়তায় সেই রাতেই পুলিশ তাকে ধরেছিল। সিফাতের ফোনটা সহ তার কাছে ৫-৬ টা মোবাইল পেয়েছিল পুলিশ। সেই ঘাতক এখন ডারউইনের জেলে, বিচারাধীন। বিচারে কি হবে জানি না, তবে তারপর থেকে আমার দেবর-জা’র জীবনের সবকিছু ওলটপালট হয়ে গেল, সেই সাথে আমাদের পরিবারেরও! আজও মনে পড়ে –
- সেই যে ভোরে প্রথম ফোন এ শুনলাম মর্মান্তিক দুর্ঘটনার কথা
- তারপর সারাদিনে ডারউইন হসপিটালের ডাক্তারদের সাথে ফোনে আপডেট শোনা
- তাড়াহুড়ো করে ডারউইন এ যাবার প্রস্তুতি আমাদের সবার জন্য এবং রাতের ফ্লাইটে রওনা হওয়া, মেয়ে-জামাই সহ।
- সেই যে গভীর রাতে ডারউইন হসপিটালের ICU তে যাওয়া আর মেশিন পরিবেষ্টিত সিফাত’কে বিছানায় নিথর পরে থাকতে দেখা!
- ICU রুমে সিফাতের হাত পা দেহ স্পর্শ করে আমাদের বসে থাকার মুহূর্তগুলো, ওকে শেষ বারের মত আদর করে দেওয়া!
- আবার কাঁদতে কাঁদতে দেশে যাওয়া, সিফাতকে শেষবারের মত দেশের বাড়ীতে নিয়ে যাওয়া!

ডারউইন হসপিটালের ডাক্তাররা কিছু করতে পারে নাই। ওর মাথায় প্রচণ্ড আঘাত লেগেছিল, অপারেটিং থিয়েটারে নিয়েও অপারেশন করা যায়নি! It was actually spot brain death. ওর হাত পা এবং পুরো শরীরের কোথাও কোন আঘাত ছিল না। দুইদিন আইসিইউ তে থাকার পর সবাইকে কাঁদিয়ে সিফাত চলে গেল, ওর লাইফ সাপোর্ট খুলে ফেলা হলো। ওখানকার বাঙ্গালী কমিউনিটি এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-ছাত্রীরা অনেক সাহায্য করেছে আমাদেরকে সেইসময়, সবকিছু প্রসেস করতে। ডারউইন মসজিদে একটা জানাজা পরানো হয়েছিল। তারপর তাকে নিয়ে যাওয়া হয়েছে গোবিন্দগঞ্জ এ, আমার শ্বশুর বাড়ী, যেখানে সিফাতের বাবামা ছিল। ওখানেই জানাজা পরে ওকে দাফন করা হয়েছে। চিরনিদ্রায় শায়িত এখন সিফাত।

সিফাতের বাবা-মা, অর্থাৎ আমার দেবর- জা র মুখোমুখি হবার সেই কঠিন হৃদয় বিদারক দিনগুলো - - - -। বাড়ীতে সবসময় ডাক্তার রাখা ছিল। ওদের দুজনকে কতবার যে ইনজেকশন দিয়ে ঘুম পাড়ানো হতো। সান্ত্বনা দেবার কোন ভাষা ছিল না। কানেকানে বাজে ওদের আহাজারি, ওদের বিলাপের কথাগুলো - - - -
- আমার একমাত্র সোনার টুকরা ছেলেকে কেন আল্লাহ এভাবে কষ্ট দিয়ে উঠিয়ে নিলেন, কি তার অপরাধ ছিলো।
- আমি তো তার কষ্টের সময় একটু সেবাযত্ন করতে পারলাম না। একটু বুকের মাঝে নিতে পারলাম না।
- আমার বাবা প্রতিদিন দুইবার করে ফোন করতো, আর কোনদিন আমার বাবার ফোন পাব না, আর ও জিজ্ঞাসা করবেনা “মা তুমি কি করছো, কেমন আছ?”
- আমার হাতের রান্না সিফাত খুব পছন্দ করতো, আমি আর ওর পছন্দের খাবার রান্না করে খাওয়াতে পারব না কক্ষনো।
- আমি তো সব জায়গায় খুঁজে বেরাই ভাবী, কোথাও আমার বাবার মুখ দেখতে পাই না, এত মুখ দেখি চারিদিকে, আমার বাবার সোনার মুখ কেন দেখি না।
- আমার বুকে এত কষ্ট , এত যন্ত্রণা ---, আমি কেমন করে বাঁচবো, তোমরা বলে দাও, কি নিয়ে বাঁচবো।
- এত মানুষ আসে যায়, আমার বুকের ধন, আমার বাবা কেন আসে না - - - !

কি যে একটা ভয়ংকর দিন গেছে, বা যাচ্ছে, বিশেষ করে আমার দেবর-জা’র জীবনটাকে তছনছ করে দিয়েছে। জানি মানুষের জীবন থেমে থাকবে না। সবই চলবে প্রকৃতির নিয়মে, তবে সিফাতের মা বলে আমরা তো এখন মরে বেঁচে আছি। আমাদের হাসি তো সিফাতের সাথেই চলে গেছে। আমরা তো আর হাসতে পারবো না। এইভাবেই জীবন চলবে। এটাই পৃথিবীর নিয়ম! মহান আল্লাহ সিফাতের আত্মাকে শান্তিতে রাখুন, ওকে জান্নাতবাসী করুন, আমিন।




ড. ফেরদৌসী জাহান, ক্যাসেল হিল, সিডনি





Share on Facebook               Home Page             Published on: 29-Dec-2023

Coming Events:





Lakemba Blacktown Mascot
Minto Money raised so far





Lakemba Blacktown Mascot
Minto Money raised so far



Blacktown Lakemba Mascot
Minto Money raised so far







Blacktown Lakemba Mascot
Minto Money raised so far