মায়ের পরশ ড. ফেরদৌসী জাহান
বিশটি বছর পার হয়ে গেল। হ্যাঁ দীর্ঘ বিশ বছর আগে, সেই ২০০০ সালের ৫ই সেপ্টেম্বর কালোরাতে, আমি আমার জীবনের সবচেয়ে প্রিয়জনকে হারিয়েছি। উনি আমার মা। মা, মাগো - - মা, ভীষণ ডাকতে ইচ্ছা করে এখনও। মা তুমি শুনতে পারছো। তোমার মুখটি যে সারাটা ক্ষণ আমার চোখে ভাসে মাগো। যখন আমি শুধু আমার মাঝে থাকি তখনই দেখতে পাই মাকে।
সেই বিশ বছর আগে শেষ দেখা হয়েছিল আমার মা’র সাথে, সেই শেষ বারের মতো মা’কে জড়িয়ে ধরে মাইক্রোবাসে উঠে পড়া। মায়ের সেই পরশ যে আজও লেগে আছে আমার বুকে। মা’র অশ্রু-ভেজা মুখটি এখনও চোখে ভাসে। ২০০০ সালের জানুয়ারি মাসের শেষের দিকে, ঠিক তারিখটা মনে নেই। পুরো ৮ সপ্তাহ ছুটি কাটিয়ে এসেছিলাম মেয়েদের স্কুল খোলার আগে। বাবা-মাকে ছেড়ে আসতে মন চাইতো না। যতদিন পারা যায় ওনাদের সাথে থাকতে চাইতাম। রিস্ক নিয়ে আমাদের ফ্লাইটের ২/১ দিন আগে রাজশাহী থেকে ঢাকায় যেতাম। কাঁদতে কাঁদতে দুটো দিন ঢাকাতে পার করে সিডনীর প্লেনে উঠতাম। এখানে এসে বিশ্রামের জন্য সময় নিতাম না, সিডনীতে এসেই পরের দিন কিভাবে অফিস করতাম তখন জানিনা।
দেশ থেকে বিদেশে যাবার মুহূর্তগুলো যে কতটা বেদনাদায়ক ছিল! আমার আব্বা সবসময় আসার আগে বলতেন, ‘মাগো আর মনে হয় দেখা হবে না’। কিন্তু মা কখনও এমন বলতেন না। তিনি তো তখনও ভাল ছিলেন, আব্বার সেবা করে আর নাতিদের নিয়ে সময় কাটাতেন। কখনও নিজের কষ্টের কথা বলতেন না। এখনও মনে পড়ে মাকে জড়িয়ে ধরে বাসা থেকে বের হয়ে, সামনের বাগান পেরিয়ে মাইক্রোবাসে উঠলাম, বললাম, ‘মাগো আসি’। সেদিন কি জেনেছিলাম এটি হবে শেষ স্পর্শ। সেবার দেশে যেয়ে অনেক মজা করেছিলাম। মনে হলে খুব ভাল লাগে। তখন মাইক্রোবাস ভাড়া করে মা’কে নিয়ে বেরাতে গিয়েছিলাম দেশের বাড়ী, সিরাজগঞ্জে। মা খুব খুশী হয়েছিলেন। কে জানতো এটাই ছিল মা’র শেষবারের মত দেশের বাড়ী যাওয়া। সেবার অনেক ফটো তুলেছিলাম মা’কে নিয়ে। সেগুলো এ্যালবামে লাগানো আছে, আজ পর্যন্ত বের করতে পারিনি। শুধু চোখে চোখে ভাসে, মনে হয় আমার সামনেই তো মা আছেন আমার চোখ জুড়ে, মন জুড়ে। শুধু আমি স্পর্শ করতে পারছি না। মা আমাদের ছেড়ে চলে যাবার পর শেষ পর্যন্ত এই বলেই মনকে বুঝিয়েছি।
অনেক অনেক সময় লেগেছিল এই কঠিন বাস্তবকে মেনে নিতে। সেই রাত তিনটাতে ফোন বেজে উঠেছিলো। আমার স্বামী ফোন ধরেছিল, আমেরিকা থেকে আমার ভাইয়ের ফোন। জানিনা কি কথা হয়েছিলো ওনার সাথে কিন্তু বুঝতে পেরেছিলাম আমি। আমার আর কোন হিতাহিত জ্ঞান ছিল না। শুধু এইটুকু জানি আমার মন বলছিল আমি মা’র কাছে যাব। আমি দরজা খুলে বের হয়ে যাচ্ছিছিলাম। আমার স্বামী আর মেয়েরা আমাকে আটকাতে পারছিল না। সেই রাতেই চারটার সময় আমাদের প্রতিবেশী বন্ধুকে ডেকে এনেছিল। তারপর সকালে ধীরেধীরে আমাদের অন্য বন্ধুরা চলে আসে। সেই দুঃসময়ে বন্ধুদের সহমর্মিতা, তাদের সাহায্যের জন্য আমি কৃতজ্ঞ।
আমার মা আমার কাছে সবচেয়ে প্রিয়জন। উনি চলে যাবার পর আমার হৃদয়ে যে একটা ছিদ্র হয়েছে, সেটা কখনও বন্ধ হবে না। এই বেদনা নিয়েই বাকি জীবন চলতে হবে। শুধু মহান আল্লাহর কাছে প্রার্থনা, উনি আমার মা’কে জান্নাতবাসী করুন, আমিন। আমার মা যে কেমন মানুষ ছিলেন, তার সঠিক বর্ণনা দিতে পারব কিনা জানি না। এখন ভাবতেও অবাক লাগে।
আমরা বড় পরিবার, নয় ভাইবোন, আব্বা ছিলেন সরকারী চাকরিজীবী। এতগুলো ভাইবোন মানুষ করেছেন, স্বাভাবিক ভাবেই টানাটানির সংসার ছিল। আব্বা মাসের প্রথমে বেতনের টাকা মা’র হাতে তুলে দিতেন। মা সবকিছু দেখতেন। আমরা যখন বড় হয়েছি, মা’র তখন বয়স হয়েছে, তখন আমরা হেল্প করতাম। আমি মনে করতে পারিনা মা’কে কখনও তেমনভাবে রাগ করতে দেখেছি, না আমাদের সাথে, না আব্বার সাথে। কিভাবে সেটা সম্ভব, জানিনা। আমরা ছোটবেলায় পড়ার সময়, পড়া বাদ দিয়ে যখন গল্প করতাম, মা রান্নাঘর থেকে শুধু বলতেন, ‘এই তোমরা গল্প করছ কেন পড়া বাদ দিয়ে’ – বাস, এইটুকুই। আমরা সব ভাইবোন শিক্ষার প্রতিটি ধাপে বৃত্তি পেয়েই পড়াশুনা করেছি। কেউ ডাক্তার, কেউ ইঞ্জিনিয়ার, আর নয়তো বিশ্ববিদ্যালয়। আল্লাহর রহমতে সবাই দেশে বিদেশে প্রতিষ্ঠিত। আমার ‘মা’কে তাই সবাই বলতো ‘রত্নগর্ভা’। আমার মা খুব ভাল ছাত্রী ছিলেন, অষ্টম ক্লাসে উঠার পর বিয়ে হয়ে যায়, আর পড়া হয় নি। আমাদের পড়াশুনা ছোটবেলায় মা দেখাশুনা করতেন। আব্বার ছিল বদলীর চাকরি। প্রথমদিকে আমাদের সবাইকে নিয়ে যেতেন, কিন্তু যখন আমার বড় ভাইবোনরা রাজশাহী মেডিক্যালে এবং বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তো, তখন থেকে মা আমাদের নিয়ে রাজশাহীতে থাকতেন। মনে পড়ে প্রতিটি বড় পরীক্ষার আগে আমরা সবাই মা’কে সালাম করে যেতাম। আমাদের সবার দৃঢ় বিশ্বাস মা’র দোওয়া ছাড়া কেউ কখনও সাফল্য অর্জন করতে পারবে না।
আমার মা পর্দা করতেন, আমি বড় হবার পরে মা কে কখনও বাজারে যেতে দেখিনি। প্রথম দিকে আব্বার সাথে যেতেন কিনা জানিনা, আগে আমার বড় বোনেরা শাড়ী-কাপড় কিনে আনতেন, পরে আমরা কিনে দিতাম। যা কিছু আনা হত, তাতেই মা খুশী হতেন। বাহিরের কারো সামনে উনি যেতেন না। ওনার যেমন ছিল দুধে আলতা গায়ের রঙ, তেমনি ছিল লম্বা কাল চুল আর একহারা গড়ন। আমার মামা-খালারা আমাদেরকে বলতেন, ‘তোমরা কেউ আমাদের বুবুর মত হতে পারনি’।
আমরা আব্বাকে সবসময় ভয় পেতাম, কারণ উনি বেশ রাগী ছিলেন। আমাদের সব আবদার থাকতো মা’র কাছে, যেমন সিনেমা দেখতে যাবার অনুমতি নেয়া, বেড়াতে যাবার কথা। মা আমাদের হয়ে আব্বাকে বলতেন। অবশ্য আগে যখন আমরা ছোট ছিলাম, তখন আব্বাও আমাদের সবাইকে নিয়ে যেতেন সিনেমা দেখতে। সেই অনেক আগে, তখন আমি প্রাইমারী স্কুলে পড়ি। সিরাজগঞ্জে থাকতাম আমরা। এতগুলো ছেলেমেয়ে নিয়ে আব্বা বর্ষার সময় নৌকা ভাড়া করে নদীতে ঘুরতে বের হতেন। টানাটানির সংসার হলেও কত যে সুখী এবং হ্যাপি পরিবার ছিল আমাদের। এখন সেটা ভাবতেও অবাক লাগে, আর এসব সম্ভব হয়েছিল আমাদের মায়ের গুনে।
মা আমাদের যেমন ছিলেন শান্ত, তেমনি ধৈর্য্যশীলা। দুপুরে শুয়ে উনি সবসময় গল্পের বই, ম্যাগাজিন অথবা সংবাদপত্র পড়তে ভালবাসতেন। মনে পড়ে যখন হাইস্কুলে এবং কলেজে পড়ি, মা দুপুরে আমাদের সাথে একই বিছানায় বিশ্রাম নিতেন। কিছুদিন যদি মা’র কাছে না শুতাম, মনে হতো মায়ের শরীরের গন্ধটা মিস করছি। মায়ের শরীরের পরশটা নিতে চাইতাম। রাতে মা আমাদের সাথে বসে টিভিতে বাংলা নাটক দেখতেন। যখন বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ি, তখনও সবকিছু শেয়ার করতাম মা’র সাথে। ক্লাসে আমাদের ছেলেমেয়েদের মাঝে খুনসুটি, দুষ্টামি সবকিছু গল্প করতাম। এখন সবকিছু শুধুই স্মৃতি।
বুকটা হাহাকার করে ওঠে। চোখের পানি বাঁধ মানতে চায় না। সব থেকে বেশী কষ্ট হয় এই ভেবে যে বাবা-মাকে সিডনীতে আনার সৌভাগ্য হয় নাই, পারিবারিক কারণে। কেন আল্লাহ এত তাড়াতাড়ি আমাদের মাকে কেড়ে নিলেন? কেন আরও কিছুদিন মায়ের স্নেহ-ভালবাসা পেতে দিলেন না। মা’র মুখের হাসি আরও কিছুদিন দেখার সৌভাগ্য দিলেন না। মা’র সেবা করার সুযোগ দিলেন না। মনে হয় আমরা কিছু করতে পারলাম না মা’র জন্য। মা যে আমাদেরকে হঠাৎ করেই ফেলে চলে গেলেন না ফেরার দেশে, যেমনটি মা চেয়েছিলেন। মহান আল্লাহ আমাদের বাবা-মা কে বেহেস্তবাসী করুন। রাব্বির হামহুমা কামা রাব্বাইয়ানি সাগিরা।
ড. ফেরদৌসী জাহান, ক্যাসেল হিল, সিডনি
|